চালকের আসন থেকে উইন্ডিজকে সরাতে পারল না বাংলাদেশ

মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস ও মেহেদী হাসান মিরাজের হাফসেঞ্চুরির পরও তিনশোর নিচে গুটিয়ে গেল বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের রাহকিম কর্নওয়াল বল হাতে ৫ উইকেট নিয়ে নজর কাড়লেন ঠিকই। তবে স্বাগতিক ব্যাটসম্যানদের উইকেট ছুঁড়ে আসার চিত্রের পরিবর্তন হলো না। ফের ব্যাটিংয়ে নেমে দ্রুত কয়েকটি উইকেট খোয়ালেও উইন্ডিজের হাতেই রইল ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ।
শনিবার মিরপুর টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা শেষে ১৫৪ রানে এগিয়ে আছে উইন্ডিজ। দ্বিতীয় ইনিংসে তাদের সংগ্রহ ৩ উইকেটে ৪১ রান। ক্রিজে আছেন এনক্রুমা বনার ৮ ও নাইটওয়াচম্যান জোমেল ওয়ারিকান ২ রানে।
এর আগে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে আগের দিনের ৪ উইকেটে ১০৫ রান নিয়ে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে অলআউট হয় ২৯৬ রানে। ফলে সফরকারীরা প্রথম ইনিংসে পায় ১১৩ রানের বড় লিড।
এই টেস্টে জিতে সিরিজে সমতায় ফিরতে হলে আগামীকাল চতুর্থ দিনে উইন্ডিজকে দ্রুত গুঁড়িয়ে দিতে হবে মুমিনুল হকের দলকে। সেই সঙ্গে তাদেরকে জয় করতে হবে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং করার চ্যালেঞ্জও। অর্থাৎ ব্যাটে-বলে স্মরণীয় পারফরম্যান্স উপহার দেওয়ার বিকল্প নেই।
তৃতীয় সেশনে ব্যাটিংয়ে নামা উইন্ডিজের ইনিংসের চতুর্থ ওভারেই প্রথম সাফল্য পায় বাংলাদেশ। তবে ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েটকে দুর্ভাগা বলতেই হবে। নাঈম হাসানের লেগ স্টাম্পের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া বাজে বলে উইকেটরক্ষক লিটন দাসের গ্লাভসবন্দি হন তিনি। তার ব্যাট থেকে আসে ১৩ বলে ৬ রান। শুরুতে আম্পায়ার আউট না দেওয়ায় রিভিউ নিয়ে তাকে সাজঘরে পাঠান মুমিনুলরা।
দলীয় ১১ রানে এই ধাক্কার পর ২০ রানের মাথায় আবার উইকেট হারায় ক্যারিবিয়ানরা। বল হাতে নিয়ে তৃতীয় ডেলিভারিতেই উল্লাসে মাতেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তার ফুল লেংথের ডেলিভারি সামনে পা বাড়িয়ে খেলতে গিয়েছিলেন শেন মোসলি। তবে এজ হয়ে বল চলে যায় দ্বিতীয় স্লিপে। মোহাম্মদ মিঠুন বাকিটা সারেন অনায়াসে। মোসলির সংগ্রহ ২০ বলে ৭ রান।

মোসলিকে ফিরিয়ে টেস্টে বাংলাদেশের জার্সিতে দ্রুততম ১০০ উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়েন মিরাজ। তিনি ছাড়িয়ে যান সতীর্থ তাইজুল ইসলামকে। মাত্র ২৪ টেস্টেই ১০০ উইকেট হয়ে গেছে অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার মিরাজের। বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল শততম টেস্ট উইকেটের দেখা পেয়েছিলেন ২৫তম ম্যাচে।
তিন স্পিনারের আঁটসাঁট বোলিংয়ে চাপে পড়া উইন্ডিজের বিপদ আরও বাড়ে জন ক্যাম্পবেলের বিদায়ে। তাইজুলের বল ব্যাকফুটে গিয়ে খেলেছিলেন তিনি। তবে বল মাটিতে পড়ে স্টাম্পে লাগলে পড়ে যায় বেল। ৪৮ বল খেলে তার সংগ্রহ ১৮ রান।
দিনের শেষ পাঁচটি ওভারে আর কোনো উইকেট ফেলতে পারেনি বাংলাদেশ। যদিও স্পিন ভেলকিতে বেশ কয়েকবার বনার ও ওয়ারিকানকে বিপাকে ফেলা গেছে।
এর আগে স্পিনার ওয়ারিকান ও পেসার শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের ওভার থেকে নিয়মিত বাউন্ডারি আদায় করে দিন শুরু হয় বাংলাদেশের। দ্বিতীয় দিনের দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান মুশফিক ও মিঠুন স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাট চালাতে থাকেন। চমৎকার টাইমিংয়ে কভার দিয়ে পেসার গ্যাব্রিয়েলকে চার মেরে জুটির রান পঞ্চাশ পার করেন মুশফিক।
সাবলীল ব্যাটিংয়ে ফিফটিও পূর্ণ করেন টেস্টে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ৮৯ বলে আসে এই সংস্করণে তার ২২তম হাফসেঞ্চুরি।
এরপরই ঘটে ছন্দপতন। কর্নওয়ালের শিকার হয়ে বিদায় নেন মিঠুন। এতে প্রশংসা প্রাপ্য উইন্ডিজের ফিল্ডিং সাজানোর কৌশলের। শর্ট মিড-উইকেটে ডাইভ দিয়ে অসাধারণ ক্যাচ নেন দলটির অধিনায়ক ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট।
লম্বা সময় উইকেটে থাকা মিঠুন সাজঘরে ফেরেন ৮৬ বলে ১৫ রান করে। তার বিদায়ে ভাঙে বাংলাদেশের ১৮১ বলে ৭১ রানের পঞ্চম উইকেট জুটি।

