টাকার অতিমূল্যায়ন ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেকর্ড সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার ক্রয়
মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক রেকর্ড পাঁচ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার কিনেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল।
রেমিট্যান্সের উচ্চপ্রবাহ ও আমদানি কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের ছয় মাসেই ডলার ক্রয়ের আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদ্যোগ রপ্তানিকারকদের সহায়তা করলেও, এতে আর্থিক খাতে দেখা দিয়েছে অতিরিক্ত তারল্যের চাপ। করোনা মহামারির কারণে ব্যবসায়িক মন্দা থাকায় কমে গেছে ঋণের চাহিদা। ফলে, ব্যাংকে অলস টাকার পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় এ পরিমাণ ২০২ শতাংশ বেশি।
প্রচুর ডলার ক্রয় সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য নির্ধারণে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মূল্য কমায় জুলাই থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে হস্তক্ষেপ করা শুরু করে।
জুলাই থেকে প্রতি মার্কিন ডলারের আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার প্রায় ৮৪ দশমিক ৮০ টাকায় দাঁড়ায়। করোনার সংক্রমণে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণার একদিন আগে ২৫ মার্চ এই হার ছিল ৮৪ দশমিক ৯৫ টাকা।
তবে, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ যথেষ্ট ছিল না। যেমন: ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ১১ জানুয়ারি প্রতি ডলারের তুলনায় ভারতীয় রুপির বিনিময় মূল্য ছিল ৭৩ দশমিক ১২, যা গত বছরের ১ জানুয়ারি ছিল ৭১ দশমিক ৩৭ রুপি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মহামারির আগে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে এখন আমরা কিছু সুবিধা পেতাম।’
সম্প্রতি অনেক দেশ তাদের মুদ্রার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবমূল্যায়ন করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ জব্বার বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এখন টাকার অবমূল্যায়ন করতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক উভয়েরই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখারও প্রস্তাব করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে সময়ে সময়ে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হয়। সুতরাং, আমাদের উচিত এখন বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে দেখা।’
সামনে ডলারের মানের আরও অবনতি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে।
গত ৮ জানুয়ারি ফিনান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর মার্কিন ডলারের দাম সাত শতাংশ কমেছে। আগামী পাঁচ বছরে প্রতি ডলারের মূল্য ১৫ থেকে ২০ শতাংশ নেমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী চলাচলের সীমাবদ্ধতা কমে আসায় সামনের মাসগুলোতে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ অব্যাহত থাকবে বলেও আশা করা হচ্ছে। প্রবাসীরা এখন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে শুরু করেছেন।
গত বছরের রেমিট্যান্স এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, যা তার আগের বছরের তুলনায় ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি।
যদিও টাকার মান স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনে ঠিক কাজই করছে। তবুও, এতে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য তৈরি হয়েছে বলে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক মনে করছেন।
তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অপেক্ষা করছে আর দেখছে।’
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা অর্থনীতির জন্য বেশ ভালো।’
গত বছরের ডিসেম্বরে দেশের রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। এর এক বছর আগে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।
আরফান আলী বলেন, ‘অর্থনীতি আগের অবস্থায় ফিরে আসলে রিজার্ভের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাবে। রপ্তানি ও আমদানি, উভয় ক্ষেত্রেই এটা সহায়তা করবে।’
চলতি অর্থবছরে প্রথম পাঁচ মাসে দেশের রপ্তানি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ, যার মূল্য ১৫ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। আর এ সময়ে আমদানি হয়েছে ২০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার, যা কমেছে প্রায় আট দশমিক ৮৪ শতাংশ।
Comments