‘ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে, মানুষের কাছে যেতে হবে’

দেশব্যাপী ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি চলছে। প্রত্যেককে করোনাভাইরাসের এই টিকার দুটি করে ডোজ দেওয়া হবে। এই টিকাটির ট্রায়ালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ডোজ নেওয়ার ছয় সপ্তাহের কম সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দিলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হয় ৫৩ শতাংশ। ছয় সপ্তাহ পরে দিলে কার্যকারিতা ৬৫ শতাংশ ও ১২ সপ্তাহ ব্যবধানে দিলে হবে ৮৩ শতাংশ।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা। ছবি: রয়টার্স

দেশব্যাপী ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি চলছে। প্রত্যেককে করোনাভাইরাসের এই টিকার দুটি করে ডোজ দেওয়া হবে। এই টিকাটির ট্রায়ালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ডোজ নেওয়ার ছয় সপ্তাহের কম সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দিলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হয় ৫৩ শতাংশ। ছয় সপ্তাহ পরে দিলে কার্যকারিতা ৬৫ শতাংশ ও ১২ সপ্তাহ ব্যবধানে দিলে হবে ৮৩ শতাংশ।

অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ, অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ও অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন। (বাম দিক থেকে)

বাংলাদেশ সরকার চার সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে— ১২ সপ্তাহ পর দিলে কার্যকারিতা ৩০ শতাংশ বেশি হওয়া সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশে চার সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে?

দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেনের সঙ্গে।

অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘প্রথমে যে গবেষণা হয়েছে, তা অনুযায়ী চার সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কথা ছিল। পরে আরও গবেষণা করে দেখা গেছে, যদি দ্বিতীয় ডোজ দেরিতে দেওয়া যায়, তাহলে কার্যকারিতা আরও ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি পাওয়া যায়। প্রথমে আট সপ্তাহ পরেই দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু, স্বাস্থ্য বিভাগ এখন দেখছে তারা নির্দিষ্ট সময়, অর্থাৎ টিকার মেয়াদকালের মধ্যে ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে পারবে না। সেজন্য তারা আট সপ্তাহ থেকে কমিয়ে চার সপ্তাহে এনেছে।’

যেহেতু ১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দিলে কার্যকারিতা ৩০ শতাংশ বেশি পাওয়া যায়, তাই আমাদেরও সেটা অনুসরণ করা উচিত ছিল কি না? কেন করা গেল না?, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে আসলে প্রথমেই আমাদের একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল যে, অ্যাপের মাধ্যমে টিকা দেওয়া হবে। এটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকের চারপাশে যে থানাগুলো আছে, সব জায়গাতে যদি স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করত, অনুরূপভাবে শহরে যদি স্বেচ্ছাসেবকরা এই কাজটা করত, তাহলে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ হতো। এর মাধ্যমে ইন্টারপারসনাল যোগাযোগটাও স্থাপন করা যেত। গ্রামসহ শহরের অনেকের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন আছে টিকা নিয়ে। স্বাস্থ্যকর্মীরা রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে তারা সেগুলো জিজ্ঞাসা করে জানতে পারত। এতে মানুষের ভ্যাকসিন নেওয়ার আগ্রহ বাড়ত।’

‘দ্বিতীয়ত, যদি টিকাকেন্দ্রগুলো মানুষের কাছে করা হতো, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে না করে যদি কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব-সেন্টার, শহরে পাড়ায় পাড়ায় করা হতো, তাহলে নিবন্ধনও বেশি হতো, টিকা গ্রহণের হারও বেশি হতো। সরকার আগে এটা চিন্তা করেনি। এখন তারা এটা আবার চিন্তা করছে বলে মনে হয়। সামনের দিনগুলোতে হয়তো তারা স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে নিবন্ধন করাবে এবং টিকাদান কেন্দ্রও হয়তো বাড়াবে’, বলেন তিনি।