তবে অভিজ্ঞ মুশফিক যে কায়দায় বিদায় নেন, তা রীতিমতো অমার্জনীয়! আগের ডেলিভারিতেই চার মারার পর কর্নওয়ালকে রিভার্স সুইপ করার মতো বিলাসী সিদ্ধান্তে শেষ হয় তার ইনিংস। অথচ মিঠুনকে হারিয়ে বাংলাদেশ তখন ফের চাপে। প্রয়োজন ছিল আরেকটি বড় জুটির।
কর্নওয়ালের আগের ওভারেই রিভিউ নিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন মুশফিক। জোরালো আবেদনে আম্পায়ার সাড়া না তৎক্ষণাৎ রিভিউ নিয়েছিল ক্যারিবিয়ানরা। তবে আম্পায়ার্স কলে বেঁচে যান মুশি। দ্বিতীয় জীবন আর কাজে লাগাতে পারলেন কই তিনি! তার ১০৫ বলে ৫৪ রানের ইনিংসে ছিল ৭ চার।
দ্বিতীয় সেশনে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। লিটন ও মিরাজ শক্ত হাতে ধরেন দলের হাল। তাদের সাবলীল ব্যাটিংয়ে কোনো উইকেট না হারিয়ে তারা তোলেন ৯১ রান।
বনারকে টানা দুটি চার মেরে লিটন ক্যারিয়ারের সপ্তম হাফসেঞ্চুরি পূরণ করেন ৯২ বলে। গ্যাব্রিয়েলের বল স্কয়ার লেগে ঠেলে তিন রান নিয়ে মিরাজ সাদা পোশাকে তৃতীয়বারের মতো ফিফটির দেখা পান ১১২ বলে। তিনি অবশ্য ব্যক্তিগত ২৮ রানে একবার জীবন পান।
৬ উইকেটে ২৭২ রান নিয়ে চা বিরতিতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ফিরে এসে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ায় তাদের ইনিংস টেকে মাত্র ৮.৫ ওভার। শুরুটা লিটনকে দিয়ে। প্যাডল সুইপ করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে জার্মেইন ব্ল্যাকউডের তালুবন্দি হন তিনি। রিভিউ নিয়েও শেষরক্ষা হয়নি। তার ১৩৩ বলে ৭১ রানের দারুণ ইনিংসে ছিল ৭ বাউন্ডারি।

তিন বলের মধ্যে ফের আঘাত করেন কর্নওয়াল। সামনে পা বাড়িয়ে খেলতে যাওয়া নাঈমের ব্যাটের কানায় লেগে বল চলে যায় স্লিপে। এবারে কোনো ভুল করেননি ব্ল্যাকউড। আগের বলেই নাঈমের লোপ্পা ক্যাচ ফেলেছিলেন তিনি।
উইকেটের আরেক প্রান্তে ছিলেন মিরাজ। অন্তত তিনশো পেরোতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের ভাবনা ছিল অন্যরকম। ১৪০ বলে ৫৭ করতে ৬ চার মারা মিরাজের দৃঢ়তার অবসান ঘটান তিনি। কভারে অনায়াসে ক্যাচ নেন উইন্ডিজ দলনেতা ব্র্যাথওয়েট। ফলে ৬ উইকেটে ২৮১ রান থেকে মুহূর্তে ৯ উইকেটে ২৮৩ রানে পরিণত হয় বাংলাদেশ।
প্রতিপক্ষকে অলআউট করার বাকি আনুষ্ঠানিকতা সারেন আলজারি জোসেফ। তার গতিময় ও কিছুটা খাটো লেংথের বলে গালিতে ক্যাচ দেন আবু জায়েদ রাহি। তাইজুল অপরাজিত থাকেন ১৩ রানে।
অফ স্পিনার কর্নওয়াল ৫ উইকেট নেন ৭৪ রানে। গ্যাব্রিয়েল ৩ উইকেট তুলতে খরচ করেন ৭০ রান। আরেক পেসার জোসেফ ২ উইকেট দখল করেন ৬০ রানে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
(তৃতীয় দিন শেষে)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংস: ১৪২.২ ওভারে ৪০৯
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: (আগের দিন ১০৫/৪) ৯৬.৫ ওভারে ২৯৬ (মুশফিক ৫৪, মিঠুন ১৫, লিটন ৭১, মিরাজ ৫৭, নাঈম ০, তাইজুল ১৩, রাহি ১*; গ্যাব্রিয়েল ৩/৭০, কর্নওয়াল ৫/৭৪, আলজারি ২/৬০, মেয়ার্স ০/১৫, ওয়ারিকান ০/৪৮, বনার ০/১৭, ব্র্যাথওয়েট ০/৭)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংস: ২১ ওভারে ৪১/৩ (ব্র্যাথওয়েট ৬, ক্যাম্পবেল ১৮, মোসলি ৭, বনার ৮*, ওয়ারিকান ২*; তাইজুল ১/১৩, নাঈম ১/১৪, মিরাজ ১/১৪)।
Comments