‘পাবনায় ভাষা আন্দোলনের বীজ বপন হয়েছিল ১৯৪৮ সালে’
১৯৫২ সালে ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে যখন ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলন চলছে, তখন পাবনার ভাষা সংগ্রামীদের অনেকই ছিলেন কারারুদ্ধ। তারপরও ঢাকায় জনতার ওপর পাকিস্তানি পুলিশের গুলির সংবাদ পৌঁছানো মাত্রই পাবনার ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসেন।
পাবনায় মাতৃভাষার জন্যে আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। সে বছর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি সংসদে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় বিক্ষোভ। সে বিক্ষোভ গণ-আন্দোলনের রূপ নেয় তৎকালীন পাবনায়।
পাবনায় ভাষা আন্দোলন সংগঠনিক রূপ নেয় ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। প্রায় ৭০ বছর পরও পাবনার ভাষা সংগ্রামীদের অধিকাংশই পাননি কোনো স্বীকৃতি।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সংসদে বাঙালি সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানালে লিয়াকত আলি এর বিরোধিতা করেন।
পাকিস্তানের সংসদে বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করলে পাবনাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে শুরু হয় বিক্ষোভ। সে বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাবনার তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা দেওয়ান লুৎফর রহমানের বাসায় বৈঠকে বসেন আন্দোলনকারীরা। সিদ্ধান্ত হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি পাবনা টাউন হল মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
বিদ্ধন্ত অনুযায়ী ২৭ ফেব্রুয়ারি টাউন হল মাঠে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবাদ সভায় বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি উঠে। গঠন করা হয় ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।
দেওয়ান লুৎফর রহমানকে আহ্বায়ক করে এবং তৎকালীন বামপন্থি নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা ও মাহাবুবুর রহমান খানকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এখান থেকেই পাবনায় ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ১৯৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাবনায় হরতাল আহ্বান করে। আন্দোলনকারীদের দমন করতে পাবনা জেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৪৪ ধারা ভেঙে আন্দোলনকারীরা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মুহূর্তেই মিছিলটি গণমিছিলের রূপ নেয়।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, তা না হলে ছাড়া নাই’— এই স্লোগান ওঠে পাবনায়। মিছিলটি শহরের দিকে এগুতেই পুলিশ লাঠিচার্জ করে তা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সেসময় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’র নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশাসহ প্রায় ৪০ আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃতদের জেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীরা পাবনা জেলখানার সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন এবং গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্ত না করা পর্যন্ত জেলগেটে অবস্থান নেন।
বিক্ষোভের মুখে গ্রেপ্তারকৃতদের সবাইকে সন্ধ্যায় জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।
এদিকে, পাবনায় সারাদিন স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়।
সন্ধ্যায় জামিনে মুক্তি পেলেও গভীর রাতে পুলিশ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা দেওয়ান লুৎফর রহমান, আমিনুল ইসলাম বাদশা, মাহাবুবুর রহমানসহ সংগ্রাম পরিষদের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের আবারও গ্রেপ্তার করে।
পাবনার ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রনেশ মৈত্র দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘৪৮-এর ভাষা সংগ্রামীদের বেশিরভাগই রাজবন্দি হয়ে দীর্ঘদিন কারা ভোগ করেন। আন্দোলনের মূল নেতৃবৃন্দদের গ্রেপ্তার করায় প্রকাশ্য আন্দোলনে অনেকটা ভাটা পড়লেও তা বন্ধ হয়ে যায়নি। ভেতরে-ভেতরে ছাত্র-জনতাকে ভাষা সংগ্রামের জন্য সংগঠিত করার কাজ চলে।’
‘১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার রাজপথ যখন উত্তাল হয়ে ওঠে তখন পাবনাতেও ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে। ঢাকার ঘটনা শোনার পর আমরা সেদিন চোঙ্গা ফুঁকে পরদিন মিছিলের ডাক দিই। মুহূর্তেই সে মিছিল গণমিছিলের রূপ নেয়।’
‘ভাষার জন্য পাবনার মানুষের এ আন্দোলনের বীজ বপন হয়েছে ১৯৪৮ সালে,’ যোগ করেন এই ভাষাসৈনিক।
ভাষা আন্দোলনে পাবনার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থাকলেও এখনো স্বীকৃতি মেলেনি জেলার অধিকাংশ ভাষা সংগ্রামীর। ১৯৫২ সালের ভাষাসৈনিকদের কয়েকজন বেঁচে থাকলেও ১৯৪৮ সালের ভাষা সংগ্রামীদের কেউই আজ বেঁচে নেই। পাবনার ভাষা সংগ্রামীদের মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষাসৈনিক রনেশ মৈত্র ও ১৯৪৮ সালের ভাষাসৈনিক আমিনুল ইসলাম বাদশা (মরণোত্তর) একুশে পদকে ভূষিত হলেও এখনো পাবনার অনেক ভাষাসৈনিকের স্বীকৃতি মেলেনি।
১৯৪৮ সালের ভাষাসৈনিক আমিনুল ইসলাম বাদশার ছোটভাই রবিউল ইসলাম রবি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেয়েছি। তবে এর বীজ বোপন করা হয়েছিল ১৯৪৮ সালেই। পাবনার ভাষা সংগ্রামীরা সে সময় জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করলেও কেউই তাদের জীবদ্দশায় ভাষা সংগ্রামী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি।’
‘ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৭০ বছর পরও এখনো পাবনার ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা হয়নি।’
একজন ভাষা সংগ্রামীর পরিবারের সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৪৮ সালের ভাষা সংগ্রামী ও ১৯৫২ সালের ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা তৈরি করে তাদের অবদান আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার দাবি জানান।
বলেছেন, ‘এখনই উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আজানাই থেকে যাবে এসব ভাষা সংগ্রামীদের কথা।’
Comments