শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাধারণে অসাধারণ সৈয়দ আবুল মকসুদ

মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিট। হঠাৎ মোবাইলে কল। নাসিফ মকসুদের ফোন। খ্যাতিমান কলামিস্ট, গবেষক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের একমাত্র ছেলে নাসিফ। মকসুদ ভাই একান্ত প্রয়োজন না হলে মুঠোফোন এড়িয়ে চলতেন। শুধু মুঠোফোন বলে নয়, বাস্তবে তিনি কতটা সাধারণ জীবনযাপন করতেন সেটা খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না। সব ধরনের বিলাসিতা এড়িয়ে চলতেন তিনি। সেলাইবিহীন সাদা চাদর পরে ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে তিনি ছুটতেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সবসময় ভাবতেন দেশ আর মানুষ নিয়ে।
Sayed Abul Moksud.jpg
স্কুল পড়ুয়াদের সঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদ। ছবি: কোয়ান্টাম মেথডের কসমস স্কুলের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিট। হঠাৎ মোবাইলে কল। নাসিফ মকসুদের ফোন। খ্যাতিমান কলামিস্ট, গবেষক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের একমাত্র ছেলে নাসিফ। মকসুদ ভাই একান্ত প্রয়োজন না হলে মুঠোফোন এড়িয়ে চলতেন। শুধু মুঠোফোন বলে নয়, বাস্তবে তিনি কতটা সাধারণ জীবনযাপন করতেন সেটা খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না। সব ধরনের বিলাসিতা এড়িয়ে চলতেন তিনি। সেলাইবিহীন সাদা চাদর পরে ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে তিনি ছুটতেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সবসময় ভাবতেন দেশ আর মানুষ নিয়ে।

সাংবাদিকতা ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলন থেকে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আবুল মকসুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে তিনি বাসার টেলিফোন থেকেই ফোন করতেন। যে বিষয় নিয়ে লিখতেন সেই বিষয়ের সঙ্গে আমার যদি কখনো যোগসূত্রতা থাকতো বিশেষ করে প্রবাসী, তারুণ্য, ছাত্র রাজনীতি, বিশ্ববিদ্যালয়, কোটা সংস্কার ইত্যাদি বিষয় হলে অনেকক্ষণ কথা বলতেন। নিজের ছেলের মতোই আদর করতেন আমাকে। খুব জরুরি প্রয়োজন হলে নাসিফের নম্বর থেকে ফোন দিতেন।

কাজেই নাসিফের ফোন আসা মানেই ধরে নিতাম সৈয়দ আবুল মকসুদের ফোন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাই কথা বলার চেষ্টা করতাম। এমনি একটা ফোন ছিল মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। নাসিফের নম্বর দেখে রিসিভ করে ‘সালাম, মকসুদ ভাই’, বলতেই ওই পাশ থেকে প্রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে উত্তর, ‘হাসান ভাই আমি নাসিফ। বিকেলে হঠাৎ করে বাবার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমি তখুনি স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসি। হাসপাতালে আনার পর ডাক্তার জানায়, উনি মারা গেছেন। আমরা কোথায় কী বলবো বুঝতে পারছি না। আপনি যদি সবাইকে জানাতেন।’

স্তব্দ আমি কী উত্তর দেব খুঁজে পাই না। সৈয়দ আবুল মকসুদ নেই? অসাধারণ তার সব কলাম আর পড়া হবে না? গল্প করা হবে না? আমার তখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললাম, ‘এখুনি আসছি। আপনি হাসপাতালে অপেক্ষা করেন।’

মহাখালী থেকে দ্রুত ছুটলাম স্কয়ার হাসপাতালের দিকে। মঙ্গলবার বসুন্ধরা-নিউমার্কেট বন্ধ থাকে বলেই যানজট নেই। ১৫-২০ মিনিট সময় লাগল। কিন্তু, এই সময়টাকেই অতি দীর্ঘ মনে হলো। স্মৃতিতে ভেসে উঠল মকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে নানা ম্মৃতি!

এই দেশের অনেক বড় মানুষের কাছে গেলে তাদের কথা শুনে, জীবনযাপনের দ্বিচারিতা দেখে মনে হয় তারা আসলে বড় নন। কিন্তু, মকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে যখুনি কথা হতো মনে হতো মানুষটা এতো ভালো কেন? এই যুগেও কিভাবে এতো নির্লোভ, সাদাসিধে জীবন যাপন করেন? মানুষের জন্য এতো দরদ কী করে হয় একজন মানুষের?

