করোনার নতুন স্ট্রেইন: করছি কী, করণীয় কী

শিশুদের ঝুঁকি বেশি
অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক ও অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম (উপরে বামদিক থেকে), ড. বিজন কুমার শীল ও ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম (নিচে বামদিক থেকে)

যুক্তরাজ্যে প্রথম শনাক্ত হয় মহামারি করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন। এরপর সেই স্ট্রেইন শনাক্ত হয় আরও কয়েকটি দেশেও। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ রেখেছে।

যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের নতুন এই স্ট্রেইনটি আগের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি গতিতে ছড়ায়। ফলে এটি অনেক দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভাইরাসটি নিজ দেশে যাতে না ঢোকে, সেই চেষ্টাতেই এখন ব্যস্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। অথচ বাংলাদেশে তেমন কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি। কেবল আজকে এসে যুক্তরাজ্য থেকে কেউ বাংলাদেশে এলে সাত দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকাসহ কিছু ব্যবস্থার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

করোনাভাইরাসের নতুন এই স্ট্রেইন কীভাবে-কোত্থেকে এলো? এটা কতটা শক্তিশালী? এর ভয়াবহতা কেমন? ইংল্যান্ডের বর্তমান অবস্থা কী? বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা কতটা ঝুঁকিতে? দেশে করোনার সংক্রমণের শুরু থেকে স্বাস্থ্য খাতের যে অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে, এখনো সেই একই পথে হাঁটলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে? বর্তমানে আমাদের করণীয়?— এসব বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অণুজীব বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল ও বায়ো মেডিকেল সাইন্স গবেষক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. খোন্দকার মেহেদী আকরামের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার

অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রথম যখন কোভিড আসে, সেই সময় আমাদের প্রস্তুতিও যেমন ছিল না, তেমনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তও নিতে পারিনি এবং সমন্বয়হীনতাও ছিল। যে কারণে আমরা সঠিকভাবে কোভিডকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। বর্তমান অবস্থায় করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন পাওয়া গেছে, যেটার সংক্রমণের হার বর্তমানেরটার চেয়ে বেশি। সুতরাং আমাদের এখন বিশেষ সতর্কতার আশু প্রয়োজন। প্রথমেই আমাদেরকে ব্রিটেনের সঙ্গে সব ফ্লাইট অনতিবিলম্বের বন্ধ করতে হবে। অন্য দেশ হয়েও যেন ব্রিটেন থেকে আসা কেউ দেশে প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এরপরেও ব্রিটেন বা অন্য যেকোনো দেশ থেকে কেউ দেশে প্রবেশ করলে তাদের পিসিআর পরীক্ষার ব্যবস্থা বিমানবন্দরেই করতে হবে। একইসঙ্গে বিমানবন্দরের সঙ্গেই আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।’

‘যিনি কোয়ারেন্টিনে থাকবেন, তার করোনা পরীক্ষার ফল যদি নেগেটিভ আসে, তাহলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু, যার পজিটিভ আসবে, তাকে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। এই কাজগুলো যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই’, বলেন তিনি।

যদি দেশে কোনোভাবে করোনার নতুন স্ট্রেইন প্রবেশ করে ফেলে, তাহলে পরিস্থিতি খুব দ্রুত অবনতির শঙ্কা রয়েছে কি না, জানতে চাইলে ডব্লিউএইচওর সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের এখানে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে আমি দুইটি কথা বলে আসছি। জনমানুষের শিথিলতা স্বাস্থ্যবিধি মানতে, আর সরকারের শিথিলতা স্বাস্থ্যবিধি মানাতে। এই দুই জায়গায় সরকার ও জনগণকে আরও কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। আরেকটা বিষয় হলো করোনা মোকাবিলায় ডব্লিউএইচওর যে পরামর্শ আছে, সেগুলো সরকার যাতে পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করে। যেমন: বিমানবন্দর দিয়ে যত লোকই আসবে, তাদের জন্য কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; পিসিআর পরীক্ষায় নেগেটিভ আসা ছাড়া কাউকেই আর দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না; যদি অন্য দেশ থেকে পিসিআর পরীক্ষার নেগেটিভ সনদ নিয়েও আসে, তারপরেও আমাদের এখানে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে; সবার জন্য পর্যাপ্ত কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তবে, ফ্লাইট আসা-যাওয়াটা নিয়ন্ত্রণ করাটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ কারণ ছাড়া কাউকে ভিসা দেওয়া যাবে না।’

