‘গণ টিকাদানের পরেও আগামী বছর ফের করোনা দেখা দিতে পারে’
দেশের আবহাওয়া উষ্ণ হতে থাকায় কোভিড-১৯ মহামারি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে বলে মনে হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই। কেননা মারাত্মক এ ভাইরাস যেকোনো নতুন ধরনের মাধ্যমে ফের বেড়ে যেতে পারে।
তারা আরও বলছেন, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিলেও মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অ্যান্টিবডি, উষ্ণ পরিস্থিতি, সংক্রমণ রোধ কার্যক্রম ও ভালো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাসহ অনেক কারণে শীতকালে দেশে করোনাভাইরাসটি উল্লেখযোগ্যভাবে ছড়াতে পারেনি।
সরকারকে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও টিকা কর্মসূচি জোরদার করার পাশাপাশি মানুষজনকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলতে এবং ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দেশে মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও আট জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে আট হাজার ২৭৪ জনে দাঁড়িয়েছে।
এ ছাড়া, ২৪ ঘণ্টায় ৩২৬ জনের শরীরে নতুন করে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। যার ফলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৫৯২ জনে পৌঁছেছে।
দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২.৫৩ শতাংশ এবং এ পর্যন্ত শনাক্ত বিবেচনায় মোট মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
ভাইরাস প্রতিরোধ ও অ্যান্টিবডি
প্রখ্যাত ভাইরাসবিদ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, অনেক বিশেষজ্ঞ ভেবেছিলেন শীতকালে ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে, তবে মূলত প্রতিরোধ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কারণে তা হয়নি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে শীতকালে সাধারণত মানুষের ভাইরাস এবং ফ্লু-জনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। তবে প্রচুর দেশীয় ভাইরাস এবং ফ্লুর কারণে শীতকালে করোনা দুর্বল হয়ে পড়েছে।’
প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়াও এটি সত্য যে দেশের অনেক মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবডি ক্ষমতা বেড়েছে। ফলে সংক্রমণ হার অনেক কমেছে, মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনও হার্ড ইউমিনিটি পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আমরা হার্ড ইউমিনিটি অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এবং গণহারে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে আমরা এটি অর্জন করতে পারি।’
মৃত্যুর হার ‘এখনও বেশি’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দলের অন্যতম বিভাগীয় সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘শীতকালে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পূর্বাভাসের তুলনায় অনেক কম তবে সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুর হার অনেক বেশি।’
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে প্রতিদিন ১০ জনেরও বেশি মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে, কারণ কিছু জায়গায় ভাইরাস সংক্রমণ এখনও অব্যাহত আছে এবং আমাদের এ বিষয়টিতে অবশ্যই নজর দিতে হবে।’
সতর্ক করে দিয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বিভিন্ন পর্যায়ে ভাইরাসের সংক্রমণ তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভাইরাসটি আবারও ছড়িয়ে পড়তে পারে।’
ডা. ফয়সাল আরও বলেন, ‘কোভিডের লক্ষণ আছে এমন অনেকেই পরীক্ষা করাচ্ছেন না এবং ধনীদের অনেকে বিদেশ ভ্রমণের জন্য এবং অন্যান্য কারণে করোনার সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য এটি করছেন। এতে করোনা পরীক্ষায় পজিটিভের চেয়ে নেগেটিভ প্রতিবেদন বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘অনেক সন্দেহভাজন করোনার রোগী শীতকালে জ্বর এবং কাশি জাতীয় উপসর্গগুলোকে মৌসুমি ফ্লু ভেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করিয়ে ও চিকিৎসা না নিয়ে বাড়িতে থেকেছেন। আর সে কারণেও অনেকের করোনা শনাক্ত হয়নি।’
র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট আরও বাড়ানো উচিত
ডা. ফয়সাল মনে করেন, ‘শীতকালে প্রয়োজনীয় পরীক্ষার অভাবে কোভিডের আসল চেহারা উঠে আসেনি। মানুষ পরীক্ষার বিষয়ে অনীহা দেখিয়েছে এবং সরকারও তাদের পরীক্ষা করতে উৎসাহ দিচ্ছে না। এটিকে ভালো লক্ষণ বলা যাবে না।’
মানুষকে টিকা দেওয়া হলেও তিনি বলেন, ‘সরকারকে পরীক্ষার সংখ্যা কমানো উচিত হবে না। আমাদের র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট বাড়াতে হবে এবং যে সব পর্যায়ে ভাইরাসটি এখনো বিরাজ করছে, সেসব ক্ষেত্রে আরও নজর দেওয়া উচিত।’
সতর্ক করে দিয়ে ডা. ফয়সাল বলেন, ‘প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে গেলে ভাইরাসের সংক্রমণ আবারও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেই সঙ্গে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে করোনার নতুন ধরনের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সে জন্য আমাদের এখানেও যে তা আসবে না সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না।’
প্রতি বছর দেখা দিতে পারে করোনা
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও বিএসএমএমইউয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ‘শীতপ্রধান দেশগুলোতে শীতকালীন আবহাওয়ার কারণে করোনাভাইরাস রয়ে গেছে।’
‘বাংলাদেশ উষ্ণমণ্ডলীয় দেশ। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হলো- শীতকালে তাপমাত্রা খুব কমই ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসে। তাই ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো বাংলাদেশে ভাইরাসটি তেমনভাবে ছড়াতে পারেনি’, বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘শীতের সময় স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দেওয়ায় এবং অনেকের শীতকালে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলা ও মাস্ক পরা ভাইরাসের সংক্রমণ কম হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করছে।’
ডা. আতিক বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষত গ্রামীণ এলাকার মানুষেরা কঠোর পরিশ্রম করায় এবং অন্য আরও অনেক স্থানীয় ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ এবং ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। তাদের বেশির ভাগই অ্যালকোহল পান করেন না।’
তিনি মনে করেন, ‘ইনফ্লুয়েঞ্জার সঙ্গে করোনাভাইরাসের মিল রয়েছে। যা প্রতিবছরই দেখা দিতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা দেওয়ার পরেও আমেরিকাতে প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার মানুষ মারা যায়। তাই আমাদের এই ভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, কারণ গণ টিকাদানের পরেও আগামী বছর ফের করোনা দেখা দিতে পারে।’
জীবনধারা ও খাবারের অভ্যাস
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান এমএইচ চৌধুরী (লেনিন) বলেন, ‘ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এ ভাইরাসটি কম মারাত্মক।’
তিনি বলেন, ‘ভৌগলিক এবং পরিবেশগত কারণে এবং দেশের মানুষের ভালো অভ্যাস এবং জীবনধারণের জন্য এমনটা হতে পারে। আমাদের দেশের মানুষ ইউরোপীয় দেশের তুলনায় ঠাণ্ডা খাবার কম খায় এবং সূর্যের আলোতে বেশি থাকে। আমাদের অনেকে কৃত্রিম আলো এবং শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করে না। তারা কঠোর পরিশ্রমও করে। আমি মনে করি, এ কারণগুলো তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও বেশি শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখেছে।’
‘অনেক দেশে যেখানে খুব মারাত্মকভাবে এ ভাইরাস আক্রমণ করেছিল সেসব দেশেও সংক্রমণের হার এক শতাংশে নেমে গিয়ে আবার বেড়েছে। তাই আমাদের দেশ শীতকাল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং টিকাদানের মাধ্যমে ভাইরাস থেকে মুক্তি পাচ্ছে এমনটি ভাবা উচিত হবে না। আমরা যদি আমাদের সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো কমিয়ে ফেলি তবে ভাইরাস সংক্রমণ হঠাৎ করেই ফের বাড়তে পারে’, মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু বিজ্ঞানী হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, বিভিন্ন দেশে শীতের শুরুতে প্রতিবছর করোনাভাইরাস ফের দেখা দিতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত এটা নিশ্চিত নয়, তবে করোনার অনেকগুলো নতুন ধরন দেখা দেওয়ায় আমরা এটিকে উপেক্ষা করতে পারি না।’
Comments