৭ কলেজের দুঃখগাথা

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট কমাতে অধীনস্ত কলেজগুলোকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। ওই বছরই পরিকল্পনাহীনভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয় রাজধানীর বড় সাতটি কলেজ। তিন বছর পর দেখা যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাদবাকি কলেজগুলোর তুলনায়ও পিছিয়ে পড়েছে এই কলেজগুলো।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট কমাতে অধীনস্ত কলেজগুলোকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। ওই বছরই পরিকল্পনাহীনভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয় রাজধানীর বড় সাতটি কলেজ। তিন বছর পর দেখা যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাদবাকি কলেজগুলোর তুলনায়ও পিছিয়ে পড়েছে এই কলেজগুলো।

২০১৭ সালের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শুরু হয়েছিল চলতি বছরের মার্চে। কিন্তু, দুটি পরীক্ষা হওয়ার পরই করোনাভাইরাস পরিস্থিতির জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আটকে যায় তাদের পরীক্ষাও। স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরাও আটকে আছেন সেশন জটে। তৃতীয় বর্ষে একইসঙ্গে রয়েছে দুটো ব্যাচ।

সরকারি তিতুমীর কলেজের বিজ্ঞানের একটি বিভাগে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন ইশরাত জাহান। কলেজটি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত হয় তখন তারা ছিলেন তৃতীয় বর্ষে। স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে। তার সহপাঠীরা যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত কলেজগুলোতে একইসঙ্গে ভর্তি হয়েছিলেন, তাদের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা হয় ২০১৯ সালের জুন মাসে, শেষ হয় ৫ আগস্ট।

ইশরাতদের স্নাতকোত্তরের যে পরীক্ষা ২০১৭ সালে নেওয়ার কথা ছিল সেটা শুরু হয় চলতি বছরের ১০ মার্চ। কিন্তু, করোনা পরিস্থিতির কারণে দুটো পরীক্ষা হওয়ার পরই অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়।

ইশরাত বললেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের মধ্যেও আমার বন্ধুরা পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবন ছয় বছরে শেষ করতে পেরেছে; আর আমাদের সাত বছর হয়ে গেলেও পরীক্ষা শেষ হয়ে ফল কবে হবে, সেটা কেউ জানি না।’

শুধু ইশরাত নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত সরকারি সাত কলেজের প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থীর ভাগ্যও তার মতোই ঝুলে আছে। চাকরির অনিশ্চয়তার পাশাপাশি এই শিক্ষার্থীরা আর্থিক সংকট ও পারিবারিক চাপসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত।

এদের একজন হযরত আলী। তিনি যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি দুশ্চিন্তায়। ঢাকা কলেজের রসায়ন বিভাগের মাস্টার্সের এই শিক্ষার্থীর পড়ালেখা শেষ হওয়ার কথা ছিল আরও আড়াই বছর আগে। এতদিনে হয়তো তিনি তার পরিবারের ভার কিছুটা বহন করতে পারতেন।

‘এই বয়সে, বাড়ি থেকে টাকা নিতে ভালো লাগে?’— বলছিলেন হযরত আলী। তিনি তার বাবার কাঁধে কাঁধ মেলাতে চান, যিনি সীমিত আয়ে দীর্ঘদিন পরিবারটিকে টেনে চলছেন। তিনি বললেন, ‘আগে তো টিউশনি করতে পারতাম, কিন্তু করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে টিউশনিও বন্ধ। পরিবারকে সাহায্য করার জন্য আমাকে এখনই কিছু একটা করা দরকার।’

আড়াই বছর বিলম্বে তার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয় মার্চ মাসে। মহামারির কারণে তার বাকি পরীক্ষাগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মাস্টার্সের পরীক্ষা আবার কবে শুরু হবে, জানি না। এমনকি, পরীক্ষা হলেও নির্দিষ্ট সময়ে ফল বের হওয়ার কোনো নজির নেই। সামনেই জানুয়ারিতেই আমার বয়স ২৭ পূর্ণ হবে। কয়টা বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারব সেটাও জানি না।’

এমনকি বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে কেমিস্ট হিসেবে চাকরি পেতেও মাস্টার্স চাওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

‘আমরা আমাদের শিক্ষকদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি— তারা শুধু বলেছিলেন যে আমাদের কলেজটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু না বলা পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসার পর কলেজগুলোতে যখনই একটি শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছিল; তখনই করোনা মহামারি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে।

এই সাতটি কলেজ হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।

বিক্ষোভ ঘোষণা, পরে স্থগিত

কলেজগুলোর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে শিক্ষার্থীরা গত মঙ্গলবার রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকায় বিক্ষোভ করার ঘোষণা দিয়েছিল। আগের দিন তাদের পক্ষ থেকে পুলিশের কাছে কর্মসূচি পালনের জন্য আবেদনও করা হয়েছিল। কিন্তু, পরে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। সকাল থেকে নীলক্ষেত এলাকায় পুলিশের বাড়তি উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল।

আন্দোলনকারীদের একজন ঢাকা কলেজের শাহরিয়ার মাহমুদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, কর্মসূচির জন্য পুলিশের অনুমতি পাওয়া যায়নি।  তাছাড়া, কলেজের অধ্যক্ষরা কর্মসূচি স্থগিত করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে রাতে ফোন করেছিলেন। তারা সমস্যা সমাধানের জন্য এক সপ্তাহ সময় চেয়েছেন।

তিনি আরও  বলেছেন, ‘যদি এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের সব দাবি পূরণ না হয়, তবে আমরা আন্দোলনের জন্য পুলিশের অনুমতির অপেক্ষা করব না।’

তাদের প্রধান দাবিগুলো মধ্যে রয়েছে, কলেজগুলোতে সেশনজট কমানো; প্রতিটি সেশনে যেন একটিমাত্র ব্যাচ থাকে, সে ব্যবস্থা করা; পরীক্ষার ফলাফল সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করা ও সনদপত্রে নতুন করে যুক্ত হওয়া ‘এফিলিয়েটেড’ শব্দ প্রত্যাহার করা।

শিক্ষার্থীরা তাদের বিক্ষোভ ঘোষণা করার পর সাতটি কলেজের প্রধান সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল মইনের সভাপতিত্বে কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের একটি বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, গত মার্চে স্থগিত হয়ে যাওয়া পরীক্ষাগুলো আগামী ২০ জানুয়ারির মধ্যে শুরু হবে।

বিষয়টি জানিয়ে সাত কলেজের সমন্বয়ক কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার ডেইলি স্টারকে বলেছেন, অন্য পরীক্ষাগুলোও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন, নতুন করে যেসব পরীক্ষা নেওয়া হবে সেগুলো লিখিত পরীক্ষার পরিবর্তে ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডিং) পদ্ধতিতে হবে।

অধ্যক্ষ সেলিম উল্লাহ খন্দকার আরও জানিয়েছেন, তারা ২৬ ডিসেম্বর থেকে অনলাইনে ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট ও উপস্থাপনা গ্রহণ শুরু করছেন।

সেশন জট

২০১৭ সালে ঢাকার এই সাতটি কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পেছনে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল— শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং সেশনজট কমানো।

তবে কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই এই অধিভুক্তির ফলে শুরুর দিকেই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও ফলাফল ঘোষণা দিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা শুরু হয়, যার রেশ তিন বছর পরেও টানতে হচ্ছে।

এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত ছিল, যার বিরোধিতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেছে একাধিকবার।

সর্বশেষ গত বছরের জুলাইয়েও তারা সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল দাবি করে বলেছিলেন, সাত কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সনদপত্রে কোনো পার্থক্য থাকছে না, যার ফলে তাদের বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শেষ পর্যন্ত, গত মার্চে যখন ফাইনাল পরীক্ষাগুলো শুরু হলো, তখনই কোভিড-১৯ মহামারি প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন থমকে দিল।

ইডেন কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহমুদা জাহান বলেছেন, ‘পরিস্থিতি না বদলালে, আমাদের অনেকেরই সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স থাকবে না।’

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago