‘সু চি সরকারের বেশিরভাগ ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতেই ছিল’

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। এ নিয়েই চলছে আলোচনা-সমালোচনা। প্রশ্ন উঠেছে, ‘সেনাবাহিনীর নীতিতেই চলা’ সু চিকে কেন সরিয়ে তারা ক্ষমতা নিলো? সু চির ভাগ্যে এখন কী ঘটবে?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ও ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। এ নিয়েই চলছে আলোচনা-সমালোচনা। প্রশ্ন উঠেছে, ‘সেনাবাহিনীর নীতিতেই চলা’ সু চিকে কেন সরিয়ে তারা ক্ষমতা নিলো? সু চির ভাগ্যে এখন কী ঘটবে? 

সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো এসআইপিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। 

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘মিয়ানমারে একটা ডুয়েল সরকার ছিল। অর্থাৎ আগে থেকেই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল। এবার সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার কারণ হলো, তাদের যে দলটা ছিল, সেটা নির্বাচনে ভালো করেনি। সেই দলটার প্রতি সেনাবাহিনীর একটা রাজনৈতিক সমর্থন ছিল, ভোটের ফলে যার প্রভাব পড়েনি। যেটার জন্য তারা বলেছে, ব্যাপক কারচুপি হয়েছে এবং সেজন্য সু চির দল বিপুল ভোট পেয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, সু চি দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছে যে, দেশটির সংবিধানে পরিবর্তন আনা যায় কি না। যদিও সংসদে সেটা আনা সম্ভব হতো না। এত জনপ্রিয়তা নিয়ে জয়ী হওয়ার পরে হয়তো সুচি সেটা নিয়ে একটা মুভমেন্ট করত। যেটা সেনাবাহিনীর জন্য ভালো ছিল না। মূল কারণ এই দুইটিই বলে মনে হচ্ছে।’ 

‘আর অভ্যন্তরীণ কিছু কারণও রয়েছে। যদিও সু চি সেনাবাহিনীর মুখ রক্ষার্থে জেনেভায় গিয়েছেন। কিন্তু, সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বটা আগে থেকেই ছিল। এ নির্বাচনের পর যেটা ফোকাস পেল, যখন সু চি সরকার আরাকান আর্মির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলো না, বলল যে, তারা বিদ্রোহী। কিন্তু, সেনাবাহিনী আগ বাড়িয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছে এবং তাদেরকে ফোর্স হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব মিলিয়েই বোঝা যাচ্ছিল যে, সেনাবাহিনী সু চির সরকারের ওপর খুশি ছিল না। নির্বাচনের পরই বোঝা গেছে যে, তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা দ্বন্দ্বে চলে গেছে। সেনাবাহিনী আগে থেকেই বলেছে, সু চি নির্ধারিত নির্বাচন কমিশন ব্যাপক কারচুপি করার ফলে তিনি এত বিপুল পরিমাণ ভোট পেয়েছেন। যা পাওয়ার কথা নয়’, বলেন তিনি। 

এই অভ্যুত্থানের পেছনে সেনাবাহিনীর নিজেদেরও একটা ইন্টারেস্ট ছিল বলে উল্লেখ করে ড. এম সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, ‘সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের জুলাইয়ে অবসরে যাওয়ার কথা এবং তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। আবার মিয়ানমারের মাইনিং থেকে শুরু করে সব ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম কিন্তু সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। এগুলো নিয়েই বেসামরিক সরকারের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব ছিল। সেই দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে এই অভ্যুত্থান। মিয়ানমারের জনগণও সামরিক শাসনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেখানে সেনাবাহিনীরও প্রচুর সমর্থক রয়েছে। সকালে যখন অভ্যুত্থান হলো, তখন তাদের সমর্থকরা রাস্তায় বের হয়েছিল।’ 

সু চির ভাগ্যে কী ঘটতে পারে, এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সু চি গ্রেপ্তার অবস্থাতেই থাকবেন। সেই অবস্থাতেই তাকে থাকতে হবে। এখন এক বছর থাকবে, দুই বছর থাকবে নাকি চার বছর থাকবে, সেটাই দেখার বিষয়। কিছুক্ষণ আগে সু চি প্রতিবাদের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু, প্রতিবাদের কোনো লক্ষণ নেই। সেরকমভাবে প্রতিবাদ হবে কি না, সন্দেহ আছে।’ 

আন্তর্জাতিক চাপ নিয়ে মিয়ানমার খুব বেশি চিন্তিত না বলেও উল্লেখ করেন এই সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার জানে যে, আশেপাশে তাদের প্রতিবেশীরা আছে। যেমন: ভারত থেকে তেমন কোনো চাপ দেওয়া হয়নি। চীন বলছে, আমরা দেখছি কী অবস্থা হচ্ছে সেখানে। এই দুই দেশের তো দারুণ ইন্টারেস্ট আছে। কিছুদিন আগেই তো ভারতের সেনাপ্রধান সেখানে গিয়েছেন ডিফেন্স কোঅপারেশনের জন্য। কাজেই ভারতের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যোগাযোগ সবসময়ই ছিল। এমনকি যখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সারাবিশ্বে হইচই, তখনও। আর চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক দারুণ। চীনের বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ মিয়ানমারে আছে। কাজেই মিয়ানমারে গণতন্ত্র আছে কি নেই, তা নিয়ে চীন তেমন একটা বিচলিত নয়। যদিও মাঝে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক একটু খারাপ হয়েছিল। কিন্তু, এখন হয়তো সেটা শুধরে নেবে। কারণ, চীনের একমাত্র ভরসা হচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।’ 