সৈয়দ আবুল মকসুদের জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে। শৈশব থেকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা পড়তেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৬৪ সালে সাপ্তাহিক নবযুগ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। দেশ স্বাধীনের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) যোগ দেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ২০০৪ সালে। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হয়। হুমায়ুন আজাদকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার সূত্রে ধরে এ সংক্রান্ত ঘটনাগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছি। আবুল মকসুদ তখন বাসস’র উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক। এই হামলার প্রতিবাদে তিনি ২০০৪ সালের ১ মার্চ প্রথম আলো’তে ‘হুমায়ুন আজাদের ওপর আঘাত–ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ’ শিরোনামে একটি কলাম লেখেন। এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আবুল মকসুদকে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে তিনি বাসস থেকে পদত্যাগ করেন।

এর আগের বছর ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে সেলাইবিহীন সাদা চাদর পরা শুরু করেছিলেন আবুল মকসুদ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই পোশাকই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। কেন তিনি সাদা কাপড় পরতে শুরু করলেন, কেন তিনি হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে লিখে বাসসের চাকরি ছেড়েছেন সেসব নিয়ে তার সঙ্গে আমার দিনের পর দিন অনেক গল্প হয়েছে। বিশেষ করে ২০১১ সালের আগস্টে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনের সময় তার সঙ্গে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠতা।

সড়কের ওই মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকায় ‘ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী-জনতার’ ব্যানারে যে আন্দোলন হয়েছিল তার আহ্বায়ক ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। ওই সময় দেখেছি, কী গভীরভাবে মানুষের কথা ভাবতেন তিনি। এরপর গত এক দশকে নানা বিষয়ে অনেকবার কথা হয়েছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের শেষ প্রান্তে তার বাসায় গিয়ে দেখেছি বই আর লেখালেখির সঙ্গে তার মিতালি। শুনেছি তার জীবনের গল্প। শৈশবের মানিকগঞ্জ, এই ঢাকা শহর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাংবাদিকতা, বঙ্গবন্ধু, মাওলানা ভাসানী, গান্ধীজী থেকে শুরু করে দেশ-দুনিয়া ও মানুষের নানা বিষয়ে তার ভাবনাগুলো সমৃদ্ধ করেছি। লেখাতেও সেগুলো পড়েছি। তিনি তাই বলতেন যা তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি সেই জীবনযাপনই করতেন যার কথা তিনি বলতেন। কথায়-কাজে এতো মিল এই দেশের খুব কম মানুষেরই আছে!

সৈয়দ আবুল মকসুদের জীবনবোধ ছিল ভীষণ গভীর, মানুষের জন্য তার মমত্ববোধ ছিল অসাধারণ। সাংবাদিকতা, লেখালেখি তিনি ভীষণ উপভোগ করতেন। আমার কোন রিপোর্ট তার পছন্দ হলে ফোন দিয়ে কথা বলতেন। প্রবাসীদের নিয়ে তার অনেক আগ্রহ ছিল। অনেকবার এ নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তিনি বলতেন, ‘প্রবাসীদের প্রতি আমাদের আরও যত্নশীল হওয়া দরকার’। তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া দরকার। তিনি বলতেন, রাষ্ট্র-দূতাবাস-এজেন্সি সবাই মিলে সামগ্রিকভাবে উদ্যোগ না নিলে প্রবাসীদের দুর্দশা কখনো শেষ হবে না।

মহাখালী থেকে স্কয়ার হাসপাতাল! কতো আর দূর? কিন্তু, এই পথেই গত একযুগের স্মৃতিচারণ চলছিল। ভাবছিলাম মকসুদ ভাই কী মোলায়েম কণ্ঠে কী দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করতেন! ভাবতে ভাবতেই পৌঁছালাম স্কয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। নাসিফ মকসুদ ততক্ষণে হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা সারছেন। এরপরই আবুল মকসুদকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছুটলাম আমরা তার বাসার কাছে, ধানমন্ডির তাকওয়া মসজিদে। বহু বছর ধরে এই এলাকায় আছেন তিনি। তার মরদেহ এসেছে শুনে অনেক প্রবীণ মানুষেরা এসেছেন। প্রত্যেকেই বলছেন, খুব ভালো মানুষ ছিলেন আবুল মকসুদ। সারাক্ষণ জ্ঞানের কথা বলতেন।

রাত ৯টা। সাইরেন বাজিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ নামানো হলো। এরপর গোসল। খুব কাছ থেকে মকসুদ ভাইকে দেখলাম আরেকবার। এতো জীবন্ত মুখ! মনে হলো, এখুনি বলে উঠবেন, ‘বাসায় আসো না কেন’?

গোসল শেষ করে মুরব্বিদের পরামর্শে ওই মসজিদেই প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হলো। এরপর তাকে নেওয়া হলো বাসার নিচে। নাসিফ তার মাকে আনতে গেল। আরও অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছেন। এসেছেন অনেক নাগরিক প্রতিনিধি। শোকাবহ পরিবেশ। কিন্তু, সেই শোকের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল মকসুদ ভাইয়ের সহধর্মীনির কান্নায়! তিনি কাফনে মোড়ানো আবুল মকসুদের মুখ দেখে বারবার বলছিলে, ‘কথা বলতে বলতে এভাবে তুমি চলে গেলা কীভাবে? তোমার না নাতিদের সঙ্গে গল্প করার কথা? আমার সঙ্গে কথা বলবা না...।’

শোকের এমন পরিবেশ সহ্য করা কঠিন। নাসিফ কিছুক্ষণ পরেই মাকে বাসায় দিয়ে এলেন। অ্যাম্বুলেন্স আবার ছুটলো স্কয়ার হাসপাতালের দিকে। রাত সাড়ে ১০টা পেরিয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছে সৈয়দ আবুল মকসুদকে রেখে এলাম হিমঘরে! এই শহরে এখন একাকী আবুল মকসুদ!

হাসপাতাল থেকে ফের ধানমন্ডির বাসায়। মৃতদের পরিবারে কতো ধরনের শোক থাকে। এর মধ্যেই আবার কতো সিদ্ধান্ত নিতে হয় কখন কোথায় দাফন হবে, কখন জানাজা, প্রেসক্লাবে কখন যাবে? শহীদ মিনারেও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চায় অনেকেই। ওদিকে মকুসদ ভাইয়ের মেয়ে কলকাতায়। কতো দ্রুত তিনি দেশে আসতে পারবেন সেই প্রস্তুতিও চলছে।

ঘড়ির কাঁটা তখন মঙ্গলবার পেরিয়ে বুধবার। মানে ২৪ ফেব্রুয়ারি। পরদিন কিভাবে কী করা হবে সেই সিদ্ধান্তের পর বাসার পথে। ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম— একদিকে লেখালেখি, আরেক দিকে সমাজের সব অনাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদ ও সামাজিক-সাংষ্কৃতিক সব আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলন, সুন্দরবন রক্ষা, নদী ও দূষণবিরোধী আন্দোলন, দেশের তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ সামাজিক সব আন্দোলনেই যুক্ত ছিলেন তিনি। এই বাংলাদেশের গত দুই দশকের প্রায় সব আন্দোলন-প্রতিবাদেই পাওয়া যাবে তাকে।

কলামিস্ট হিসেবে কোন বিষয়ে লিখেননি আবুল মকসুদ? ‘সহজিয়া কড়চা’ ও ‘বাঘা তেঁতুল’ শিরোনামে এই দেশ, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, মানবাধিকার, পরিবেশ— সবই তো তুলে এনেছেন! আমাকে তিনি বলতেন, ঝড়বৃষ্টি, জ্বর-জরা যাই হোক না কেন এমন কোন সপ্তাহ নেই যে তিনি তার কলাম লেখা বন্ধ রেখেছেন। একদিকে কলাম লেখা আরেক দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মাওলানা ভাসানী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিংবা আবুল মনসুরসহ কতজনের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা! লেখালেখির কারণে ১৯৯৫ সালেই বাংলা একাডেমি পুরুস্কার পেয়েছিলেন তিনি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ খুব সাবলীল ভাষায় জরুরি ও ন্যায্য কথাগুলো লিখতেন। এই তো গতবছরের বিজয় দিবসে ‘সুবর্ণজয়ন্তীর সূচনায় শতবার্ষিকীর প্রতিজ্ঞা’ শিরোনামে তিনি লিখছেন, ‘স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিকশিত হতে না পারার কারণ শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনের অভাব। সরকারি ও বিরোধী পক্ষে সুসংগঠিত গণভিত্তিক দল না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় না।’

এই তিনি আবার লিখছেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জবাবদিহি ও ভারসাম্য রক্ষার জন্য স্বশাসিত সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থাকে। বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু, সেসব প্রতিষ্ঠান তাদের স্বকীয় সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। নির্বাহী বিভাগের চাপে অন্য যেকোনো সরকারি অফিসের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও সরকারি দপ্তর মাত্র।’

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে তিনি লিখেছেস, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুরবস্থার জন্য রাষ্ট্রকে দায়মুক্তি দেওয়া যাবে না। সরকার উপাচার্য নিয়োগ দেয় পোঁ ধরা শিক্ষকদের; স্বাধীনচেতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্নদের নয়। শিক্ষক নিযুক্ত হন একাডেমিক যোগ্যতার মাপকাঠিতে নয়, দলীয় ক্যাডারদের থেকে। জ্ঞানের জগতে যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্য বড় হওয়া একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ালেখার মান নিচে নামার ফলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র চালানোর মতো যোগ্য মানুষ পাওয়া যাবে না। তাতে রাষ্ট্র ফ্র্যাজাইল বা নাজুক হয়ে পড়বে। শুধু প্রশাসন নয়, জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে ধস নামবে।’

দেশের নিরাপদ সড়কের দাবিতে তিনি লিখেছেন গণপরিবহন নিয়ে। রোহিঙ্গাদের অধিকার, সুন্দরবন, কোটা পদ্ধতি, প্রশাসন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সবকিছু নিয়েই তিনি লিখেছেন। একদিকে লিখতেন আরেক দিকে শান্তি, অহিংসা, আর মানবতার বাণী নিয়ে ছুটে বেড়াতেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।

বছর তিনেক আগের ঘটনা। কোনো এক ছুটির দিনে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি একটি প্রতিবাদ কর্মসূচিতে মকসুদ ভাই। প্রচণ্ড গরমে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে সেখান থেকে বাসায় পাঠানো হয়। মকসুদ ভাইয়ের পরিবাররকে ঘটনা জানাতে তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বললেন, ন্যায়সঙ্গত যেকোনো আন্দোলনে ডাকলেই তিনি ছুটে যেতেন। তাকে শত নিষেধ করেও বাসায় রাখা যেত না।

কথায় আর কাজে কিভাবে মিল রাখা যায়, মোলায়েম কণ্ঠেও কতোটা দৃঢ় হওয়া যায, মাথা উঁচু করে বুদ্ধিজীবী হিসেবে কিভাবে বাঁচতে হয়, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কিভাবে প্রতিবাদ করেতে হয়, কিভাবে দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হয়— এসবকিছুরই পাঠ্য হতে পারেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। যেমনটা বলছিলেন তার ছেলেও।

নাসিফ মকসুদ কথা বলতে বলতে আমাকে বলছিলেন, ‘নিজের বাবা বলে বলছি না, মানুষের জন্য মানুষের কী করে এতো ভালোবাসা থাকে আব্বাকে না দেখলে বুঝতাম না। তার ভাবনাজুড়ে সব সময় দেশ, দেশের মানুষ। সবার মঙ্গলের কথা ভাবতেন। একেবারে নির্লোভ মানুষ ছিলেন। নিজের সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি এসবের দিকে কোন আগ্রহই ছিল না। মানিকগঞ্জে আমাদের পারিবারিক বাড়িটি বন্যায় ভেসে যাওয়ার পর আব্বা আর কখনো জমিজমা-বাড়ি— এ সবে নজর দেননি। সততা, সাধারণ জীবনযাপন শেখাতেন আমাদের। পারিবারিকভাবে এ সবের চর্চা হতো বাসায়।’

কথা বলতে বলতে কাঁদছিলেন নাসিফ মকসুদ। তার কান্না দেখে তার চার বছরের ছেলে বলছিল, ‘বাবা তুমি কেঁদো না’। নাসিফ তখন বলছিলেন, ‘বাবা কাউকে বুঝতেও দিল না কিছু। হুট করেই চলে গেলেন।’

আসলেই হুট করে চলে গেলেন সৈয়দ আবুল মকুসদ। কিন্তু, সারাজীবন সাধারণ জীবনযাপন করে অসাধারণ একজন মানুষ হয়ে থাকলেন। এ কারণেই বুঝি বলা যায়, সাধারণেও অসাধারণ সৈয়দ আবুল মকসুদ।

শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Mirpur-10 metro station to reopen tomorrow

Mohammad Abdur Rouf, managing director of Dhaka Mass Transit Company Ltd, revealed the information in a press conference

32m ago