নতুন বছরেও আশার আলো দেখছে না ইউরোপ!
পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশের মতো ইউরোপের জনগণের কাছে ২০২০ সাল ছিল ভীষণ ভয়ঙ্কর একটি বছর। তবে নতুন বছরে এই উন্নত মহাদেশটি আশার আলো দেখবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বছরের শেষ দিনে সংবাদমাধ্যম সিএনএন’র এক প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, করোনা মহামারি, ব্রেক্সিট ও বিশ্ব রাজনীতির কালোছায়া ২০২০ সালে ইউরোপীয়দের জনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল।
সেসব সমস্যা নতুন বছরটিতেও থেকে যাবে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে।
প্রতিবেদন মতে, যদি মহামারি কেটেও যায়, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় অথবা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বিরোধী প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রে না আসেন, তবুও ব্রাসেলসকে আরও অনেক ‘চাপা দেওয়া’ ইস্যু নিয়ে ২০২১ সালটি কাটাতে হবে।
নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকট কাটিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে ইউরোপকে আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
নতুন বছরে ইউরোপের সংকটের মধ্যে রয়েছে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের সঠিক দিক ঠিক করা, করোনা মোকাবিলায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্যাকেজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন ইত্যাদি।
এসব বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছে ইইউ সদস্য দেশ হাঙ্গেরি ও পোলান্ড।
ব্রাসেলসে অনেককেই বলছেন হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডকে বাদ দিয়েই করোনা মোকাবিলা তহবিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা। এমনটি হলে জোটের সদস্য সংখ্যা ২৭ থেকে কমে ২৫ এ দাঁড়াবে। এটি জোটকে নতুন করে হুমকির মধ্যে ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রশ্ন উঠবে জোটের একতা নিয়ে।
বার্লিন-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ডেমোক্রেসি রিপোর্টিং ইন্টারন্যাশনালের লিগ্যাল অফিসার জ্যাকুব জারাকজেভস্কি সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, ‘ইইউয়ের অভ্যন্তরীণ সমস্যার ক্ষেত্রে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। গত কয়েক বছর ধরে জোটের অন্য দেশগুলোর মধ্যেও ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়ে বিবাদ রয়েছে।’
ব্রেক্সিটের আগে শুধু যে ব্রিটেনের জনগণের মধ্যেই ইইউ-বিরোধী মনোভাব ছিল তা নয়। জোটভুক্ত সব দেশেই জোটবদ্ধ হওয়ার কুফল নিয়ে কম-বেশি আলোচনা হয়।
জার্মানির চরম ডানপন্থি অলতারনেটিভ ফুর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) দলের ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য গুনার বেক সিএনএন’কে বলেছেন, ‘আমরা হয়তো এখন ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা বলছি না, তবে আমাদের ফোকাস হচ্ছে আরও বেশি ইইউ-বিরোধী মানুষের সমর্থন অর্জন করা।’
তার মতে, ব্রেক্সিটের পর অথবা ইইউ-সমর্থক জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পরও ইউরোপে জোটবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
‘গত ২০১০ সাল থেকেই ইইউ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে। সেগুলোর কোনো সমাধান হয়নি। একক মুদ্রা ব্যবস্থা ইউরোজোন নিয়েও সমস্যা রয়েছে। অভিবাসীদের নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এরপর, নতুন করে এসেছে করোনা মহামারি,’ যোগ করেন এএফডি নেতা।
প্রতিবেদন মতে, জোটের এমন বাস্তবতায় ২০২১ সাল সাক্ষী হয়ে থাকবে গুনার বেকের কথা কতোটা যুক্তিযুক্ত ছিল।
জোটের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র জার্মানিতে ২০১৩ সালে গঠিত হয়ে এএফডি দেশটির ২০১৭ সালের নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য পায় এবং প্রধান বিরোধীদল হয়ে উঠে।
জোটের অপর গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডসের জনমনেও রয়েছে জোট-বিরোধী ভাবনা। সেখানকার চরম ডানপন্থি নেতা গ্রিরট ভিলডারকে ‘ডাচ ট্রাম্প’ হিসেবে অভিহীত করা হয়ে থাকে। ২০০৬ সালে গঠিত ভিলডারের ‘পার্টি ফর ফ্রিডম’ এখন দেশটির পার্লামেন্টে দ্বিতীয় প্রধান দল।
আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সারাহ দি লানগে গণমাধ্যমটিকে বলেছেন, ‘ডাচ রাজনীতিতে গ্রিরট ভিলডার বেশ প্রভাবশালী। অনেকেই হয়তো তার মৃত্যু কামনা করে থাকেন তবে তার অনেক অনুসারী রয়েছে।’
এমন চরম ডানপন্থা মনোভাব ইইউয়ের অপর গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ফ্রান্সসহ অস্ট্রিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্রেও রয়েছে বলে প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে।
মিলানের বুক্কুনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ক্যাথেরিন দি ভ্রি বলেছেন, ‘এসব চরম ডানপন্থি দলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেলে মূলধারার দলগুলো সুবিধা পাবে। কিন্তু, এখন দেখা যাচ্ছে মূলধারার দলগুলোও ভোট পেতে চরম ডানপন্থা অবলম্বন করছে। তারা এমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে ইইউ গতি হারাবে।’
যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ঐক্য ধরে না রাখতে পারলে ২০২০ সালের মতো ২০২১ সালও ইউরোপের জন্যে দুঃস্বপ্ন বয়ে আনতে পারে বলে প্রতিবেদনটিতে মন্তব্য করা হয়েছে।
Comments