জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ একটি কাল্পনিক চরিত্র মাত্র: ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
লেখক ও গবেষক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা কথাসাহিত্যিক ইফফাত আরা। কর্মজীবনে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। অবসর নিয়েছেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক হিসেবে। এসবের বাইরে কবি জীবনানন্দ দাশের একনিষ্ঠ সাহিত্য গবেষক হিসেবে পেয়েছেন পরিচিত। ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জীবনানন্দ দাশের পঞ্চাশটি কবিতা।
তার ত্রিশটির অধিক প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধসমগ্র’ (১৯৯০), ‘জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র’ (২০১৫), এবং ‘রূপসী বাংলা মূলানুগ পাঠ’ (২০১৮) বিশেষভাবে সমাদৃত। তিনি রাজস্বনীতি, কর ফাঁকি ও চোরাচালানের অর্থ বিষয়ে কাজের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে প্রসিদ্ধ। তার গ্রন্থ corrupt Bureaucracy & Tax Enforcement (২০০৬) আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত প্রায় চল্লিশটি জার্নাল আর্টিকেল ও গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। বর্তমানে তিনি বইয়ে প্রচলিত কিন্তু, অভিধানে অসংকলিত এরকম এক হাজার শব্দের একটি কোষগ্রন্থ রচনার কাজে নিয়োজিত আছেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ‘জীবনানন্দ দাশের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সামগ্রিক বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন ফয়জুল লতিফ চৌধুরী।
জীবনানন্দ দাশ তার সমকালে দুর্বোধ্য এবং অজনপ্রিয় থাকলেও বর্তমানে জনপ্রিয়তার শীর্ষে, এর কারণ হিসেবে কোন বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করবেন?
আমার মনে হয়, জীবদ্দশায় কবি জীবনানন্দ দাশ যতটুকু দুর্বোধ্য ছিলেন এখনও তাই আছেন। তবে পাঠকের চরিত্র বদলে গেছে। এখনকার সাধারণ পাঠক শিক্ষিত বিশ্বপল্লীর নাগরিক। অন্যদিকে, সাধারণ পাঠক মনে করে জীবনানন্দ দাশ বাংলা ভাষার বড় কবি— তাকে পড়া দরকার। এ অবস্থা ১৯৪০’ বা ১৯৫০’ এর দশকে ছিল না।
জীবনানন্দের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য নিসর্গলিপ্তি। সাধারণ পাঠককে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে যখন জীবনানন্দ বলেন, ‘সকালে ঘুমের থেকে উঠে আমি চেয়ে দেখি/ নীলিমা গিয়েছে ভরে অনিবার পাখিদের ডানার আঘাতে’ কিংবা ‘কোনও এক গুলি এসে যখন হরণ করে নিতেছিল যুবকের পাখির মতন’। অন্যদিকে জীবনানন্দের কবিতায় এমনসব দৃশ্যপট একের পর এক নেমে আসে যা সাধারণভাবে কল্পনাতীত ও চমকপ্রদ। ধরুন- ১৯৪০’র ফেব্রুয়ারিতে লেখা একটি কবিতা যার শুরু এভাবে—
‘কেবলই সে দূরে চলে যেতেছিল—টিফিনকে অবসর মনে করে
অনন্তের মত রুমালে দু’-তিন স্লাইস পাউরুটি— একটি
কমলালেবু— চামচ তিনেক নুন নিয়ে—’
এ এক আশ্চর্যজনক গল্প নয় কী? এরকম সহস্র গল্প ছড়িয়ে আছে জীবনানন্দের কাব্যে যা মানুষের হৃদয়ে আবেদন সৃষ্টি করে। জীবনানন্দ তার কবিতায় শব্দ ও পদ সংস্থাপনার যে বিক্ষিপ্ত শৈলী অবলম্বন করেছেন তাতে কবিতার নিহিতার্থ সহসা বোধগম্য হয়ে ওঠে না—তবু কবিতার বিষয়বস্তু, অচিন্তনীয় শব্দাবলী, অদ্ভুত চিত্রকল্প পাঠককে স্পৃষ্ট করে। হয়তো পুরো কবিতাটি বোধগম্য হয়ে ওঠে না; যেমন সহজে বুঝে ফেলা যায় ‘দুই বিঘে জমি’ বা ‘১৪০০ সাল’,—কিন্তু জীবনানন্দের ‘বোধ’ কিংবা ‘অবসরের গান’ আমাদের চেতনাকে স্পৃষ্ট করে যায়। চারটি পঙক্তি শোনাই:
‘গভীর শীতের রাতে বিছানায় স্বপ্ন থেকে উঠে
রাজীব দেখিল তার ছারপোকা রক্ত—ক্লান্ত—ধূসর মশারি
জাবর কাটিছে যেন ঢের প্লুত অতীতের
সমস্ত শরীর তার ভিজে গেছে ধমনীয় ঘামে’
হয়তো একমত হবেন এ কবিতা বোঝার আগেই আমাদের অস্তিত্বে ঝংকার তুলে যায়।
জীবনানন্দ’র সমসাময়িক কবি বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তসহ আরও অনেকে সেই সময় শক্তিশালী ও জনপ্রিয় থাকলেও এখন তাদের সেভাবে পড়া হয় না। আমরা কেন তাদেরকে না পড়ে জীবনানন্দকে বেশি পড়ি? এক্ষেত্রে জীবনানন্দের সার্থকতা কোথায়?
ত্রিশের দশকে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল নানা আঙ্গিকে। কিন্তু, আধুনিক মানবচেতনার রূপটি সম্ভবত- কেবল জীবনানন্দ দাশই ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কবিতার করণকৌশলেও জীবনানন্দ ঐতিহ্যগত রীতি-প্রকরণের পরিবর্তে স্বকীয় কাব্যশৈলী অবলম্বন করেছিলেন। জীবনানন্দের আবির্ভাব ঘটেছিল অনাগত ভবিষ্যৎ থেকে— তার সতীর্থদের আবির্ভাব ঐতিহ্যের সুড়ঙ্গ পথে। কবিতা কেবল টেকনিক বা কাব্যশৈলীর বিষয় নয়। কবিতা কবির অন্তস্থ উপলব্ধিরও প্রতিফলন। জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘কোথাও দেখার মতো রয়ে গেছে কিছু?’—আমরা দেখি জীবনানন্দ নিজে বেশি দেখেছেন, পাঠককে বেশি দেখাতে পেরেছেন। বিষয়বস্তু, উপলব্ধি, শব্দচয়ন ও ছন্দ—সব মিলিয়ে যে জীবনানন্দীয় ভুবন তা একবিংশ চেতনার আধুনিক মানুষের স্মরণবেদীতে পরিণত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ যেন জীবনানন্দ দাশের কাব্যভাষার জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন। সতীর্থদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জীবনানন্দ নিজেও সচেতন ছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘উটপাখি’ এবং সমর সেনের ‘নাগরিক’ পড়ে জীবনানন্দ’র মনে হয়েছিল: তারা নিরেট সাংবাদিকতার দেওয়াল টপকে গেছেন মাত্র, ‘কিন্তু প্রজ্ঞাদৃষ্টি দিয়ে ভাবপ্রতিভাকে শুদ্ধ করে নিয়ে তেমন কোনো জীবনদর্শন সৃষ্টি করতে পারেননি, যাকে কবিতা বলা যায়।’
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে ভূমেন্দ্র গুহ, দেবীপ্রসাদ ও আবদুল মান্নান সৈয়দসহ আরও অনেকের কাজ উল্লেখযোগ্য। তাদের পরম্পরায় আপনার কাজের বৈশিষ্ট্যগুলো কী? জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে আপনার মৌলিক কাজ কোনগুলো?
কবি জীবনানন্দ দাশের আবির্ভাব, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সংরক্ষণ করেছেন দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া, তিনি জীবনানন্দ দাশের গ্রন্থিত ও অগ্রন্থিত কবিতাবলীর সংকলনও প্রকাশ করেছেন। কবি ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দ দাশের পাণ্ডুলিপি থেকে প্রায় ১৬৫০টি কবিতার পাঠোদ্ধার করেছেন। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর অব্যবহিত ২-৩ বছরে তিনি ‘রূপসী বাংলা’ ও ‘কবিতার কথা’ গ্রন্থদ্বয়ের মুদ্রণযোগ্য পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন করেছিলেন। জীবনানন্দের কাব্য আলোচনায় বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অম্বুজ বসু, অশোক মিত্র, দীপ্তি ত্রিপাঠী, বাসন্তীকুমার স্যানাল প্রমুখের অবদান বড় মাপের। একই ধারায় পূর্ববঙ্গ থেকে আবদুল মান্নান সৈয়দ জীবনানন্দের কাব্য আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন ১৯৭৩-এ ‘শুদ্ধতম কবি’ বই দুটি প্রকাশ করে। এরপরও তিনি আমৃত্যু জীবনানন্দকে নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে পিএইচডি করেছেন ক্লিনটন বি. সিলি। তার গবেষণা সন্দর্ভ ‘আ পোয়েট আপার্ট’ নামে প্রকাশ করেছেন। এটি জীবনানন্দ দাশের একটি নির্ভরযোগ্য সাহিত্যিক জীবনী। আমার বৈশিষ্ট্য এটুকু যে, ১৯৮৯ সালে আমি জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধগুলো প্রকাশের উদ্যোগ নিই—১৯৯০ এর বইমেলায় প্রকাশিত হয় ‘জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ সমগ্র’। ১৯৯৯-এ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করি ‘জীবনানন্দের অগ্রন্থিত প্রবন্ধাবলী’। এ বই দুটির মধ্য দিয়ে প্রাবন্ধিক জীবনানন্দের সঙ্গে পাঠকের পরিচয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। জীবনানন্দের পরিচিত কবিতাগুলোর দুটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছি—১৯৯৪ সালে Poems of Jibanananda Das Ges এবং ২০০৬ সালে Beyond Land and Time। ২০১৫ সালে প্রকাশ করি ‘জীবনানন্দের চিঠিপত্র’—একশতাধিক চিঠির সংকলন। সম্প্রতিকালে প্রকাশ করেছি জীবনানন্দের কবিতার শুদ্ধপাঠ। জীবনানন্দকে নিয়ে অনেক কাজ করার আছে। আমি সাহিত্যকর্মী, সাহিত্য আমার কাছে শখ। শখের জন্য সময় বের করা মুশকিল। জীবনানন্দ দাশের ২৩টি ইংরেজি প্রবন্ধ নিবন্ধের সংকলন ‘On Language and literature’ নামে প্রকাশ করার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। কিন্তু, সে তো ২০১৬ সালের কথা, এ বছর প্রকাশ করার চেষ্টা করছি।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার শুদ্ধ পাঠ বলতে আপনি কী বোঝাতে চেয়েছেন?
জীবনানন্দ দাশের কবিতার বহুল প্রচারিত তিনটি বই যথা ‘মহাপৃথিবী’, ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ এবং ‘রূপসী বাংলা’-র শুদ্ধ পাঠ প্রণয়ন করেছি। আমার কাছে জীবনানন্দের প্রায় এক হাজার কবিতার পাণ্ডুলিপি চিত্র রয়েছে। সেগুলোর সাহায্য নিয়েছি, জীবনানন্দের বানান ও যতিচিহ্ন রীতি অনুসরণ করেছি। বাদ পড়ে যাওয়া শব্দ সংযোজন করেছি। ‘রূপসী বাংলা’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে, প্রকাশক ছিল কলকাতার সিগনেট প্রেস। এ বইয়ের মুদ্রণ সম্পাদক ছিলেন কবি নরেশ গুহ। তিনি অনেক বেশি স্বাধীনতা নিয়েছিলেন। অনেক শব্দ বাদ দিয়েছিলেন। অনেক শব্দ যোগ করেছিলেন। মূল পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করা হয়েছে। আপনাকে একটি উদাহরণ দেই: ৫৭ সংখ্যক কবিতার দ্বাদশ পঙ্ক্তিটি পাণ্ডুলিপিতে জীবনানন্দ দাশ কর্তৃক লিখিত হয়েছে ‘এখুনি আসিবে সন্ধ্যা,—পৃথিবীতে গোধূলি নামিলে’ এভাবে। সিগনেট সংস্করণে পাঠক পড়বেন: ‘এখুনি আসিবে সন্ধ্যা,—পৃথিবীতে ম্রিয়মাণ গোধূলি নামিলে’। ‘পৃথিবীতে’ শব্দের পর ‘ম্রিয়মাণ’ শব্দটি অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে সিগনেট সংস্করণে।
একইভাবে প্রবন্ধের বই ‘কবিতার কথা’রও একটি শুদ্ধ পাঠ করে দিয়েছি, বাংলা একাডেমী তা প্রকাশ করেছে ২০১৮-তে।
জীবনানন্দ দাশকে কবিতা ও কথাসাহিত্য ছাড়া আর কীভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব?
জীবনানন্দ দাশ মূলত কবি। তবে তিনি ২১টি উপন্যাস ও ১২৮টি ছোটগল্পও লিখেছেন। এর বাইরে যা থাকে সে হলো ব্যক্তি জীবনানন্দ। জীবনানন্দের দিনলিপির ৫৭টি খাতায় মানুষ জীবনানন্দকে আবিষ্কার করা যায়; তবে তা জরুরি নয়। কবিতায় ব্যক্তি জীবনানন্দের কোনো ছাপ নেই; যদিও তার কথাসাহিত্য অনেকাংশে আত্মজৈবনিক। ‘বনলতা সেন’ প্রকৃতপক্ষে কে ছিলেন কিংবা ‘মাল্যবান’ বস্তুত জীবনানন্দের জীবনী কিনা এসব প্রশ্ন সাহিত্যকৃতি শিল্পরূপ নির্ণয়ে বাধাস্বরূপ। ব্যক্তি জীবনানন্দের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ রয়েছে। তার অধিকাংশ দিনলিপিগুলো ইংরেজিতে। এগুলোর কিছু কিছু পাঠোদ্ধার হয়েছে, বাকিগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
আকবর আলী খান তার বইয়ে লিখেছেন ‘বনলতা সেন’ ছিলেন নাটোরের একজন বারবনিতা। আপনার মতামত কী?
জীবনানন্দের কবিতায় অনেক নারীবাচক নাম রয়েছে। ‘বনলতা সেন’ সে রকম একটি কাল্পনিক নারীচরিত্র, না-কি রক্তমাংসের মানুষ তা নিশ্চিতভাবে বলার সুযোগ নেই। ড. আকবর আলী খান তার অভিজ্ঞতা ও তার নিকটলভ্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। সেটা মেনে নেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত ‘বনলতা সেন’ একটি কাল্পনিক চরিত্র মাত্র।
আপনি জীবনানন্দ দাশের কবিতা অনুবাদ করেছেন। একজন দুর্বোধ্য কবির কবিতা বিদেশী ভাষায় অনুবাদ কি চ্যালেঞ্জিং বিষয় নয়?
অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সুবোধ্যতার অভাবে জীবনানন্দের একটি কবিতা ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদকের হাতে ভিন্ন ভিন্ন অর্থব্যঞ্জনা নিয়ে অনূদিত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে যে কবিতা আমার কাছে একশত ভাগ বোধগম্য হয়নি, তা আমি অনুবাদ করিনি। তাছাড়া destination language-র ওপর থাকতে command থাকতে হয়। বাঙালি অনুবাদকের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। জীবনানন্দের কবিতার প্রথম অনুবাদক কবি নিজে। ব্রিটিশ মার্টিন কার্কম্যান চল্লিশের দশকে তার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। এরপর ম্যারী ল্যাগো, এডওয়ার্ড ডিমক প্রমুখ কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিল। ক্লিনটন বুথ সিলি অনেক কবিতা অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ সবচেয়ে ভালো ফলেছে ব্রিটিশ কবি জো উইন্টারের হাতে। তিনি একজন কবি বলে জীবনানন্দের কবিতার মর্মমূলে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। সম্প্রতি বয়সে তরুণ কোনো কোনো প্রবাসী বাঙালি অনবদ্যভাবে জীবনানন্দকে অনুবাদ করেছেন; source language I destination language-উভয়ের ওপর তাদের দক্ষতার কারণে।
একটি পুরনো প্রশ্ন করি- ট্রাম দুর্ঘটনায় জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু কি আত্মহত্যা ছিল?
আয়পত্র না থাকায় জীবনানন্দকে বছরের পর বছর অনাহারে অর্ধাহারে জীবন কাটাতে হয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দাম্পত্য জীবনের অচরিতার্থতার গ্লানি। তাই কবির মৃত্যুকে অনেকে আত্মহত্যা বলে ভাবতে পছন্দ করেন। এ কথা ঠিক জীবনানন্দ অনেক বার আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন। কীভাবে আত্মহত্যা করা সবদিক দিয়ে সুবিধাজনক এসব কথাও দিনলিপিতে সবিস্তারে লিখেছেন। কিন্তু, কখনো আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেননি। ১৯৫০-এর শুরু থেকেই দীর্ঘ দিনের অনাহার, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপসহ নানা অসুখ তিনি বিপর্যস্ত ছিলেন। চোখের দৃষ্টিশক্তিও হ্রাস পেয়েছিল। সুচিকিৎসার সঙ্গতি ও ব্যবস্থা ছিল না। নানা কারণে তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকতেন—অন্যমনস্কভাবে তিনি ট্রাম লাইনের কাছে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু, আত্মহত্যার উদ্দেশে নয়। দুহাতে চারটি ডাব ঝুলিয়ে নিয়ে কেউ আত্মহত্যা করতে যায় না।
ভারত ভাগের সময় জীবনানন্দ দাশ কেন বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় গেলেন?
১৯৪৬ সালে জীবনানন্দ দাশ বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় যান। দীর্ঘ ছুটি নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তখন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। কলকাতায় গিয়েছিলেন বিকল্প চাকরির সন্ধানে। ১৯৪৬-এ দাঙ্গার কারণে তিনি বরিশাল ছেড়ে গেছেন—এরকম অনুমান সঙ্গত হবে না। কলকাতা ছিল বাংলা সাহিত্য চর্চার প্রাণকেন্দ্র। জীবনানন্দ সাহিত্য চর্চার প্রাণকেন্দ্রে স্থিত হয়ে গিয়েছিলেন । ১৯৪৭-এ তিনি নব প্রবর্তিত ‘স্বরাজ’ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্মানজনক চাকরি পেয়ে যান। কিন্তু, আগস্টে তার চাকরি চলে যায়। এরপর তিনি খুব কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু, কখনো আর কলকাতা ছেড়ে বরিশালে প্রত্যাবাসনের কথা ভাবেননি। কবি জীবনের শুরু থেকেই তিনি কলকাতায় বসবাস করতে চেয়েছেন।
জীবনানন্দের আমরা বিশেষ কিছু বিখ্যাত কবিতা বা বই পাঠ করে থাকি। আপনি আপনার লেখায় উল্লেখ করেছেন জীবনানন্দর কবিতার সংখ্যায় প্রায় আড়াই হাজার (২৫০০)। তার কবিতা পাঠের ব্যাপারে আপনার নির্দেশনা কী?
জীবনানন্দ তার জীবনে কমপক্ষে আড়াই হাজার কবিতা রচনা করেছিলেন। তার কন্যা মঞ্জুশ্রী’র হেফাজত থেকে অনেক কবিতার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়ায় নিশ্চিত হওয়া কঠিন জীবনানন্দ কতগুলো কবিতা লিখেছিলেন।
জীবনানন্দের কাব্যগ্রন্থগুলোর কাটতি বেড়েছে। কিন্তু ‘আবার আসিব ফিরে’, ‘বনলতা সেন’, ‘আট বছর আগে একদিন’ এরকম ১০-১৫ টি কবিতার বেশি সাধারণ মানুষ পড়ে না এ কথা হয়তো পৃথিবীর সব কবিদের ক্ষেত্রেই বলা চলে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশই পৃথিবীর একমাত্র বিরল কবি যার দুর্বল কবিতা নেই বললেই চলে। সে অর্থে জীবনানন্দ বহুলাংশে অপঠিত তার স্বল্প প্রচারিত কবিতাসমূহে এমনসব কবিতা রয়েছে যেগুলো বিশ্বসাহিত্যে অবিস্মরণীয়। এসব পাঠ করার আহ্বান জানাই।
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কী কাজ বাকি?
জীবনানন্দের বহু কবিতা রয়েছে যা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা দরকার। আমি সম্প্রতি ১১৭টি কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছি ‘সূর্য-অসূর্যলো’ নামে। অসাধারণ সব কবিতা। রচনাসমগ্র মানুষ কেনে ও সাজিয়ে রাখে। পড়ার উপযোগী কবিতার বই ১৫০ থেকে ২৫০ পাতার মধ্যে হওয়া দরকার। জীবনানন্দের কবিতা লেখার যে ৪৮টি খাতা কলকাতায় অবস্থিত ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগারে রয়েছে তার মধ্যেও এরকম কবিতা রয়েছে যেগুলো পাঠোদ্ধারের অপেক্ষায় আছে। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই এ কাজগুলো করে ফেলা দরকার।
আমাদের অনেকে আপনাকে জীবনানন্দের গবেষক হিসেবে জানে। এর বাইরে আপনার কাজ সম্পর্কে জানতে চাই-
আমার সাহিত্যচর্চা খণ্ডকালীন শখ। সাহিত্য সমালোচনা আমার প্রিয় বিষয়। বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ করেছি। এমনকি চটি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা-সন্দর্ভ লিখেছি, ‘চটি সাহিত্যের পূর্ব পশ্চিম’। বাংলা ভাষার অভিধানে শব্দ সংগ্রহ সীমিত। লেখকদের উপন্যাস-প্রবন্ধে হাজার হাজার শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যেগুলো কোনো অভিধানে সংকলিত হয়নি। আমি এরকম এক হাজার শব্দের একটি অভিধান রচনা করেছি নমুনা হিসেবে। দুর্নীতি নিয়ে আমার একটি গ্রন্থ রয়েছে ‘Corrupt bureaucracy and privatization of Customs in Bangladesh’; এটি একটি সেমিনাল কাজ। ‘Market In Corruption’ নামে দুর্নীতির বাজার নিয়ে একটি গ্রন্থ লিখছি। আমার আর তেমন কোনো উচ্চাকঙ্খা নেই। তবে, একটি উপন্যাস লেখা শেষের পথে। হয়তো অচিরেই জীবনানন্দ পর্ব চুকিয়ে কথাসাহিত্যে মনোযোগ দিব।
Comments