কোন পথে নোয়াখালী আওয়ামী লীগের রাজনীতি?

বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা ও নোয়াখালী-৪ (সদর ও সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি, বসুরহাট পৌরসভার মেয়র ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার সঙ্গে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনম খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য।

অনেক দিন থেকে জেলা আওয়ামী লীগের এ দুই গ্রুপ বিভিন্ন সভা সমাবেশে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে চলছেন। গত শুক্রবার দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির। এ নিয়ে সারাদেশে সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় ওঠে। এসব ঘটনায় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। দলের নেতা কর্মীরাও দ্বিধা বিভক্ত। সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ চাইছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা।

প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব

গত ১৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা। এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর মির্জা কাদের তার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন। ওই সম্মেলনে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী, ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অপরাজনীতি, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাকরি বাণিজ্য ও লুটপাটের অভিযোগ এনে বক্তব্য দেন। এরপর তিনি জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের স্থান না হওয়া নিয়েও তিনি বক্তব্য দেন। পরবর্তীতে তিনি তার বড় ভাই ওবায়দুল কাদের, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও এমপিদের নৈতিকতা নিয়েও বক্তব্য দেন।

তার এই বক্তব্যের পরপরই জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এর কয়েকদিন পর নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী তার ফেসবুক আইডিতে লাইভে এসে ওবায়দুল কাদেরকে রাজাকার পরিবারের সদস্য হিসাবে আখ্যায়িত করে কয়েকদিনের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি দেওয়া না হলে তিনি এটা নিয়ে শুরু করবেন বলে জানান।

দুজনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। কাদের মির্জার বিচার ও মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার চেয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন।

সংঘর্ষ, মৃত্যু ও পরষ্পরকে দোষারোপ

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ এমপি ও সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে কাদের মির্জার বক্তব্যের মিথ্যাচারের অভিযোগে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল শনিবার সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। ওই সংবাদ সম্মেলন উপলক্ষে গত শুক্রবার বিকেলে তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে উপজেলার চাপরাশিরহাট বাজারে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেন। সেখানে মির্জা কাদেরের সমর্থকদের সঙ্গে বাদলের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন ৯ জন। শনিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গুলিবিদ্ধ সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির।

এ ঘটনার প্রতিবাদে মির্জা কাদের রবিবার কোম্পানীগঞ্জে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকেন। হরতাল শেষে তিনি বসুরহাট রূপালী চত্বরে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মরার আগে মরবেন না তিনি, লড়াই করেই মরবেন।’

সাংবাদিক মুজাক্কির হত্যার জন্য জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলকে দায়ী করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাকে হত্যার জন্য নোয়াখালী ও ফেনীর দুই এমপি দিবারাত্র ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। মেয়র পদে নির্বাচিত হওয়ার পর চট্টগ্রামে শপথ নিতে যাওয়ার পথে নিজাম হাজারী ও একরামুল করিম চৌধুরীর ক্যাডার বাহিনী দাগনভূঞাঁর পৌর এলাকায় ও চট্টগ্রামে দুই দফা আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করেছে। আমি সে হামলার বিচার আদৌ পাইনি। আমি ৪৭ বছর আওয়ামী রাজনীতি করে আসছি। আমি সত্য কথা বলার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েছি। আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করব এবং সত্য বলেই যাব।’

বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরসহ স্থানীয় দুই সংসদ সদস্য ফেনীর নিজাম হাজারী ও নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধের কারণও তুলে ধরেছেন তিনি।

এদিকে গত শনিবার দুপুরে কোম্পানীগঞ্জের পেশকার হাটে কাদের মির্জার বহিষ্কারের দাবিতে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা কর্মীরা। ওই সংবাদ সম্মেলনে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদল লিখিত বক্তব্যে বলেন দীর্ঘদিন থেকে কাদের মির্জা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী ও নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবৎ মিথ্যাচার করে আসছেন। তাই তাকে দল ও মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার করার দাবি জানিয়েছেন।

এদিকে সাংবাদিক মুজাক্কির নিহত হওয়ার ঘটনায় মিজানুর রহমান বাদল কাদের মির্জার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলে বলেন চাপরাশিরহাটে মির্জা কাদেরের ক্যাডার বাহিনীর গুলিতেই সাংবাদিক মুজাক্কির মারা গেছেন। এ নিয়ে কোম্পানীগঞ্জে কাদের মির্জা ও একরামুল করিম চৌধুরীর অনুসারী মিজানুর রহমান বাদলের কর্মী সমর্থকরা মুখোমুখি অবস্থানে।

শুক্রবারের সংঘর্ষের ঘটনায় মিজানুর রহমান বাদল কাদের মির্জার অনুসারী ৪৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৬০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। যদিও মামলায় কাদের মির্জা আসামি নন।

সংকটের সমাধান চান নেতাকর্মীরা

গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টায় জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় প্যাডে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরীর সই করা এক চিঠিতে আবদুল কাদের মির্জাকে সংগঠন বিরোধী কার্যকলাপ ও সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, অশালীন ও আপত্তিজনক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে সংগঠনের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে আদেশের ২ ঘণ্টা পর আবার তা স্থগিত করা হয়। এ নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে মত পার্থক্য দেখা দেয় এবং তারা দুজন পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দুই নেতার দ্বন্দ্বের বলি আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা। দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এই দুই নেতার পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও কর্মসূচি নেতা কর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করেছে। খুব শিগগির এর অবসান করা না হলে আসন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যপক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনম খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম এর সঙ্গে কথা বললে তিনি এব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

Comments

The Daily Star  | English
rohingya-migration

Persecuted by Arakan Army, Rohingyas fleeing to Bangladesh

Amid escalating violence in Myanmar’s Rakhine State, Rohingyas are trespassing into Bangladesh every day, crossing the border allegedly to escape the brutality of Myanmar’s rebel group, the Arakan Army (AA).

1h ago