‘কবরে মানুষ যেভাবে থাকে, সেভাবে ছিলাম’

৫৩ দিন গুম ও সাত মাস কারাগারে থাকার পরে অবশেষে ফটো সাংবাদিক সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল এখন বাড়িতে। সেই ভয়াবহ দিনগুলো নিয়ে আলাপ করেছেন দ্য ডেইলি স্টার প্রতিবেদক জায়মা ইসলামের সঙ্গে।

প্রায় নয় মাসের না-কামানো কাঁচাপাকা দাড়ি গাল বেয়ে নেমে গেছে কাজলের। দাঁড়িতে হাত বোলাতে-বোলাতে মৃদু হেসে বললেন, ‘ভাবছি দাড়িটা শেভ করব না। দাড়িটা ভালোই লাগছে। কিছুটা ছেঁটে নিয়েছি শুধু।’

‘কিন্তু যে নাপিতের কাছে কাটাতাম...তাকে খুঁজে পেলাম না। নতুন একজনের কাছে যেতে হলো,’ বললেন কাজল...এই কথায় মনে করিয়ে দিলেন যে তার জীবন থেকে ৯ মাস কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

কাজল গত বছর ১০ মার্চ নিখোঁজ হন। এর ৫৩ দিন পর বেনাপোল সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ তাকে সেখানে ‘ঘোরাফেরা’ করতে দেখতে পায়।

এরপর একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর ও যুব মহিলা লীগের দুই কর্মীর করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

সাত মাস নিম্ন আদালত তার জামিন দেননি। হাইকোর্ট গত ২৪ নভেম্বর তাকে একটি মামলায় জামিন দেন এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সাইবার ট্রাইব্যুনালকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।

কাজলের আইনজীবীদের যুক্তি ছিল, এসব মামলার ৭৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হয়। এক্ষেত্রে তদন্তকারীরা ব্যর্থ হয়েছেন। এ বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করা হলে, অবশেষে ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট আরও দুটি মামলায় জামিনের আদেশ দেন।

২৫ ডিসেম্বর কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন কাজল।

কাজল এখন কিছুটা খুঁড়িয়ে হাটেন, রাতে তার সারা শরীর ব্যথা করে। মানসিক সুস্থতার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছেন তিনি। তবে স্বস্তি হচ্ছে অন্তত তিনি বাড়িতে আছেন।

তবে, সেইসব দিনগুলো নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। কিন্তু, উদ্বেগের ব্যাপার হলো কিছু কথা না বলাকে তিনি শ্রেয় মনে করেছেন।

‘কবরে মানুষ যেভাবে থাকে, সেভাবে ছিলাম,’ গুম থাকার দিনগুলো সম্পর্কে বললেন তিনি। ‘খুব ছোট্ট একটা বদ্ধ জায়গা। কোনো জানালা নেই।’

‘আমার চোখ- মুখ বাঁধা ছিল। হাত পেছনে হাতকড়ায় বাঁধা। বেনাপোলে না ছাড়া পর্যন্ত ৫৩ দিন এই অবস্থায় আমি। আমি কেবল দিন গুনতে পেরেছি।’

‘এটা বর্ণনা করার মতো না। কেবল পরিবারের কথা ভেবে দিন পার করেছি। আবার তাদের সঙ্গে দেখা হবে কিনা,’ বললেন তিনি।

‘এক সময় মনে হলো, আমি আর ফিরতে পারব না।’

কারা তাকে এভাবে রেখেছিল, তিনি কোথায় ছিলেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত বললেন না কাজল। অপহরণকারীদের বিষয়ে বা বন্দী থাকার সময়ে কী ধরনের কথাবার্তা হয়েছে জানতে চাইলে কাজল সে সবও জানাতে রাজি হননি।

তিনি কেবল বললেন, ‘প্রচুর সমস্যা। সারারাত পেইন করে আমার শরীর। পেইন তো যশোর ও ঢাকা পর্যন্ত বহন করলাম।’

তার সঙ্গে যা যা হয়েছে, তা নিয়ে পুরো প্রশাসনকে দোষারোপ করার বিষয়ে তিনি সতর্ক করেন।

বললেন, ‘আমি সম্ভবত ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার শিকার। সরকারের ছোট্ট একটা অংশের কিছু লোকের ষড়যন্ত্র। এর জন্য পুরো প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা অন্য কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। দোষ কেবল কয়েকজন লোকের, যারা এটা সাজিয়েছে। আমি বলব যে তদন্তকারীরা তাদেরকে খুঁজে বের করুক।’

অবরুদ্ধ ৫৩ দিন

কাজল জানান, তাকে বাংলা একাডেমির সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

‘আমি একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলাম। সেখানে আমি প্রায়ই সন্ধ্যাতেই যাই,’ তিনি বলেন।

