চট্টগ্রাম কাস্টমসে শুল্ক ফাঁকি যেন ওপেন সিক্রেট

ফাইল ছবি

গত বছরের ২৯ নভেম্বর চার প্রবাসফেরত বাংলাদেশি বিমানের একটি ফ্লাইটে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন। ইউ-ব্যাগেজের আওতায় তাদের নামে দুই হাজার ৫০০ কেজি বিভিন্ন ব্যবহৃত জিনিস চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা হয়েছিল। এসব পণ্য চারটি পৃথক চালানে খালাসের সময় দেখানো হয়েছে মাত্র এক হাজার ২০০ কেজি। অভিযোগ উঠেছে, কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহায়তায় এসব পণ্য খালাসের সঙ্গে জড়িত সিএন্ডএফ এজেন্ট বাকি এক হাজার ৩০০ কেজি পণ্যের কোনো শুল্ক না দিয়েই খালাস করে নেন।

প্রবাসীদের দেওয়া সুবিধার অপব্যবহার করে এভাবেই ইউ-ব্যাগেজের নামে আসা চালানের অর্ধেকের বেশী পণ্য গোপনে সরিয়ে নিচ্ছে কাস্টমের একটি চক্র।

যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা-২০১৬ এর আওতায় প্রবাসীরা দেশে আসার সময় তাদের ব্যবহৃত পণ্য নিজ নামে কনটেইনারে করে নামমাত্র শুল্কে নিয়ে আসতে পারেন। এ বিধিমালার আওতায় প্রবাসীরা মোবাইল, ল্যাপটপ এবং প্রিন্টারসহ ২৬ ধরণের পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধার পাশাপাশি নামমাত্র শুল্কে পাঁচ হাজার ডলার সমপরিমাণ পণ্যও আনতে পারে।

ইউ-ব্যাগেজ চালানে অনিয়ম

একই রকমের অনিয়ম হয়েছে এমন ৮০টি চালানের নথি দ্য ডেইলি স্টারের কাছে রয়েছে। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৮০টি চালানে মাস্টার বিল অব এন্ট্রি (বিএল) এ ৫৩ হাজার কেজি পণ্য দেখানো হলেও খালাস পর্যায়ে দেওয়া নথিতে (হাউজ বিএল) দেখানো হয়েছে ২৫ হাজার কেজি পণ্য। এসব চালান বন্দর থেকে গত বছরের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে তিনটি সিএন্ডএফ এজেন্ট-নাহার ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, স্প্রেড লিংক এবং আমিন ব্রাদার্স খালাস করেছে। আর এসব চালানে অনিয়ম করা হয়েছে জেনেও কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মাহবুব হাসান খালাসের ছাড়পত্র দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সিএন্ডএফ এজেন্টের স্বত্বাধিকারী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘একবছর আগে যুগ্ম কমিশনার মাহবুব দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ইউ-ব্যাগেজের চালানে অনিয়ম শুরু হয়েছে। প্রতিটি চালানে ওজন কমানোর জন্য বড় অংকের ঘুষের পাশাপাশি ৩৫ হাজার টাকা “স্পিড মানি” (চালানে অনিয়ম না থাকলেও নির্ধারিত পরিমাণ ঘুষকে স্পিড মানি বলে) দিতে হয়। তাছাড়া ওজন কমিয়ে দেখানোর জন্য প্রতি চালানে এক লাখ টাকার বেশি ঘুষ দিতে হতো। মূলত এসব কারণে কিছু অসাধু সিএন্ডএফ এ সুযোগে অতিরিক্ত পণ্য খালাস করেছে।’

গত ১৫ ডিসেম্বর শেখ সালাউদ্দিন নামে এক আমদানিকারক লিখিত অভিযোগে বলেন, ‘গত একবছরে ইউ-ব্যাগেজের নামে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে খালাস নেওয়া প্রায় দুই হাজার ৫০০ চালানেই অনিয়ম হয়েছে। ঘোষিত ওজনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী পণ্য আমদানি করার পাশাপাশি আমদানি নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত পণ্য যেমন, ওষুধ, সিগারেটসহ বিভিন্ন পণ্য খালাস হয়েছে। এতে যুগ্ম কমিশনার মাহবুব হাসান প্রতি চালানে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়েছেন। ঘুষ লেনদেনে সহায়তা করেন তার অফিস সহকারী মো. দাউদ, সিএন্ডএফ এজেন্ট নাহার ট্রেডিংয়ের রিন্টু ও আমিন ব্রাদার্সের ফজলু।’

লিখিত অভিযোগে তার বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে ২৫০টি চালানের নম্বরও সংযুক্ত করেন।

এ ব্যবসায়ীর অভিযোগের সঙ্গে সংযুক্ত করা ২৫০টি চালানের মধ্যে দ্য ডেইলি স্টার চারটি চালানের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। সংগ্রহে থাকা এ চারটি চালানের মধ্যে তিনটি চালানেই অনিয়ম পাওয়া গেছে। অনিয়ম পাওয়া তিনটি মাস্টার বিলের রেফারেন্স নাম্বার হচ্ছে এসএসিকিউ০১২৯৮৪৪, এসএসিকিউ০১২৯৬২৭ এবং এসএসিকিউ০১২৯৬১৩ । এই তিনটি মাস্টার বিলে মোট পাঁচ হাজার ৩০০ কেজি পণ্য থাকলেও খালাসের সময় দেখানো হয়েছে মাত্র দুই হাজার ৫০০ কেজি। বাকি দুই হাজার ৮০০ কেজি পণ্যের তথ্য মাস্টার বিএলে থাকলেও হাউজ বিএলে দেখানো হয়নি। অর্থাৎ এসব পণ্য শুল্ক না দিয়েই বের করে নিয়ে গেছেন খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিএন্ডএফ এজেন্টরা।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে কাস্টমস কমিশনার ফকরুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ইউ-ব্যাগেজের চালানে অনিয়মের অভিযোগ আসার পর খালাসের অপেক্ষায় থাকা সব চালানেই নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। খালাসের অপেক্ষায় থাকা এসব চালানের অধিকাংশেই অনিয়ম পাওয়া গেছে। তবে পূর্বে খালাস নেওয়া চালানে একই ধরণের অনিয়ম হয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখতে দুটি টিমকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন পাওয়ার জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অভিযুক্তদের বক্তব্য

গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে যুগ্ম কমিশনার মাহবুব হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করেন।

অনিয়ম প্রসঙ্গে বলেন, ‘কাগজপত্রে উল্লেখ থাকা পণ্যের তুলনায় কম পণ্য খালাস হওয়ার সুযোগ নেই। তবে কিভাবে এমনটি হয়েছে তা আমার ধারণা নেই।’

প্রবাসীর চালান খালাস নেওয়া নাহার ট্রেডিং লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী আহসানউল্লাহ তালুকদার রিন্টু বলেন, ‘কিছু আমদানিকারক বাণিজ্যিক পণ্য আনতে প্রবাসীদের পাসপোর্ট ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে আমাদের তেমন কোনো ধারণা থাকে না। যদি খালাসের সময় কম পণ্য দেখানো হয়, তা কাস্টমস কর্মকর্তারা দেখার কথা।’

যুগ্ম কমিশনারের সঙ্গে অনিয়মে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ওনার সঙ্গে ব্যবসায়ী হিসেবে যোগাযোগ আছে। তবে এর বাহিরে অন্য কোনো সম্পর্ক নাই। অর্থ লেনদেনে আমি কখনোই কাউকে সহায়তা করিনি।’

সিএন্ডএফ এজেন্ট আমিন ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ফজলু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পণ্য খালাসের জন্য কাস্টমস কর্মকর্তাদের স্পিড মানির নামে ঘুষ দিতে হয়। তবে পণ্য কম দেখিয়ে খালাসের ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন হয়েছে কিনা তা আমি জানি না।’

কাকে স্পিড মানির নামে ঘুষ দিতে হয়েছে তা জানতে চাইলে তিনি পরে জানাবেন বলে জানান। তবে পরবর্তীতে একাধিকবার তার নম্বরে কল ফোন দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

Comments

The Daily Star  | English

Doubts growing about interim govt’s capability to govern: Tarique

"If we observe recent developments, doubts are gradually growing among various sections of people and professionals for various reasons about the interim government's ability to carry out its duties."

1h ago