‘ইংল্যান্ড ও কানাডার মতো জায়গায় তো আবার লকডাউন দেওয়া হয়েছে। আমাদের এখানে যদি আমরা পুনরায় লকডাউন না-ও দেই, তবে, চলাচলে বিধি-নিষেধ আরোপ করতে হবে। যেগুলো ব্যবসায়িক বা অন্য যেকোনো কিছু জরুরি প্রয়োজনে চালু রাখতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানা নিশ্চিত করে সেগুলো শুধু খোলা রাখতে হবে। মানে যেগুলো আগে মানার জন্য জোর দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোই আবার পুনর্বহাল করতে হবে। আর বয়স্ক লোকদের ক্ষেত্রে বাইরে গেলে জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসা বা অন্য বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া বয়স্ক কোনো লোক বের হতে পারবে না এবং এটা নিশ্চিত করতে হবে’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক।

করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব বেশকিছু ব্যবস্থা নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। এর আগে করোনার সংক্রমণের শুরুর দিকেও কমিটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষ ঢিলেঢালাভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। যার ফলশ্রুতিতে দেশে সঠিকভাবে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।

‘গতকাল আমরা বৈঠক করে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে তা সরকারকে জানিয়েছি’, বলছিলেন জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম

বর্তমানে করণীয় নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের তো আসলে কর্মক্ষমতা খুব কম। কোনো কাজই দেখা যায় আমরা পারি না। যদি বলা হয় যে, বিমানবন্দরে যথাযথ স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হোক, বাইরে থেকে যারা আসছে তাদের যথাযথ কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হোক, সেগুলো তো আমরা পারব না। কারণ, চলতি বছরের প্রথম দিকে চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে যারা এসেছিল, তাদের আমরা ছেড়ে দিয়েছি। এখন সবার আগে যেটা করতে হবে, তা হলো সপ্তাহ দুয়েকের জন্য সব ফ্লাইট বন্ধ করে দিতে হবে। ফ্লাইট বন্ধ রেখে এই সময়ে আমরা ব্যবস্থা নেব যে, কোথায় কোয়ারেন্টিন করব, কীভাবে তাদের রাখা হবে, তাদের ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, যাত্রীদের সঠিকভাবে স্ক্রিনিং করা, এগুলো ঠিক করতে হবে। এরপর হয়তো ফ্লাইট চালু করা যেতে পারে। তখন করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।’

দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুর দিক থেকেই বেশকিছু ভুলভ্রান্তি দেখা গেছে। এখনো সেই একই পথে হাঁটছি কি না?, জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর সাবেক এই উপাচার্য বলেন, ‘আসলে ভুল ছিল না। আমরা সবই জেনেছি, কিন্তু, ইচ্ছা করে করিনি। ভুল করা আর ইচ্ছা করে অবহেলা করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমরা তো জানতাম যে বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং করতে হবে। কিন্তু, থার্মোমিটারগুলো একটাও ভালো ছিল না। যারা আসছে, তাদের কোয়ারেন্টিন করতে হবে। তা না করে তাদের বাসায় যেতে দেওয়া হয়েছিল। এসবের কারণে সারাদেশে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ল। অথচ আমরা এগুলো করতে বলেছিলাম। কিন্তু, আমাদের কর্তারা গাঁয়ে লাগায়নি। মোদ্দা কথা হলো, নতুন স্ট্রেইন যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব আমাদের দেওয়া পরামর্শগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে।’

