ভিন্ন স্বাদের ছবি মেলা
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/chobi_mela_1.jpg?itok=sQGwA5QN×tamp=1613725849)
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ফটোগ্রাফি উৎসব ‘ছবি মেলা’ শুরু হয়েছে গত ১২ ফেব্রুয়ারি। পান্থপথের দৃকপাঠ ভবনে শুরু হওয়া এ উৎসব চলবে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
গত দুই দশকে ‘ছবি মেলা’র ১০টি আসর বসেছে। তবে এবারের আয়োজন– ছবি মেলা শূন্য– ১১তম ‘ছবি মেলা’ নয়। এটি উৎসবের একটি বিশেষ সংস্করণ। এবারের আয়োজনও তাই আগেরগুলোর চেয়ে অনেকটাই আলাদা।
করোনা মহামারির বাস্তবতায় এবারের আয়োজন কিছুটা সীমিত পরিসরে হচ্ছে। তবে এর মধ্যেই বৈচিত্র্য ও বহুমাত্রিক শিল্পচর্চার সমন্বয় লক্ষণীয়। অন্যান্য দেশের শিল্পীরা এবার সরাসরি অংশ নিতে পারেননি। স্বশরীরে দর্শকের উপস্থিতিও থাকছে সীমিত।
তবে একই সঙ্গে ডিজিটাল উপায়ে ভার্চুয়াল প্রদর্শনী ও অন্যান্য অনলাইন আয়োজনের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি দর্শকের কাছে উৎসবটি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/news/images/chobi_mela_3.jpg?itok=Uh5yFfzT×tamp=1613725919)
ছবি মেলা শূন্য– মূল থিম
শূন্য একটি সংখ্যা, আবার একটি বাংলা শব্দও। এটি বোঝাতে পারে শূন্যস্থান। আবার শূন্য থেকে শুরু করার অর্থ দাঁড়ায় নতুন করে শুরু করা।
বৈশ্বিক মহামারির বাস্তবতায় ছবি মেলা শুরুতে ফিরে গিয়ে আবার সবকিছু নতুন করে দেখতে চায়। এবারের উৎসবের উদ্দেশ্য তাই নিজেদের পুনর্মূল্যায়ন করা ও দুর্যোগকালে আমাদের জীবনে শিল্পের প্রাসঙ্গিকতাকে পুনর্বিবেচনা করা।
চলমান এই সংকটে মানুষের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার ব্যর্থতাগুলো আরও স্পষ্ট হয়েছে। এই সংকট আমাদের নিজেদের ও পাশের মানুষজনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। ভিন্নরকম এই ছবি মেলা দেখতে চায়— বিভেদের এই সময়ে শিল্প কিভাবে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং বৈচিত্র্যকে স্বাগত জানায়।
এই মহামারিতে আমরা শারীরিক উপস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছি। তাই শিল্পচর্চাতেও এখন ভার্চুয়াল পরিসরটি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
‘ছবি মেলা শূন্য’ বাস্তব ও ভার্চুয়াল পরিসরকে সমন্বয় করেছে। প্রচলিত শিল্পমাধ্যমগুলোকে তাদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কাজেও উৎসাহিত করেছে।
কী আছে ছবি মেলায়?
নবনির্মিত দৃকপাঠ ভবনের প্রায় পুরোটাই নানা আয়োজনে ভরপুর। মোট আটটি কিউরেটেড প্রদর্শনীতে দেশ-বিদেশের মোট ৭৫ শিল্পীর কাজ রয়েছে। ভবনের ছাদ, সিঁড়ি, পার্কিং, ক্লাসরুম ও লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন জায়গা সৃজনশীলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে শিল্পকর্ম প্রদর্শনের জন্য।
প্রদর্শনী ছাড়াও উৎসবের অন্যান্য আয়োজনের মধ্যে আছে শিল্পীদের সঙ্গে কথোপকথন, গান, পডকাস্ট, গ্যালারি ওয়াক, স্লাইড শো, চলচিত্র প্রদর্শনী, শিল্প-সংস্কৃতিবিষয়ক বইয়ের পসরা ও একটি কফি কর্নার।
দুটি গুরুত্বপূর্ণ রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনী আছে এবারের ছবি মেলায়। একটি সদ্যপ্রয়াত আলোকচিত্রী সাঈদা খানমের প্রদর্শনী ‘দ্য রেবেল উইথ এ স্মাইল’। এক দল গবেষক দীর্ঘদিন ছবি সংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণ করেছেন এই প্রদর্শনীর জন্য। দর্শকরা এখানে সাঈদা খানমের অনেক না-দেখা ছবি দেখতে পাবেন।
দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী হওয়া ছাড়াও একজন শক্তিশালী পোট্রেট ফটোগ্রাফার ও ফটোসাংবাদিক হিসেবে তার গুরুত্ব নতুন করে উপলব্ধি করা যায় এই প্রদর্শনী দেখলে। একই সঙ্গে তার জীবনের নানা মুহূর্তের ছবি ও তার ব্যক্তিগত, চিঠি, ছবির নেগেটিভ ইত্যাদির মাধ্যমে সাঈদা খানমকে আরও অন্তরঙ্গভাবে অনুভব করতে পারবেন দর্শকরা।
দ্বিতীয় প্রদর্শনী— ‘উইশিং ট্রি’ সদ্যপ্রয়াত স্বনামধন্য স্থপতি ও দৃকপাঠ ভবনের নকশাকার বশিরুল হকের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। এতে তার করা নকশার অনুলিপি ও অন্যান্য জিনিস ছাড়াও বেশকিছু ভবনের মিনিয়েচার মডেল রয়েছে।
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/news/images/chobi_mela_2.jpg?itok=-tmmG6i2×tamp=1613725973)
সবচেয়ে বড় দলগত প্রদশনীটির নাম ‘অফ লিমিটস’। এতে দক্ষিণ এশিয়ার ১৪ শিল্পীর ফটোগ্রাফিসহ নানা ইনস্টলেশন রয়েছে। এই কাজগুলোর বিষয়বস্তু হিসেবে রয়েছে— কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন আন্দোলন, সিলেটের এথনিক গ্রুপ, বর পরং নামের নৃগোষ্ঠী বইয়ের পাঠ, নেপালের পাহাড়ের কমিউনিটি ও পাকিস্তানের আহমদীয়াদের সমম্যা ইত্যাদি। এ ছাড়া আছে বাংলাদেশি শিল্পী মাহমুদ হোসেইন অপু, সালমা আবেদীন পৃথি, সমারী চাকমা ও নাঈম মোহায়েমনসহ অন্যদের করোনা মহামারির ওপর করা কাজ।
বরাবরের মতো এবার বৃত্তি দেওয়া হয়েছে ১৪ শিল্পীকে। তাদের কাজ নিয়ে একটি প্রদর্শনীর নাম ‘বোধ’। নামটি দেওয়া হয়েছে জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’ কবিতার অনুপ্রেরণায়। নাজমুন নাহার কেয়ার কিউরেশনে ‘ফ্রোজেন সং’ প্রদর্শনীতে বিভিন্ন প্রজন্মের পাঁচ শিল্পী— দিলারা বেগম জলি, ইফফাত রেজওয়ানা রিয়া, জুয়েল এ রব, প্রমথেশ দাস পুলক ও রিয়াজ রহমান দৃকপাঠ ভবনের বিভিন্ন স্থানের বৈচিত্র্যকে ব্যবহার করে নানা ধরনের কাজ প্রদর্শন করছেন।
সুইস শিল্পী-গবেষক মারা জুস্টের সঙ্গে পাঠশালার গবেষণা ও কর্মশালার অংশ হিসেবে থাকছে ‘ছাপাখানা আর্কাইভ’। এই প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের ছাপাখানার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ওঠে এসেছে।
এছাড়া, ‘ছবি মেলা শূন্য’তে দৃক ও পাঠশালার বিশেষ আয়োজন ছিল ১২ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আরও ছিল বিভিন্ন ফটোগ্রাফি স্কুলের সঙ্গে পরিচিতি ও সংহতি, ফটোসাংবাদিকদের কাজের অভিজ্ঞতা, নারী সাংবাদিক ও শিল্পীদের করোনাকালের অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আড্ডা।
হারিয়ে যাওয়া মহল্লা-ভিত্তিক স্টুডিওর আলোকে আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনের পাপ্পু ‘স্টুডিও’ নামে অস্থায়ী স্টুডিও ছিল ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে।
আনোয়ার হোসেন ছবি মেলায় তার কাজের অভিজ্ঞতা ও কাজের ধারার পরিবর্তন নিয়ে কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি আগ্রহীদের ছবি তুলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রিন্ট করে দেন।
যা কিছু নতুন
ভিন্ন মাত্রার এই ছবি মেলায় বেশকিছু বিষয় প্রথমবারের মতো যোগ করা হয়েছে। সেগুলো হলো:
১. এবার ছবি মেলা বিশেষভাবে নিজ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে নজর দিয়েছে। ফলে এবার সম্পূর্ণ উৎসবটি করা হয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল ও পাকিস্তান— দক্ষিণ এশিয়ার এই পাঁচটি দেশের শিল্পীদের অংশগ্রহণে।
২. প্রদর্শনীগুলো এবার দর্শকরা ‘ভার্চুয়াল রিয়ালিটি’তে দেখতে পাবেন। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে এটি দেখা যাবে ছবি মেলার ওয়েবসাইট www.chobimela.org-এ।
৩. ‘বাবা বেতার’ নামের অনলাইন রেডিওটি এবার এক অভিনব সংযোজন। শিল্পী আরফান আহমেদের এই প্রজেক্টে শিল্পী, সাহিত্যিকসহ অনেক মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন। এই বেতারের সম্প্রচার শোনা যাবে ছবি মেলার ওয়েবসাইটে।
৪. প্রথমবারের মতো চারটি ‘আর্ট কালেক্টিভ’-কে উপস্থাপন করা হয়েছে এবারের ছবি মেলায়। এগুলো হলো বাংলাদেশের জোগ আর্ট স্পেসের চেরাগী আর্ট শো, দাগী আর্ট গ্যারেজ, ছয় নারী আলোকচিত্রীর কালী কালেক্টিভ ও শ্রীলংকার কলোম্বোস্কোপ।
পারস্পরিক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে তৈরি হওয়া এই কাজগুলোর মধ্যে সংহতি, বোঝাপড়া, ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের ছাপ খুঁজে পাবেন দর্শকরা।
৫. পাঠশালার নতুন ওয়েবসাইট pathshalainstitute.org - এর উদ্বোধন করা হয় এবারের ছবি মেলায়।
৬. এবারের ছবি মেলায় আলোকচিত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন মাধ্যমের সমন্বয় করা হয়েছে অনেক বেশি।
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/news/images/chobi_mela_4.jpg?itok=xKdjvsK0×tamp=1613726053)
কিউরেটরের চোখে
ছবি মেলায় শূন্যর মূল কিউরেটর তিনজন হলেন এ এস এম রেজাউর রহমা, তানজিম ওয়াহাব, ও সরকার প্রতীক। এছাড়াও, অতিথি কিউরেটর হিসেবে কাজ করেছেন আনুশকা রাজেন্দ্রান, নাজমুন নাহার কেয়া ও জিহান করিম।
ছবি মেলার আয়োজকদের মতে, শিল্পীর শিল্পচর্চা বা নাগরিকের সুস্থ জীবনধারণের জন্য একটি গণতান্ত্রিক আবহ থাকা খুব জরুরি। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়েই গণতান্ত্রিক চেতনা নানাভাবে হুমকির মুখে রয়েছে। এবারের ছবি মেলায় কিউরেটর ও শিল্পীরা চেষ্টা করেছেন শিল্পচর্চার মাধ্যমে একটি ‘পারফরমেটিভ ডেমোক্রেসির’ ধারণা তৈরি করতে— যা বাস্তবে গণতন্ত্রচর্চা নিয়ে ভাবাবে।
করোনা মহামারি শুরুর আগে ও পরে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ছোট ছোট অনেক আন্দোলন হয়েছে যেগুলো গণতন্ত্র ও গণমানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যখাত নিয়ে চলমান উদ্বেগ সেসব বিষয় থেকে সবার মনোযোগ কিছুটা সরিয়ে দিয়েছে। ‘ছবি মেলা শূন্য’র মাধ্যমে কিউরেটরা চেয়েছেন এই গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক আন্দোলন ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিতর্কগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে। একইসঙ্গে চলমান মহামারি নিয়ে দক্ষিণ এশীয় শিল্পীদের সমসাময়িক ভাবনা ও জীবনযাপনকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, এবার তরুণ শিল্পীদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি তাদের শিল্পচর্চার ক্ষেত্র তৈরিতে সহায়ক হবে বলে আশা করছেন কিউরেটররা।
ঘুরে আসুন ছবি মেলা
শিল্পবোদ্ধা বা সাধারণ দর্শক – সবার জন্যই ছবি মেলা বছরের পর বছর একটি আগ্রহের জায়গা তৈরি করে রেখেছে। ‘ছবি মেলা শূন্য’ মানুষকে একটি অন্য রকম অভিজ্ঞতা দেবে। এটি সবার ভাবনার খোরাক যোগাবে। তাই শেষ হওয়ার আগেই দেখে আসুন ছবির এই মহোৎসবটি।
ছবি: ছবি মেলার সৌজন্যে
Comments