বাংলা একাডেমির সামনে সাদা পোশাকে একদল বাইকার তাকে ঘিরে ফেলে জানিয়ে কাজল বলেন, ‘প্রায় ১০ মিনিট পর দুটি ছোট ভ্যান দেখতে পাই। তখন আমার চোখ আর মুখ বেঁধে ফেলা হলো।’

তবে, কেউ কোনো মুক্তিপণ দাবি করে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।

এরপর, একদিন কাজলকে আবার একটি গাড়িতে করে বেনাপোলের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সে দিন পর্যন্ত মোট ৫৩ দিন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তিনি বিচ্ছিন্ন ছিলেন।

বেনাপোল যেতে কত সময় লেগেছে জানতে চাইলে তিনি জানান পুরোটা সময় চোখ বাঁধা ছিল, তাই বলতে পারছেন না।

তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে সতর্ক করে যেন কাউকে কিছু না বলি, বলে ভ্যান থেকে নামিয়ে দেয়। আমি কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করি। পরে বিজিবি আমাকে খুঁজে পায়।’

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের রঘুনাথপুর ইউনিটের দাবি, তারা ৩ মে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাদিপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামে একটি ধানের জমিতে কাজলকে দেখতে পায়। যেখানে তাকে পাওয়া যায়, সে জায়গাটি সীমান্তের খুব কাছে এবং বেনাপোল স্থলবন্দর সংলগ্ন।

অপহরণকারীরা কেন তাকে ছেড়ে দিয়েছে এবং কেন তারা বেনাপোলকে বেছে নেয়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেন আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়, সত্যিই আমি জানি না। আমার ধারণা, তারা আমাকে সীমান্তের বাইরে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল।’

এখানেই তার মুক্তি হয়নি। কারণ, তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় পরের সাত মাস কারাগারে থাকতে হয়।

মামলার নয় মাস পরও এর তদন্ত শেষ হয়নি। যদিও, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার তদন্ত ৬০ দিনের মধ্যে শেষ করার বাধ্যবাধকতা আছে। প্রয়োজনে আরও ১৫ দিন বাড়ানো যেতে পারে।

কাজলকে যেদিন পাওয়া যায়, সেদিনই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক ফেসবুক পোস্টের জন্য ১৩ বার তার জামিন আবেদন খারিজ হয়।

৩ মে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠালেও, ১৪ জুন ভার্চুয়াল আদালত জানতে পারেন যে কাজলকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় আনুষ্ঠানিকভাবে তখনও ‘গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি’, এর মধ্যে যদিও তিন বার তার জামিন আবেদন খারিজ হয়।

‘আমার কী দোষ ছিল যে আমাকে প্রায় পুরো বছর বছর ধরে জামিন দেওয়া হয়নি,’ প্রশ্ন ফটো সাংবাদিক সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের।

৭ মাস কারাবাস

৫৩ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর কাজলের স্থান হয় কারাগারে। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও, সেখানে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়।

তিনি বলেন, ‘যশোর কারাগারটি ভালই ছিল। তারা মানবিক। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার একেবারেই উল্টো।’

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাকে ‘গণরুমে’ রাখা হয়। যারা জায়গা ও খাবারের জন্য টাকা দিতে পারে না, তাদের জায়গা হয় সেখানে। বন্দীদের পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে হয়।

কাজল বলেন, ‘অনেক বন্দী আছে যাদের জন্য রেস্তোরাঁ থেকে খাবার আসে। আর, আমি আমার ছেলেকে একবারও দেখতে পেলাম না।’

কাজল জানান, কারাগারে তার ফোন কলগুলো নজরদারি করা হয়। ‘আমাকে এক বা দুই মিনিটের জন্য কথা বলতে অনুমতি দেওয়া হতো। জেল কর্মকর্তার সামনেই কথা বলতে হতো।’

মুক্তির অপেক্ষায় থাকা কাজল পরিবারের ভাবনা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে কারাগারের লাইব্রেরিতে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। ভাবনায় অবশ্য সারাক্ষণ পরিবারই ছিল। ক্যান্সার থেকে বেঁচে ফেরা স্ত্রী, ২০ বছর বয়সী ছেলে ও স্কুল পড়ুয়া মেয়ে। তাদের অন্ন সংস্থানকারী পরিবারের কর্তা কারাগার বন্দী।

তিনি বলেন, ‘ফোনে আমি ছেলেকে বাড়ির খরচের জন্য টাকা আছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করার সাহস পাইনি। আমি কেবল জানতে চাইতাম, এ মাসে বাসা ভাড়া দেওয়ার টাকা আছে কিনা।’

আপাতত কাজল বিশ্রাম নিতে চান। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে চান। কাজল বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমি আবার কাজে ফিরে যেতে চাই।’

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago