নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ সিএজি’র

সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন এবং উপজেলা নির্বাচনে অনেক প্রশিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ব্যয়ে আর্থিক অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল- সিএজি)।
ec logo

সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন এবং উপজেলা নির্বাচনে অনেক প্রশিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ব্যয়ে আর্থিক অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল- সিএজি)।

গত ৩ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনের একটি বৈঠকের কার্যপত্র অনুযায়ী, অডিট আপত্তি উত্থাপন করে সিএজি বলছে, নির্বাচন কমিশন ‘বিশেষ বক্তা’ এবং ‘প্রশিক্ষণ উপদেষ্টা’সহ বিভিন্ন পদের বিপরীতে যে সরকারি ভাতা দিয়েছে সেসব পদ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত না।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় নির্বাচন এবং ২০১৯ সালের মার্চ ও জুনে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে কর্মকর্তাদের জন্য এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করে নির্বাচন কমিশনের ইলেক্টোরাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (ইটিআই)।

দেশের সর্বোচ্চ নিরীক্ষা সংস্থা এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সিএজির স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর এই প্রশিক্ষণ কর্মশালাগুলোতে খরচ করা সাত কোটি টাকারও বেশি অর্থের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছেন। এমনটিই দেখা যায় নির্বাচন কমিশনের একটি নথি থেকে।

এর মধ্যে দেশব্যাপী নির্বাচনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ‘বিশেষ বক্তা’ ও ‘প্রশিক্ষণ উপদেষ্টা’র মতো ‘অননুমোদিত’ পদে যারা ছিলেন তাদের দেড় কোটি টাকা ভাতা দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে অডিটে। নির্বাচন কমিশনের নথি থেকে জানা যায়, একই কারণে রাজধানীর ইটিআই প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ব্যয় করা ৪৭ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে অডিটে।

ইটিআই কর্মকর্তারা বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে অংশ নেন।

কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন সচিব ‘প্রশিক্ষণ উপদেষ্টা’ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং সচিব ও ইটিআই মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন ‘প্রশিক্ষণ পরিচালক’ হিসেবে।

সিএজির অডিট আপত্তিপত্র অনুযায়ী, ‘একই ব্যক্তি, একই তারিখে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একাধিক সম্মানী গ্রহণ করেছেন।’

নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, এ ধরনের অডিট আপত্তি উত্থাপনের কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশন যেহেতু কোনো মন্ত্রণালয় বা সরকারি বিভাগের আওতাধীন নয়, তাই কোনো ‘বিশেষ বক্তা’ বা ‘প্রশিক্ষণ উপদেষ্টা’কে সম্মানী প্রদানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই।

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিশেষ বক্তা, প্রশিক্ষণ উপদেষ্টা এবং প্রশিক্ষণ পরিচালকের মতো পদগুলোর অনুমোদন দিয়েছিল কমিশন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন-২০০৯ অনুসারে কমিশন নিজেই বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা (সিএজি) আমাদের কাছে এর জবাব চেয়েছে কিংবা অর্থ ফেরত দিতে বলেছে। আমরা জবাব প্রস্তুত করছি। ইতোমধ্যে আমরা থানা, জেলা পর্যায়ে নির্বাচন কমিশন অফিস এবং ইটিআই-এ চিঠি দিয়ে তাদের জবাব চেয়েছি।’

‘তাদের মধ্যে কয়েকজন ইতোমধ্যে জবাব দিয়েছে এবং কমিশন তাদের অনুমোদন দিয়েছে। … আমরা এ সপ্তাহে এই জবাব (সিএজির কাছে) পাঠাবো,’ যোগ করেন তিনি।

অডিট আপত্তি

সিএজি অভিযোগ করেছে, প্রশিক্ষণ পরিচালকরা সারাদেশে প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে অংশ নেওয়ার সময় তাদের জন্য নির্ধারিত হারের থেকে অধিক হারে ভাতা নিয়েছেন।

নির্বাচন কমিশনের নথি অনুযায়ী, কিছু ক্ষেত্রে ‘বিশেষ বক্তা’, ‘প্রশিক্ষণ উপদেষ্টা’ এবং অন্যদের উপস্থিতির কোনো প্রমাণ না দেখিয়েই প্রশিক্ষণ ভাতা সংগ্রহ করা হয়েছে। ‘প্রশিক্ষণ পরিচালক’রা ইটিআই প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির জন্য তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ভাতার চেয়ে বেশি সংগ্রহ করেছেন।

অডিট আপত্তিপত্র অনুসারে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং ইটিআই মহাপরিচালকের ভাতা আদায়ের বিষয়েও আপত্তি তোলে সিএজি।

এতে বলা হয়েছে, ইটিআই প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণে অননুমোদিত ‘প্রশিক্ষণ উপদেষ্টা’কে প্রশিক্ষণ ভাতা প্রদান করায় সরকারের ১৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও অননুমোদিত ‘বিশেষ বক্তা’দের ভাতা প্রদান করায় সরকারকে ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে এতে উল্লেখ্য করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রশিক্ষণ পরিচালক’রা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ভাতার চেয়ে ১৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা বেশি আদায় করেছেন।

নির্বাচন কমিশনের সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ‘অডিট আপত্তিগুলো এখনও মীমাংসিত হয়নি।’

ইটিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিএজি গত বছরের মার্চ মাসে অডিট আপত্তি তুলেছিল। যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে ইটিআই কর্মকর্তারা এর জবাব দিয়েছিলেন। তবে সিএজি কর্মকর্তারা তাদের জবাব মেনে নেননি। তারপর, আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সিএজি এবং ইটিআই কর্মকর্তারা একটি বৈঠক করেন, যা ‘এক্সিট মিটিং’ নামে পরিচিত।

সিএজি কর্মকর্তারা এক্সিট মিটিংয়েও ইটিআইয়ের জবাব গ্রহণ করেনি এবং ইটিআই কর্মকর্তাদের অর্থ ফেরত দিতে বলেন। বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশন, সিএজি এবং ইটিআই কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হবে।

সমস্যা সমাধানে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকটি ব্যর্থ হলে বিষয়টি সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে পাঠানো হবে বলে জানান ইটিআই কর্মকর্তারা।

ইটিআইয়ের মহাপরিচালক নুরুজ্জামান তালুকদার সিএজি অডিটের আপত্তি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন প্রশিক্ষণের জন্য ৫৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এছাড়াও উপজেলা নির্বাচনের প্রশিক্ষণের জন্য আরও ৫৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে ‘বিশেষ বক্তা’দের ভাতা বাবদ জাতীয় নির্বাচনের আগে বরাদ্দ ছিল এক কোটি চার লাখ টাকা এবং উপজেলা নির্বাচনের আগে বরাদ্দ ছিল ৪৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

বিশেষ ভাতা নিয়ে বিতর্ক

অডিট আপত্তিটি এমন সময় সামনে এসেছে যখন দেশের ৪২ নাগরিক এবং বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন অনিয়মের সমালোচনা করছে।

নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের আহ্বান জানিয়ে গত বছর ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দেন ৪২ নাগরিক।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে দেওয়া একটি চিঠিতে তারা দাবি করেন, কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন সদস্যরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনের আগে প্রশিক্ষণে ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে বক্তব্য দেওয়ার জন্য দুই কোটি টাকা নেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের জন্য জড়িত।

এর প্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা বলেন, বিশেষ বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার নামে দুই কোটি টাকার মতো ‘আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম’ মর্মে অভিযোগটি অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে। যা ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

তিনি বলেন, বিশেষ বক্তাদের জন্য একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বরাদ্দ ছিল এক কোটি চার লাখ টাকা এবং পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে বরাদ্দ ছিল ৪৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

তিনি আরও বলেন, সকল ব্যয় অডিট যোগ্য। অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি না হলে ব্যয়কৃত অর্থ কোষাগারে ফেরত যাবে। সেক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

5h ago