‘আরেকটি বিষয় হলো, মিয়ানমারে যে ১৮টি বিদ্রোহী দল রয়েছে, তারা সমস্যা সমাধানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে ইচ্ছুক। সেটাও একটা বিষয় যেটা বেসামরিক সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সেনাবাহিনী করতে পারছে’, যোগ করেন ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। 

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আসলে সেনাবাহিনী তো এমনিতেই ক্ষমতায় ছিল। খুব যে বেসামরিক একটা সরকার ছিল, সেটা তো বললে ভুল হবে। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতেই ছিল। এমনকি সংসদের মধ্যেই এক-তৃতীয়াংশই সেনাবাহিনীর পোশাকধারী সদস্য ছিল। সেই হিসাবে এখন যা ঘটেছে, তার পেছনে কারণ হতে পারে যে, তারা মনে করছে সু চির যে প্রয়োজন ছিল, সেটা এখন আর নেই। কারণ, যে ধরনের বিনিয়োগ বিভিন্ন দেশ করেছে, তারা হয়তো মনে করতে পারে যে, এগুলো টিকে থাকবে। এগুলোর কোনো নড়চড় হবে না। চীন তো আগে থেকেই সেখানে ছিল। এ ছাড়া, জাপান হোক, ভারত হোক বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নই হোক। মিয়ানমার এর আগে দেখেছে যে, এতকিছু ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু, কেউ তো কিচ্ছু বলছে না। এখন দেখার বিষয় এই যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিছু করবে কি না। তাই এই এক বছরের সময়সীমাটা খুব ইন্টারেস্টিং। কারণ, সেনাবাহিনী যদি দেখে বড় আকারে চাপ আসছে, তাহলে তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলবে। আর যদি দেখে যে ব্যবসা স্বাভাবিকই হচ্ছে, তাহলে তারা মনে করবে যে, সু চিকে আর প্রয়োজন কেন? আমরা তো এমনিতেই করতে পারছি।’ 

‘আর অং সান ‍সু চি তো এতদিন তাদেরই স্বার্থ রক্ষা করছিল। সেই হিসাবেই কী ধরনের চাল তারা খেলছেন, তা বলা কঠিন। কারণ, মিয়ানমারকে বাইরের থেকে বোঝা খুব মুশকিল। সেজন্য আমাদের নজর রাখতে হবে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী করছে। যেমন: ভারত, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র। তারা সরে দাঁড়ালে চীনের ওপর তখন বড় চাপ আসবে। কিন্তু, অন্যরা যদি আগের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যায়, তাহলে চীন বলবে, আমাদের ওপর কেন এত নজর দেওয়া হচ্ছে?’, বলেন তিনি। 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের প্রভাব পড়তে পারে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু একটা রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে, অর্থাৎ চুক্তিটা দুইটা রাষ্ট্রের মধ্যে হয়েছে, যে সরকারই থাকুক না কেন, আমরা চাইব যে চুক্তি হয়েছে, সেই মোতাবেক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যথাসময়ে শুরু হবে। কারণ, আমাদের চুক্তি তো সু চির সঙ্গে হয়নি।’ 

সু চির ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারকে বোঝা আসলেই মুশকিল। এখন সু চির সমর্থকরা চুপ করে আছে। অন্য দেশে হলে রীতিমতো রাস্তায় নেমে পড়ত। যেটা আশির দশকে আমরা দেখেছিলাম। কিন্তু, এবার দেখা যাচ্ছে যে, তার দলের লোক বলছে শান্ত হতে। আজকেই সব বোঝা যাবে না। এর জন্য কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করা দরকার যে, কী প্রতিক্রিয়া হয়। সু চির কী অবস্থা হয়। হয়তো তিনি আগের মতো বন্দি হয়ে থাকবেন তার বাড়িতে। তখন হয়তো দেখবেন যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে চাপ প্রয়োগ করে এবং এর মাধ্যমে আবার পরিস্থিতি আগের পথে আসে কি না।’ 

‘এবং এটাও হতে পারে যে, এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি তারা পিছিয়ে দিতে চেষ্টা করবে। কিন্তু, আমরা চাইব, যেহেতু দুই রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি হয়েছে, তাই তারা যাতে সেটা মেনে চলে। মেনে না চললে আমরা তখন জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিষয়টা তুলে ধরতে পারব’, যোগ করেন অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ।

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

14h ago