আর্থিক হিসাবের বাইরে থাকবেন না একজনও
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/nagad.jpg?itok=pkuVEvKi×tamp=1609658899)
‘চাহিদামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’— লাইনটির সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি দেশে এমন একজন বয়োপ্রাপ্ত মানুষকে কি পাওয়া যাবে? আমি জানি না এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ আসবে কিনা? তবে বদলে যাওয়ার যে সময় শুরু হয়েছে তাতে এই লাইনটিকে নতুন করে লেখার মতো অবস্থায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখি আমরা।
‘চাহিবামাত্র’ যেন ওয়ালেটের পেমেন্টে পণ্য ও সেবা পাওয়া যায়— এমন স্বপ্নযাত্রার শুরু বাংলাদেশের ভালোই হয়েছে। আমরা এখন এটিকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে চাই। চাইলেই যেমন ওয়ালেটের টাকা খরচ করে যেকোনো জিনিস কেনা যায়, তেমনি চাইলেই যেন যে কেউ আর্থিক হিসাবের মধ্যে আসতে পারেন এবং ডিজিটাল কারেন্সি ব্যবহার করে যেকোনো পণ্য ও সেবা পেতে পারেন— সেটিও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
অন্তত দেশের উন্নয়নের জন্যে যা করতে হবে তা হলো: শুধু কাগুজে টাকা নয় বরং ডিজিটাল কারেন্সি ব্যবহারের জন্যে মুহূর্তেই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারা। সেটি ব্যবহার করে পণ্য ও সেবা কিনতে পারার মতো অবস্থায় আমাদেরকে যেতেই হবে।
কিছুদিন আগেও এমন সব লাইনকে দূরবর্তী কল্পনা বলে মনে হলেও এখন সময় বদলে গেছে। বদলে যাওয়া সময়ের ওপর ভর করেই হয়তো জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে— একজনও আর আর্থিক হিসাবের বাইরে থাকবেন না।
এমন কথা বলছি, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আর্থিক অন্তর্ভূক্তির প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে। সম্প্রতি, আমরা ‘নগদ’ থেকে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সঙ্গে মিলে এমন একটি উদ্ভাবন নিয়ে এসেছি যে, যেখানে যে কেউ যে কোনো সময়, যেকোনো জায়গা থেকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন শুরু করতে পারবেন।
কিভাবে সেটা করছি তা বলার আগে বলে নিই, এদেশে এখন আর্থিক অন্তর্ভূক্তি কী অবস্থায় আছে। কয়েক বছর আগেও বলা হচ্ছিল শুধু ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিক হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত আছেন দেশের ২২ শতাংশ মানুষ। হিসাবটি ছিল কেবল ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অংকের ভিত্তিতে। পরে কয়েক বছরের মধ্যে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অপারেটররা মিলে সেটিকে ৩৩ শতাংশে উন্নীত করেছেন। আর এখন গত দুই বছরের প্রচেষ্টায় সেটি ৫০ শতাংশের কাছাকাছি গেছে বলে হিসাববিদেরা ধারণা দিচ্ছেন।
এই তথ্যের অর্থ হলো দেশের মাত্র অর্ধেক মানুষের আর্থিক হিসাব কোনো না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে আছে। বাকিরা হয় টাকা রাখছেন বালিশের নিচে, নয় তো সিন্দুকের মধ্যে।
আমরা যেটা বুঝি সেটা হলো: দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্যে বালিশ আর সিন্দুক অথবা পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় ধানের গোলার মধ্যে রাখা টাকাকে প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে আনতে পারলে তা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগবে। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশের দিকে এগোতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু, সমস্যা হলো— দেশের অর্ধেক জনগণ যেখানে পড়ালেখা জানেন না তাদেরকে ব্যাংকে টেনে আনা প্রায় অসম্ভব কাজ। তাছাড়া ব্যাংকের হিসাব খুলতে যে আট-দশ পাতার ফর্ম পূরণ করতে হয় এবং সঙ্গে যেসব কাগজপত্র দিতে হয় তা তাদের মধ্যে অনাগ্রহ সৃষ্টি করে।
বিকল্প হতে পারে মোবাইলের মাধ্যমে পাওয়া ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস। কিন্তু, এই তো মাত্র কয়েকদিন আগেও ব্যাংকের চেয়ে কিছুটা কম হলেও এমএফএস অ্যাকাউন্ট খুলতেও ফর্ম পূরণ, ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এটাও কম ঝামেলার নয়। এর মাধ্যমেও সব গ্রাহককে এ সেবায় নিয়ে আসা যায়নি।
এক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান হতে পারতো ডিজিটাল কেওয়াইসি। কিন্তু, তা নিয়ে তেমন কোনো কাজ দেখা যাচ্ছিল না। ঠিক সেই সময়েই ২০১৯ সালের স্বাধীনতা দিবসের দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ‘নগদ’ এর উদ্বোধন করলেন তখন থেকেই আমরা ডিজিটাল কেওয়াইসি চালু করি— যেটি আমাদেরই উদ্ভাবন। ওই প্রক্রিয়ায় কেবল নিজের সেলফি তোলা ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের দুই দিকের ছবি তুলে অ্যাপের মাধ্যমে পাঠালেই অ্যাকাউন্ট খোলার কাজ হয়ে যায়।
প্রথম দিকে, এ নিয়ে নানা কথা হয়েছে। তবে আমরা সৌভাগ্যবান যে বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় এ বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছে, পরামর্শ দিয়েছে ও সাহস জুগিয়েছে।
এখন অন্যরা, এমনকি যারা প্রশ্ন তুলেছিলেন তারাও ডিজিটাল কেওয়াইসি’র এই পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। রক্ষণশীল ব্যাংকগুলোও ডিজিটাল কেওয়াইসি গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়িক খরচ কমিয়ে আনতে পেরেছে। সুতরাং আমরা সবাই মিলে এক্ষেত্রে একটি অর্জনই করেছি বলতে হবে।
ডিজিটাল উদ্ভাবনের ধাপটি উন্নয়ন করতে গিয়ে আমরা দেখলাম এই সেবা কেবল তারাই গ্রহণ করছেন যারা ইন্টারনেটে সংযুক্ত আছেন। তখন আমাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় এমন কোনো উদ্ভাবন নিয়ে আসা যার মাধ্যমে গ্রামের অশিক্ষিত কৃষক বা দূরপ্রান্তের গৃহবধূও তার মোবাইল ফোনের কয়েকটা বাটন চেপে অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলতে পারবেন।
তাছাড়া, আবার যারা ইন্টারনেটে সংযুক্ত আছেন তাদের জন্যেও অ্যাকাউন্ট খোলাটাকে আরও সহজ করার কাজ শুরু করেন স্থানীয় তরুণ ইঞ্জিনিয়াররা।
তরুণ প্রযুক্তিবিদরা রাতদিন কাজ করে যে উদ্ভাবন দিয়েছেন তাতে সত্যিই বিমুগ্ধতা ছড়ায়।
কেউ কি ভাবতে পেরেছেন যে মোবাইল ফোন থেকে কেবল *১৬৭# ডায়াল করলেই হবে। তারপর চার ডিজিটের পিন সেট করবেন তো সব কাজ শেষ।
যারা ইন্টারনেটে যুক্ত তারা ‘নগদ’ অ্যাপ ডাউনলোড করে নিজের মোবাইল নম্বরটি দিলে যে এসএমএস আসবে সেখানে চার ডিজিটের পিন সেট করলেই হয়ে যাবে অ্যাকাউন্ট।
এক মুহূর্তের মধ্যে মোবাইল অপারেটরদের কাছে থাকা গ্রাহক তথ্য মেলানো ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজ থেকে ভ্যারিফিকেশনও হয়ে যাবে।
বছরের শুরুর দিকে প্রথমে টেলিটক, তারপর রবি-এয়ারটেল আর গত কয়েকদিন থেকে গ্রামীণফোনের গ্রাহকরা পাচ্ছেন এই সুবিধা। যাদের ‘নগদ’ অ্যাকাউন্ট নেই তারা হাতের মোবাইল ফোনটিতে মাত্র কয়েকবার স্পর্শ করেই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। সব মিলে ব্যাপক সাড়া মিলছে।
সময় বোধ হয় এসেই গেছে যখন বলা যাবে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবার অ্যাকাউন্ট খোলা এখন দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজগুলোর একটি।
জানিয়ে রাখছি, বাংলালিংকের গ্রাহকরা খুব সহসাই এমন একই সুবিধার মধ্যে চলে আসবেন। তাহলে কী দাঁড়াল? কার্যকর মোবাইল সংযোগ থাকলেই টাকা লেনদেন আর কোনো ব্যাপারই না। জীবনটাকে বদলে দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যাবে। একের পর এক ডিজিটাল সেবা গ্রহণ করা যাবে মোবাইল ফোনেই।
আমরা বিশ্বাস করি, একজন উদ্ভাবন করবেন আর তার ফল পাবেন সবাই। আজ আমরা যে উদ্ভাবন নিয়ে এসেছি তা পুরো দেশের আর্থিকখাতের ওপর অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যেভাবে ডিজিটাল কেওয়াইসি’র উদ্ভাবন সব আর্থিক খাতের ব্যবসায়িক খরচ কমিয়েছে, একইভাবে এই উদ্ভাবনও সবার কাজে দেবে।
এখানে একটু বলে রাখতে চাই— ‘নগদ’ এর এই উদ্ভাবন আমাদেরকে একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার এনে দিয়েছে।
আরও একটি ব্যাখ্যাও দিয়ে রাখতে চাই— সেবাটিতে তৈরি করতে গিয়ে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সঙ্গে যে পার্টনারশিপ হয়েছে তাতে ‘নগদ’ তাদের কাছ থেকে কেবল গ্রাহকের নাম, জন্ম তারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর আর ঠিকানা ছাড়া অন্য কিছুই পাবে না।
জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ধরে সেটি আবার নির্বাচন কমিশনের ডেটাবেজে ভ্যারিফাই করা হবে যে নাম, জন্ম তারিখ ও ঠিকানা অপারেটর দিয়েছে সেটি সঠিক কিনা। পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটবে মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে। তাছাড়া পুরো প্রক্রিয়াতে সরকারের অনুমোদন ও কর্তৃপক্ষের যাচাইয়ের সুযোগও রয়েছে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। আর্থিক খাতের ডিজিটালাইজেশনকে যখন ডিজিটালাইজেশনের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তখন তো বলতে গেলে সময়ের আগেই ‘নগদ’কে নিয়ে আমরা সেই লক্ষ্য বিন্দুটাকে ছুঁয়ে দিলাম।
এবার ‘চাহিবামাত্র’ ডিজিটাল পেমেন্ট করার পালা।
তানভীর এ মিশুক: ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments