অবৈধ ইটভাটায় কাঠ পোড়াতে ভ্রাম্যমাণ স’ মিল

কুষ্টিয়া জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়েই চলছে ১৩২টি ইটভাটা। এসব ভাটায় ইট প্রস্তুত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমি। আর ইট পোড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে জ্বালানি কাঠ। ভাটার স্বত্ত্বাধিকারীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে বসিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ স’ মিল। সেখানে বড় বড় গাছের গুড়ি চিরে ফেলা হচ্ছে ভাটায়। সদর উপজেলার বেশ কটি ইটভাটা ঘুরে এই দৃশ্য দেখা গেছে।
ছবি: স্টার

কুষ্টিয়া জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়েই চলছে ১৩২টি ইটভাটা। এসব ভাটায় ইট প্রস্তুত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমি। আর ইট পোড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে জ্বালানি কাঠ। ভাটার স্বত্ত্বাধিকারীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে বসিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ স’ মিল। সেখানে বড় বড় গাছের গুড়ি চিরে ফেলা হচ্ছে ভাটায়। সদর উপজেলার বেশ কটি ইটভাটা ঘুরে এই দৃশ্য দেখা গেছে।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী— ইট পোড়াতে কোনো জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করা যাবে না। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ইটভাটা স্থাপন করার কথা থাকলেও সনাতন পদ্ধতিতেই এখনো ইট প্রস্তুত করা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রায় আট কিলোমিটারের মধ্যে তালবাড়িয়া এলাকায় খয়বার প্রামাণিকের মালিকানাধীন কেবিপি ইটভাটা, সাব্বির রানার মালিকানাধীন আরপিকে, বারখাদায় আলাল উদ্দিনের মালিকানাধীন এনবিসি এবং এসএসবি ইটভাটায় স’ মিল বসানো হয়েছে।

সদর উপজেলার জুগিয়া, বারখাদা উত্তরপাড়া ও চারুলিয়া এলাকায় জেগে ওঠা গড়াই নদীর চর দখল করে বিস্তৃত করা হয়েছে ইটভাটাগুলো। সূত্র জানিয়েছে, এসব খাস জমির সরকারি হিসাব না থাকায় উচ্ছেদে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ভাটাগুলোতে সাংবাদিক প্রবেশে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ক্রেতা পরিচয়ে কেবিপি ইটভাটা ঘুরে দেখা গেছে, ইট পোড়াতে বড় বড় গাছের গুড়ি জড়ো করা হয়েছে। ভাটায় কর্মরত এক শ্রমিক বলেন, প্রতি চার লাখ ইট প্রস্তুত করতে ২০ থেকে ২২ দিন সময় লাগে। এতে প্রায় ৩৫ হাজার মণ কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আগে দূর থেকে কাঠ চিরে আনা হতো। এতে সময় এবং অর্থ বেশি ব্যয় হতো। যে কারণে ভাটার মালিক নিজেই এক করাত বিশিষ্ট স’ মিল স্থাপন করেছেন।

এ বিষয়ে ভাটার মালিক খয়বার প্রামাণিক বলেন, তার ভাটার সব কাগজপত্র ঠিক নেই। তবে সবাই যেভাবে চলছেন, তিনিও সেভাবেই চলছেন। তিনি আরও বলেন, এই এলাকাতে এক সারিতে ১০টি ভাটা রয়েছে। সবগুলোতে কাঠ পুড়িয়ে ইট প্রস্তুত করা হয়।

আরপিকে ভাটার স্বত্ত্বাধিকারী সাব্বির রানার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

গত ৬ জানুয়ারি ভ্রাম্যমাণ আদালত এসএসবি এবং কেএবি ভাটার চিমনি ভেঙে দিয়ে যায়। সেগুলো মেরামত করে আবারও ইট পোড়ানো হচ্ছে।

কেএবি ইটভাটার মালিক আশরাফ বলেন, ‘ইট প্রস্তুত করতে আগাম কিছু খরচ হয়। সেই টাকা জোগাড় করতে হয়। কারণ ইট বিক্রির পরে লাভের টাকা হাতে আসে। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ভাটায় প্রায় দুই কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এখন ইট পোড়াতে না পারলে জেল খাটতে হবে।’