গতকালের টিকাদান কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গতকাল ৩১ হাজার মানুষ টিকা নিয়েছেন। টিকাদান কেন্দ্র এক হাজারটি। তার মানে গড়ে প্রতিটি কেন্দ্রে ৩০টি মাত্র টিকা দেওয়া হয়েছে। এখন গড়ে সেই ৩০ হাজার বেড়ে না হয় ৬০ হাজার হলো। সেটা হলেও প্রতিদিন ৬০ হাজার করে মাসে ২০ দিনে ১২ লাখের মতো টিকা দেওয়া যাবে। দুই মাসে দেওয়া যাবে ২৪ লাখের মতো। কিন্তু, এই সময়ে কমপক্ষে ৩৫ লাখ টিকা দিতে হবে। ফলে সেটা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। এটা মোকাবিলা করতে হলে টিকাকেন্দ্র এক হাজার থেকে বাড়িয়ে ১৫ বা ১৮ হাজারে নিতে হবে। তখন টিকাকেন্দ্র মানুষের বাড়ির পাশে হবে। মানুষ তখন টিকাকেন্দ্রে লোকজন দেখেই টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ হবে। মোদ্দা কথা, ভ্যাকসিন দেওয়ার রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে এবং মানুষের কাছে যেতে হবে।’

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যেক মাসে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আসবে। মানুষের যে পরিমাণ রেসপন্স, তাতে এই ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন মানুষকে দিয়ে ইউটিলাইজ করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্টরা ভাবলেন, সেটা অসম্ভব ব্যাপার। ২৫ জানুয়ারি আমরা একটা চালান পেয়েছি। আবার ২৫ ফেব্রুয়ারিতে আরেকটা চালান আসবে। সেক্ষেত্রে যদি দুই মাস ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া হয়, তাহলে টিকা সংরক্ষণ স্টেগারিং হয়ে যাবে। তাই তারা চার সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু, প্রথমে তাদেরও পরিকল্পনা ছিল দুই মাস পরে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া। কিন্তু, টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের রেসপন্স দেখে তারা ঘাবড়ে গেছে। তবে, আমার মনে হয় মানুষের রেসপন্স বেড়ে যাবে।’

চার সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টিকার পরিমাণ শেষ করার চিন্তা না করে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া আরও সহজ করা কিংবা মানুষকে উৎসাহী করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে প্রক্রিয়ায় রেজিস্ট্রেশন করতে হয়, এতেই তো মানুষ হতাশ হয়ে যাবে। কেউ ম্যাসেজ দিলো, তার ম্যাসেজের উত্তর আসে না; অনেকের রেজিস্ট্রেশন নম্বর এলো, কিন্তু, কবে-কোথায় দেবে, তা আসেনি; আবার বয়স ক্রাইটেরিয়া আছে, কো-মরবিডিটি সম্পর্কে বলতে হয়, এগুলো তো খুব ঝামেলার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াই তো এগুলোকে ধীর করে ফেলেছে।’

ভবিষ্যতে যদি রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ হয়, সরকাররের পক্ষ থেকে আরও প্রচার-প্রচারণা চালানো হয় এবং আরও বেশি মানুষ ভ্যাকসিন নিতে আসে, তাহলে কি দুই ডোজের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান বাড়ানো হবে বলে মনে করেন, জানতে চাইলে পরামর্শক কমিটির এই সমস্য বলেন, ‘যদি পরিস্থিতি এমন হয়, তাহলে পুনর্বিবেচনার বিষয়টি উঠবে যে, তাহলে আমরা দুই ডোজের মাঝে সময়ের ব্যবধান বাড়িয়ে দেই না কেন। যেহেতু এতে মানুষও উপকৃত হবে।’

অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘চার সপ্তাহ সময় হাতে রাখা হলেও ১২ সপ্তাহ পর্যন্তই তো সময় আছে। কারো দেরি হলে ১২ সপ্তাহ পর দিলেও হবে। এখন চার সপ্তাহ করা হয়েছে বিভিন্ন কারণে। একটা হলো— ভ্যাকসিনপ্রাপ্যতা। এটা যদি অনিশ্চিত হয়, তাহলে যত ডোজ আছে (৭০ লাখ), সেটা দুই ডোজ করে ৩৫ লাখ মানুষকে দিয়ে দেওয়া। আরেকটা হলো ভ্যাকসিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এগুলো দিতে হবে। যেগুলোর মেয়াদ এপ্রিলে শেষ হয়ে যাবে, সেগুলো আগে দিয়ে দিতে হবে। আবার কোনো কোনো ভ্যাকসিনের মেয়াদ জুনে গিয়ে শেষ হবে। সেগুলো পরে দিলেও হবে।’

যেহেতু ১২ সপ্তাহ পর দিলে ৩০ শতাংশ বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে সেটাই অনুসরণ করা উচিত ছিল কি না?, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে সত্য, তা ঠিকাছে। কিন্তু, যেসব ভ্যাকসিনের মেয়াদ এপ্রিলে শেষ হয়ে যাবে, আমি যদি ১২ সপ্তাহ অপেক্ষা করি, তাহলে সেগুলো তো আর দেওয়া যাচ্ছে না।’

সেক্ষেত্রে যদি আরও মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যেত, তাহলে তো ১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া সম্ভব হতো?, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেগুলোর মেয়াদ এপ্রিল পর্যন্ত আছে, আমরা যদি প্রথম ডোজ দিয়ে সেগুলো ফুরিয়ে ফেলতে পারি, তাহলে সেটার (৪ সপ্তাহ ব্যবধানে দেওয়ার) প্রয়োজন হবে না। আবার কেউ যদি চার সপ্তাহে দিতে চায়, তার জন্য অপশনটা খোলা রাখা। যেমন: কারো যদি জরুরি কাজ থাকে, কেউ যদি বিদেশ যেতে চায় বা আরও দ্রুত ইমিউন ডেভেলপ করতে চায়, তারা দিয়ে ফেলল।’

রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করা বা আরও প্রচার-প্রচারণার দরকার ছিল কি না? আরও আগে থেকে পরিকল্পনা দরকার ছিল কি না?, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা তো সবসময় আপডেট করা হচ্ছে। তবে, এখানে একটা বিষয় আছে, আমি মনে করেছিলাম যে, ভ্যাকসিনের জন্যে চাহিদাটা এত বেশি, মানুষকে সামাল দেওয়াটাই মুশকিল হবে। কেন অগ্রাধিকার তালিকা করা হলো, কেন সবাই একসঙ্গে পাচ্ছে না, সে ব্যাখ্যা মানুষ চাইবে। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে ভ্যাকসিনের চাহিদা তৈরির জন্য আমাদেরকে কাজ করতে হচ্ছে।’

‘দিনকে দিন ভ্যাকসিন দেওয়ার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচার-প্রচারণাও বাড়বে। তবে, হ্যাঁ, আরও আগে থেকে প্রচারণা শুরু করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু, সেটা তো আমরা করিনি। এখন করতে হবে। এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে যে আবারও ইনডিভিজুয়ালি রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, সেটা হয়তো অনেকেই জানে না। ওয়াসা, ওয়াপদা, আর্মি, নেভি, পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানুষেরা রেজিস্ট্রেশন করলে তো এমনিতেই ১০-২০ লাখ হয়ে যায়’, বলেন তিনি।

‘রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া খুব কঠিন না। তবে, এটার অ্যাক্সেসটা অনেকের কাছে সহজলভ্য না। স্বাস্থ্যকর্মীরাও কমিউনিটি পর্যায়ে যেয়ে যেয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে পারলে ভালো হয়। সেটা ভবিষ্যতে করা হবে। মানে সার্বিক প্রক্রিয়াটা আরও বিস্তৃত করা প্রয়োজন এবং এটা ভবিষ্যতে করা হবে বলেও আমি মনে করছি। ইপিআই কর্মসূচির মতো করে করা হবে’, বলেন অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন।

Comments

The Daily Star  | English

Fashion brands face criticism for failure to protect labour rights in Bangladesh

Fashion brands, including H&M and Zara, are facing criticism over their lack of action to protect workers' basic rights in Bangladesh, according to Clean Clothes Campaign (CCC)..One year after a violent crackdown by state actors and employers against Bangladeshi garment workers protesting

8m ago