ধান খেত থেকে তুলে নিয়ে মাদক মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ

‘আমরা দুই জন রোডের লগেই জমিতে কাম করতেছিলাম, হঠাৎ দেখলাম একটা অটো (অটোরিকশা) আইলো, ভিতরে বিডিআরও (বিজিবি) আছে, বিডিআর আমরারে ডাক দিয়া জিগাইলো উনারে চিনেননি। আমরা কইলাম চিনি। নাম জিগাইলো। বললাম, নাম অপু। এরপর বিডিআর কইলো এহানো একটা সই দেন, দিয়া দিলাম। অপুরে আমরা দেখছি অটোত বসা, তার কাছে কী আছে তা আমরা কিছুই দেখছি না। পরে হুনলাম অপুর কাছে নাকি চাইর হাজার ইয়াবা পাইছে। এই মামলায় আমারে, আর আমার চাচতো ভাই মন্টুরে সাক্ষী বানানো অইছে।’
Apu_Bbaria_1Jan21.jpg
অপু মিয়া | ছবি: সংগৃহীত

‘আমরা দুই জন রোডের লগেই জমিতে কাম করতেছিলাম, হঠাৎ দেখলাম একটা অটো (অটোরিকশা) আইলো, ভিতরে বিডিআরও (বিজিবি) আছে, বিডিআর আমরারে ডাক দিয়া জিগাইলো উনারে চিনেননি। আমরা কইলাম চিনি। নাম জিগাইলো। বললাম, নাম অপু। এরপর বিডিআর কইলো এহানো একটা সই দেন, দিয়া দিলাম। অপুরে আমরা দেখছি অটোত বসা, তার কাছে কী আছে তা আমরা কিছুই দেখছি না। পরে হুনলাম অপুর কাছে নাকি চাইর হাজার ইয়াবা পাইছে। এই মামলায় আমারে, আর আমার চাচতো ভাই মন্টুরে সাক্ষী বানানো অইছে।’

কথাগুলো বলছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের নলগড়িয়া গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ জামাল মিয়া। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর নলগড়িয়ার পাশের গ্রাম নোয়াবাদীর প্রয়াত ইউপি সদস্য ফুল মিয়ার ছেলে অপু মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন স্থানীয় আলীনগর ক্যাম্পের বিজিবি। জামাল মিয়া ও মন্টু মিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী, তারা কিছু না জানলেও তাদের এ মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে।

Apu_Bbaria1_1Jan21.jpg
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন অপু মিয়া। ছবি: সংগৃহীত

অপুর স্ত্রী লাবনী আক্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার স্বামী মানসিকভাবে অসুস্থ। ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। অপু ধান খেতে কাজ করছিলেন, সে সময় বিজিবি সদস্যরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। তার কাছে তিন হাজার ৯৪৫ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে— এমন অভিযোগ সাজিয়ে তিন জনের বিরুদ্ধে বিজয়নগর থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।’

মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, নোয়াবাদী পূর্বপাড়া জামে মসজিদ সংলগ্ন কাঁঠাল বাগানের ভেতর থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা ইয়াবাসহ অপুকে আটক করে বিজিবিকে জানায়। এরপর বিজিবি সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উত্তেজিত জনতার হাত থেকে অপুকে উদ্ধার করে।

লাবনী আক্তার আরও বলেন, অপু প্রায় সাত বছর মালয়েশিয়ায় ছিলেন। হঠাৎ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় দেশে ফিরে আসেন। ২৯ সেপ্টেম্বর কাঁঠাল বাগানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি দাবি করে তিনি বলেন, খেত থেকে অপুকে তুলে নিয়ে গিয়ে মাদক মামলা দেওয়া হয়েছে।

ওই মামলায় অপুর বড় ভাই কাপড় ব্যবসায়ী সুভল মিয়াকে তিন নম্বর আসামি করা হয়েছে। লাবনীর অভিযোগ, স্থানীয় মাদক চোরাকারবারিদের একটি চক্র মূলত সুভল মিয়াকে ঘায়েল করতে এই গল্প সাজিয়েছে। তাতে ফেঁসে গেছেন অপু।

অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বিজয়নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জুয়েল রানা ভূঁইয়া সুভলকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রার্থনা জানিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। তিন মাস তদন্তের পরে বাকি দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বর অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালত এই অভিযোগপত্র আমলে নিয়েছেন।

অপু প্রায় তিন মাস ধরে কারাবন্দি। লাবনী আক্তার বলেন, একটি মহল বিজিবিকে ভুল বুঝিয়ে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা করাচ্ছে। তারাই প্রকৃত মাদক চোরাকারবারিদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছে।

গত কয়েক মাসের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা সাধারণ মানুষের ভেতরে অনাস্থা বাড়িয়ে দিয়েছে। উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের নোয়াগাঁওয়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এরশাদ মিয়াকে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। এ ঘটনার প্রতিবাদে গত ২৪ ডিসেম্বর মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী। ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান রতন মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে প্রকৃত মাদক চোরাকারবারিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।

গত বছরের ২৯ অক্টোবর একই ইউনিয়নের ভারত সীমান্তবর্তী কাশিনগর গ্রামের বাসিন্দা, বিজয়নগর থানার তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক চোরাকারবারি ও হত্যা মামলার আসামি সজলকে তার বাড়ি থেকে ফেনসিডিলসহ আটক করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তার কাছে মাত্র দুটি ভারতীয় এসকফ সিরাপ উদ্ধার দেখিয়ে মামলা দায়ের হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

তাদের অভিযোগ, আটকের সময় বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল পাওয়া গেছে সজলের বাড়িতে। ১৫ দিন পরে গত ১৩ নভেম্বর জামিনে বের হয়ে আসেন সজল। বের হয়ে এসে আবারও তিনি মাদকদ্রব্য বিক্রি করছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বিজয়নগর উপজেলায় অন্তত পাঁচ শতাধিক মাদক চোরাকারবারি রয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ স্থানীয়দের নামের তালিকা প্রকাশ করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বিজয়নগর উপজেলায় ভারতীয় সীমান্তবর্তী ১২টি গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে যারা গা ঢাকা দিয়েছিলেন, তারাই এখন বিভিন্ন গ্রামে মাদকের কারবার চালাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও তাদের স্বজন এবং কিছু রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় মাদক কারবার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

সূত্র জানায়, সিঙ্গারবিল বিজিবি ক্যাম্পের পাশেই অন্তত ৩০টি মাদক বিক্রির স্পট রয়েছে। এ ছাড়া, বিষ্ণুপুর, মুকুন্দপুর ও তোফায়েল নগর ক্যাম্পের পাশে ৫০টির বেশি মাদক স্পটে হাত বাড়ালেই মেলে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। সীমান্ত থেকে দূরে চান্দুরা, বুধন্তী, পত্তন ও চম্পকনগর ইউনিয়নেও অন্তত ৫০টি স্পট রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবি’র ২৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. ফেরদৌস কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি সম্প্রতি এই ব্যাটালিয়নে যোগ দিয়েছি। এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সজলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে দুটি এসকফ সিরাপ উদ্ধার করা হয়েছে। আমাদের অভিযানের সময় অনেক লোক উপস্থিত থাকে। ফলে লুকোচুরির কোনো সুযোগ নেই। মাদক চোরাকারবারিরা বাঁচার জন্য বহু কৌশল অবলম্বন করে, অনেক কথা বলে।’

Comments

The Daily Star  | English

Abu Sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

12h ago