বারখাদা উত্তরপাড়ায় দুটি ভাটার ভাটার মালিক আলাল উদ্দিন। দলীয় কোনো পদে না থাকলেও তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দেন। এলাকায় তার প্রভাবও রয়েছে। প্রায় এক শ বিঘা আবাদি জমি দখল করে তিনি গড়ে তুলেছেন এনবিসি এবং এএসএসবি ভাটা। সেখানেও বসানো হয়েছে স’ মিল।

আলাল উদ্দিনের ছেলে সিহাব উদ্দিন বলেন, কিছু কিছু সময় তারা কাঠ ব্যবহার করেন। ভাটার কাগজপত্র আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটির সব কাগজপত্রই ঠিক আছে। অন্যটির বৈধ কাগজ নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’

জুগিয়া থেকে কুষ্টিয়ার মিরপুর পর্যন্ত এক সারিতে রয়েছে অন্তত ১০টি ইটভাটা। এর মধ্যে এমইবি নামে একটি ইটভাটার মালিক কুষ্টিয়া পৌরসভার কমিশনার মহিদুল ইসলাম। পাশেই এমএসকে ইটভাটার মালিক তার ভাই মাহাবুবুল ইসলাম। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কানা বিল মোড় থেকে জুগিয়া পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তার বেহাল দশার জন্য এই দুটি ইটভাটা দায়ী।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বা তিনি মনোনীত কোনো বন কর্মকর্তা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগী কার্যালয় বা জেলা কার্যালয় কর্তৃক মনোনীত কোনো কর্মকর্তাসহ আহ্বায়ক কমিটি অনুসন্ধান করা এবং আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।

এ বিষয়ে কুষ্টিয়া নাগরিক কমিটির সভাপতি প্রফেসর ডা. এসএম মুসতানজিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ইটভাটা নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। যে কারণে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ হচ্ছে না।

তবে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, ‘আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে না এ কথা ঠিক না। গত একমাসে এ ধরনের ২৭টি ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইন অনুসারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আতাউর রহমান বলেন, ‘অবৈধ ইট ভাটার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সব ভাটায় অভিযান চলবে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ শ্যামল কুমার বিশ্বাস দ্বিমত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের ইটভাটার ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগের মতামত গ্রহণের বিধান থাকলেও প্রায় কখনই তা নেওয়া হয় না।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, কুষ্টিয়া জেলায় ১৪৯টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ১৩২টির বৈধতা নেই।

উল্টো রথ

গত শনিবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া শহরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত সভায় বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি ঘোষণা দিয়েছে, ইটভাটা প্রশাসনের অভিযান বন্ধ করা না হলে আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে খুলনা বিভাগে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ইট বিক্রি ও সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে।

অভিযান বন্ধের দাবিতে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিভাগের ১০টি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি পালন করবে সংগঠনটি।

সভায় তারা অভিযোগ করেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানের কারণে ইট উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। লিখিত বক্তব্য পড়ে সমিতির সভাপতি এবং ভেড়ামারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান মিঠু বলেন, ‘নানা অজুহাতে ইটভাটা ভেঙে দেওয়া হলে করোনাকালে কোটি কোটি শ্রমিকের জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। ইটভাটাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাহত হবে।’

সভায় আক্তারুজ্জামান মিঠু সভাপতিত্ব করেন। এ সময় খুলনা বিভাগের প্রায় ৭০ জন ‘অবৈধ’ ভাটা মালিক উপস্থিত ছিলেন। তারা অভিযোগ করেন, ২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সংশোধিত আইনের ৮(ঙ) ধারা পরিবর্তন করায় আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে তারা নিবন্ধন করতে পারেননি।

Comments

The Daily Star  | English

Banks mostly gave loans to their owners rather than creditworthy borrowers

Bangladesh’s banking sector was not well-managed in recent years. Banks mostly gave loans to their owners, rather than to creditworthy entities. Consequently, several banks are now in difficulty.

11h ago