কোনোভাবে করোনার নতুন স্ট্রেইন প্রবেশ করলে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে?, অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘১৮ বছর বয়সীদের নিচে কাউকে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে না। যাদের বয়স ১৮ বছরের বেশি তারা পাবে। প্রথমে পাবে বয়স্ক ও চিকিৎসকসহ সম্মুখ সারির যারা আছেন তারা। এখানে বিষয় হলো করোনার যে নতুন স্ট্রেইন, সেই স্ট্রেইন কিন্তু শিশুদের জন্য বেশি সংক্রামক। এখানে দুটো জিনিস। প্রথমত শিশুদের জন্য কোনো ভ্যাকসিন নেই। দ্বিতীয়ত এই স্ট্রেইনটা তাদেরকেই বেশি আক্রমণ করছে। তাহলে শিশুদের দিকে আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাদেরকে নড়েচড়ে বসতে হবে। তারাই তো দেশের ভবিষ্যৎ। তাদেরকে তো ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না। সবাই ভ্যাকসিন ভ্যাকসিন করে মুখে ফেনা তুলছে। ভ্যাকসিন দরকার, ঠিক আছে। কিন্তু, এই ১৮ বছরের নিচের বয়সীদের জন্য যে ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি, সেটা নিয়ে কেউই কথা বলছে না। সেটা কেউ ভাবছে না। শিশুদের কীভাবে নিরাপদ রাখা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে।’

‘যেহেতু এই স্ট্রেইনটা শিশুদের বেশি সংক্রমিত করছে, তাই আমাদেরকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। হেলাফেলা করে নয়, যাচাই-বাছাই করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে সেটা অমার্জনীয় অপরাধ হবে। কারণ, প্রায় এক বছর ধরে আমাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, কী করতে হবে বা হবে না। শুরুর দিকে না হয় নতুন ছিল, অনেকেই বুঝত না। কিন্তু, এখন এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। আমরা যদি শিশুদের দিকে তাকিয়ে এবার তৎপর না হয়ে গাফিলতি করি, তাহলে সেটা অত্যন্ত অমানবিক হবে’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

করোনাভাইরাসটির নতুন স্ট্রেইন সম্পর্কে অণুজীব বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল বলেন, ‘করোনাভাইরাসের এই স্ট্রেইনটা প্রথম শনাক্ত হয় সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা ভাইরাসটির সিকোয়েন্সিং করে পেয়েছে যে, ভাইরাসটির র‌্যাপিডিটি একটু ভিন্ন ধরনের। ভাইরাসের মিউটেশন কিন্তু সব সময়ই হতে থাকে। ভাইরাসের ক্ষেত্রেও কিন্তু প্রুফ রিডিং হয়। সেখানে কোনো ভাইরাসের মাল্টিপ্লিকেশন দ্রুত হলে প্রুফ রিডিংয়ে গণ্ডগোল হয়। যার জন্য অসংখ্য মিউটেশনের বিষয়েই আমরা জানি না। সেগুলো নজরে আসে না। কিন্তু, যখনই বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, তখনই সেটি নজরে আসে। যেমন: ব্রিটেনের এটার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেল করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনটা দ্রুত সংক্রামিত করছে। এখানে সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো এই স্ট্রেইনটা শিশুদেরকেও সংক্রামিত করছে। এর আগে যেটা আমরা জানতাম যে, করোনাভাইরাস মূলত ২০ বছর বয়সী বা তার চেয়ে বেশি বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে সংক্রমণ হতো। কিন্তু, নতুনটা শিশুদের জন্যও সংক্রামক। যা সতর্কতামূলক। এর মানে বোঝা যাচ্ছে যে, ভাইরাসটির মধ্যে বেশ বড় পরিবর্তন হয়েছে। যদি কোনো ভাইরাস প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়, তাহলে সেটা খুব একটা বেশি ক্ষতি করে না। কিন্তু, যদি স্কেপ মিউটেশন করে, তাহলে সেটা বেশি ক্ষতিকর।’

‘ভাইরাসের ক্ষেত্রে হিউম্যান টু অ্যানিমেল, আবার অ্যানিমেল টু হিউম্যান ট্রান্সমিশনের একটি বিষয় আছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই ভাইরাসটি হিউম্যান টু মিনক, আবার মিনক টু হিউম্যান ট্রান্সমিশন হয়েছে। এর কারণে করোনাভাইরাসের মিউটেশন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে, আমরা পৃথিবীর সবাই আশা করছি যে, এর ফলে ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে যেন কোনো চাপ না পড়ে। ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে যে স্পাইক প্রোটিন দিয়ে, তার মিউটেশন ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। যে ভ্যাকসিনটা তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে তো কোনো মিউটেশন নেই। কিন্তু, নতুন স্ট্রেইনটার মধ্যে আটটি মিউটেশন দেখা গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই মিউটেশন ভ্যাকসিনের অ্যাপ্লিকেসির ওপর প্রভাব ফেলবে কি না। যদিও বলা হচ্ছে ফেলবে না। কিন্তু, এটা বের করা খুবই সহজ। সপ্তাহখানেক সময় লাগে। ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে এমন সুস্থ ব্যক্তিদের রক্তরস নিয়ে যদি ভাইরাসের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করা যায় এবং তা যদি ভাইরাস মেরে ফেলে, তাহলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আর যদি এমনটি না হয়, তাহলে ভ্যাকসিন আপডেট করতে হবে’, বলেন তিনি।

ড. বিজন বলেন, ‘আরেকটা বিষয় যা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সেটা হলো দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া। দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেই বলেছিলাম যে, দ্বিতীয়বার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এখন নতুন স্ট্রেইনটির ক্ষেত্রে যারা আগে সংক্রমিত হয়ে সুস্থ হয়ে গেছেন, তাদের অ্যান্টিবডি দিয়েই এটি ওভারকাম করবে কি না, এমন প্রশ্ন রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে যারা আগে সংক্রমিত হয়ে সুস্থ হয়ে গেছেন, তাদের রক্তরস নিয়ে যদি দেখা যায় যে, তাদের অ্যান্টিবডি নতুন এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারছে, তাহলে আর দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু, এটা না করা পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না।’

বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে এই ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেহেতু এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশকেও ভাবতে হবে। অন্ততপক্ষে যারা ব্রিটেন থেকে আসবে তাদেরকে অবশ্যই ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। একইসঙ্গে যেহেতু ভাইরাসটি সেপ্টেম্বর থেকে শনাক্ত হয়েছে, তাই তখন থেকে যারা যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে এসেছেন, তাদের খোঁজ নিতে হবে। তারা সুস্থ আছেন কি না, সেটা জানতে হবে। অসুস্থ হলে কী হয়েছে সেটা ভালোভাবে গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মোদ্দা কথা, পুরো বিষয়টি নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। বেশি চিন্তার কারণ এই ভাইরাসটি শিশুদের জন্যও সংক্রামক। যত দ্রুত সম্ভব সরকারকে তৎপর হতে হবে। একইসঙ্গে সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। ভ্যাকসিন ফেল করলেও মাস্ক আমাদেরকে বাঁচাবে।’

করোনাভাইরাসের যে সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী হচ্ছিল, সেটারই মিউটেশন হয়ে নতুন স্ট্রেইন পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম। তিনি বলেন, ‘ইংল্যান্ডের বিশেষ অঞ্চল, যেমন: লন্ডনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মানুষের মাঝে যে ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমণটা হচ্ছে, সেটা একটা মিউটেটেড ভাইরাস। এ অঞ্চলের ৬২ শতাংশ আক্রান্ত মানুষের শরীরেই এই রূপান্তরিত ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে একসঙ্গে ১৭টি মিউটেশন হয়েছে। মানে ভাইরাসটির জিনগত পরিবর্তন হয়েছে এবং সেই জিনগত পরিবর্তনের কারণে স্পাইক প্রোটিনেরও পরিবর্তন হয়েছে। স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তনের কারণেই ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। অর্থাৎ এর ইনফেকশনের প্রবণতা বেড়ে গেছে। ইনফেকশনের প্রবণতা বাড়া মানে এর ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতাও অনেক বেড়ে গেছে। হিসাব করে দেখা গেছে যে, নতুন স্ট্রেইনের এই বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাটা আগের ভাইরাসের চেয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। ফলে যুক্তরাজ্যে খুব দ্রুতই এই ভাইরাসটি মানুষের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছে। ছড়িয়ে পড়ার এই বিষয়টি কিন্তু নতুন না। সেপ্টেম্বর থেকেই এই মিউটেশনটা ধরা পড়ছে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় এক হাজার মানুষের স্যাম্পল নিয়ে এই মিউটেশনটা দেখা গেছে। ফলে এখন নতুন এই স্ট্রেইনের বিষয়টি নিশ্চিত।’

