তামাক খেতের শিশু!
লালমনিরহাটে শিশুদের দিয়ে তামাক খেতে কাজ করানোটা এখন নিয়মিত দৃশ্য হয়ে উঠেছে। অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণেই শিশুরা তামাক খেতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। লালমনিরহাট জেলা শিশু নেটওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী, তামাক মৌসুমে পুরো জেলায় প্রায় ১৫ হাজার শিশু তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকে।
স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী মরিয়ম খাতুন (৭)। তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানার আগেই বাবা-মায়ের উদাসীনতার কারণে তামাকের সঙ্গে মিশে যেতে হচ্ছে তাকে। সে বাবা-মায়ের সঙ্গে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তামাক খেতে কাজ করে।
তামাক গাছে সার মিশ্রিত পানি দেওয়া আর খেতের মাটি সমান করতে সময় কাটছে তার। আর কিছুদিন পর মরিয়মকে ভাঙতে হবে তামাকপাতা। এরপর তামাকপাতা শুকানোর কাজও তাকে করতে হবে। এ দৃশ্য শুধু লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার জামুরটারী গ্রামের শিশু মরিয়মের নয়। শিশুদের তামাক খেতে কাজ করার এমন দৃশ্য এখন গ্রামে গ্রামে।
জামুরটারীর পাশে ভাদাই গ্রামে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মাইদুল ইসলাম (৮) তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করছে তামাক খেতে। শিশুটি ক্লান্ত হয়ে পড়লেও কাজ করতে হয়।
মহিদুল বলে, ‘কাজ করতে করতে আমি ক্লান্ত হই। বাবা আমাকে দিয়ে সবসময় কাজ করান।’
মরিয়ম খাতুন বলে, ‘বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করে ভালো লাগে। তামাক খেতে কাজ করলে কি আর ক্ষতি হবে।’
মরিয়মের বাবা মিলন ইসলাম (৩০) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তামাকের খেতে কাজ করা একটি পারিবারিক কাজ। পরিবারের সবাইকে নিয়ে কাজ করা হয়। তাহলে তামাক চাষে আশানুরূপ আয় হয়। একজন শ্রমিক নিলে চারশ টাকা খরচ হবে। কিন্তু, মেয়েকে দিয়ে সে কাজ হচ্ছে।’
তিনি এ বছর ১০ বিঘা জমিতে তামাকের চাষ করেছেন। গত বছরও সমপরিমাণ জমিতে তামাকের চাষ করেছিলেন বলে জানান।
মরিয়মের মা জাহানারা বেগম বলেন, ‘তামাকের জমিতে কাজ করলে কোনো ক্ষতি হয় না। বরং পরিবারের সবাই কাজ করলে শ্রমিক খরচ বাঁচে।’
স্কুল শিক্ষার্থী মাইদুল ইসলামের বাবা নজরুল ইসলাম (৪৫) বলেন, ‘কৃষক পরিবারের সন্তানকে কৃষি কাজ করতে হয়। কৃষি কাজে কখনো না বলতে নেই। তামাকের কাজ পরিবারের সবাই মিলে করলে পোষাবে। গ্রামে এখন শিশু-বৃদ্ধ সবাই তামাকের কাজ করছে। তামাকপাতা বিক্রি না করা পযর্ন্ত আমাদের তামাকের কাজ করতে হয়।’
‘আমি এবার আট বিঘা জমিতে তামাকের চাষ করেছি। গতবছরও আট বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছিলাম,’ তিনি বলেন।
তামাক কোম্পানির সহায়তায় তিনি তামাকের চাষ করছেন বলেও জানান।
লালমনিরহাট জেলা শিশু নেটওয়ার্কের সভাপতি মৃদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘শিশুদের দিয়ে তামাকের কাজ করানোটা এ জেলার একটি প্রতিদিনের দৃশ্য। অভিভাবকরা কোনোভাবেই বুঝতে চাচ্ছেন না, তামাকের কাজ করলে শিশুর স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার চরম ক্ষতি হতে পারে। তামাক মৌসুমে পুরো জেলায় প্রায় ১৫ হাজার শিশু তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকে। বিভিন্ন তামাক কোম্পানির প্রলোভনে প্রলুদ্ধ হয়ে চাষিরা তামাক চাষ করছেন। আর তাদের অসচেতনতায় শিশুদের তামাক খেতে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।’
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শামীম আশরাফ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ বছর জেলায় কী পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ হয়েছে তা মাঠ পর্যায়ে নিরুপণ চলছে। তবে, গত বছর ৮০ হাজার বিঘার চেয়ে এ বছর কম জমিতে তামাক চাষ হয়েছে বলে আমার ধারণা। তামাক চাষ থেকে কৃষকদের ফিরিয়ে আনতে কৃষি বিভাগ থেকে সচেতনতামূলক প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে।’
লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শিশুরা তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে তারা শারিরীক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তামাকের নিকোটিনের কারণে শিশুদের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তামাক চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে তামাক কোম্পানিগুলো যাতে সক্রিয় ভুমিকা না রাখে সেজন্য কৃষি বিভাগকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগের চেয়ে তামাক চাষ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। শিশুরা যেন তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়ার কাজে জড়িয়ে না যায় সেজন্য অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে এবং স্থানীয পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।’
Comments