করোনাভাইরাসের নতুন মিউটেশন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতায় কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, জানতে চাইলে এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের করোনাভাইরাস মিউটেশনের কারণে স্পাইক প্রোটিনের ১৭টি স্থানে পরিবর্তন হয়েছে। এখন পর্যন্ত যত ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে, এর সবগুলোরই লক্ষ্য হচ্ছে স্পাইক প্রোটিন। ফলে এই প্রোটিনের গঠনগত পরিবর্তনে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে, এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস বর্তমান মিউটেশন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতায় তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। যদিও এখনো এর ওপর কোনো পরীক্ষালব্ধ তথ্য-উপাত্ত নেই। আরও কিছুদিন গেলে এবং আরও গবেষণা হলে এই প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে পাওয়া যাবে।’

ইংল্যান্ডের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ব্রিটেনের দ্য ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. আকরাম বলেন, ‘বড়দিনের সময় পাঁচ দিনের ছুটিতে লকডাউনের কড়াকড়ি শিথিল করা হয়েছিল। যাতে সবাই একে অপরের বাড়িতে যেতে পারে, উৎসব উদযাপন করতে পারে। কিন্তু, নতুন স্ট্রেইনটি শনাক্ত হওয়ায় সেই শিথিলতা বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ আবারও সেই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এখন চতুর্থ মাত্রার লকডাউন দেওয়া হয়েছে। নতুন স্ট্রেইনটি যাতে ইংল্যান্ডসহ গোটা যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, তাই এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নতুন স্ট্রেইনটি যেহেতু আরও বেশি শক্তিশালী, সে কারণে এখন পর্যন্ত ৪০টির মতো দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করেছে, সীমানা বন্ধ করে দিয়েছে, সড়ক পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভারত, পাকিস্তানসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশও যুক্তরাজ্যের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। যুক্তরাজ্য থেকে নতুন এই স্ট্রেইনটা যাতে পৃথিবীর আর কোথাও না ছড়ায়, তাই এই সতর্কতা।’

সবশেষে বাংলাদেশে করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ভেতরে রয়েছে। লন্ডনসহ ইংল্যান্ডের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভাইরাসের মিউটেশনটা হয়েছে এবং সেখানেই অনেক বাংলাদেশি বসবাস করেন। এখন সেখানকার বাংলাদেশিরা যদি সঙ্গে করে নতুন স্ট্রেইনটি নিয়ে আসে এবং সেটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে এখনকার মহামারি আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বলে নতুন স্ট্রেইনটি ছড়ানোর ঝুঁকিও বেশি। ফলে ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনটি যাতে কোনোভাবেই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের অন্তত দেড় থেকে দুই সপ্তাহের জন্যে হলেও যুক্তরাজ্যের ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে অন্যান্য দেশের ফ্লাইটগুলোতে যারা আসবেন, তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা করতে হবে। যদি ফ্লাইট বন্ধ করা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্ততপক্ষে যাত্রীরা যেন প্রি-ফ্লাইট আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় নেগেটিভ কনফার্ম হয়ে আসে, এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে, যাতে অবশ্যই এটা মানা হয়। যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে নতুন এই স্ট্রেইনের প্রবেশ রোধে তাৎক্ষণিক এই ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।’

‘একইসঙ্গে যেহেতু সেপ্টেম্বর থেকে নতুন স্ট্রেইনের সন্ধান পাওয়া গেছে, ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে যারা দেশে গিয়েছেন, তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিং করতে হবে। কারণ, তারা নতুন স্ট্রেইনটি নিয়ে এসেছেন কি না, তা তো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাই তাদের খোঁজটাও নিতে হবে।’

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago