প্রবাসে

ঢাকা থেকে ব্রিস্টল: প্রতীক্ষা আর অনিশ্চয়তার যাত্রা

ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টল। ছবি: লেখক

বহু প্রতীক্ষা আর অনিশ্চয়তা পেরিয়ে সপ্তাহ দুয়েক আগে ঢাকা থেকে ব্রিস্টল এসে পৌঁছেছি। ২০২০ সালের জুলাই মাসের কোন এক বৃহস্পতিবার কমনওয়েলথ স্কলারশিপ কমিশনের একটি ই-মেইল মারফত জানতে পারি, কমনওয়েলথ শেয়ারড স্কলারশিপ এর আওতায় ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টলে এমএসসি (এডুকেশন-পলিসি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) প্রোগ্রামে অন্তর্ভূক্তির জন্য আমাকে চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। মহামারী আক্রান্ত ম্লান সন্ধ্যা মুহূর্তে ঝলমলে হয়ে গিয়েছিল সেই আনন্দ সংবাদে।

স্কলারশিপ চূড়ান্ত হওয়ার পর নানারকম আনুষ্ঠানিকতা অনলাইনেই হলো। আমার যুক্তরাজ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। কিন্ত মহামারীর কারণে প্রতি মুহূর্তে যুক্তরাজ্য সরকারের নিয়ম বদলে যাচ্ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সিদ্ধান্ত বদলাচ্ছিল। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টল জানালো, প্রথম সেমিস্টার মূলত অনলাইনে হবে, যা শিক্ষার্থীরা চাইলে নিজ দেশে বসেও করতে পারে। সেই সিদ্ধান্তের জেরেই যে যাত্রা গত বছরের সেপ্টেম্বরে হাওয়ার কথা ছিল, সেটা হলো ২০২১ এর ফেব্রুয়ারি মাসে।

ঢাকা থেকে ইস্তানবুল, সেখান থেকে লন্ডন, তারপর ব্রিস্টল। এই যাত্রার প্রথম দফায় আমার পাশের আসনে পেলাম মুন্সিগঞ্জের মাহমুদ আলমকে। ভদ্রলোক একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ক্রোয়েশিয়া যাচ্ছেন, এক মাসের ভিসা আছে, পরে ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হবে, এমনটিই জানালেন। সাদাসিধে সেই ভদ্রলোকের সাথে নানান আলাপে কেটে গেল নয় ঘণ্টার দীর্ঘ পথ।

ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে নেমে তাকে ক্রোয়েশিয়ার ফ্লাইট টার্মিনাল অব্দি এগিয়ে দিলাম। বিদায় নেওয়ার সময় ভদ্রলোক আন্তরিক বিষাদ নিয়ে বললেন, “আপা, এতক্ষণে মনে হচ্ছে সত্যিই দেশছাড়া হলাম। আমার জন্য দোয়া করবেন।” প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে প্রায়ই এত দুঃসংবাদ পাই, তাই মাহমুদ আলমের জন্য মন থেকেই দোয়া করলাম, তিনি যেন সফল হয়ে দেশে ফিরতে পারেন।

এবার ইস্তানবুল থেকে লন্ডনের কানেক্টিং ফ্লাইটের পালা। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসার কোভিড টেস্ট এর রিপোর্ট দেখতে দেখতে বলল, তোমার দেশে তো ভ্যাক্সিন দিচ্ছে, ভ্যাক্সিন নিয়ে আসোনি? আমি যখন বললাম ফ্রন্টলাইনফাইটার আর বয়স্কদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, অফিসার সন্তুষ্ট ভঙ্গীতে ঘাড় নেড়ে বললো, “খুবই দারুণ ব্যাপার হচ্ছে এটা!”

ঘটনাচক্রে আমার পেছনেই ছিলেন এক পাকিস্তানি ভদ্রলোক আর তার ছেলে, তারাও লন্ডন যাচ্ছিলেন, ফ্লাইট এর জন্য ডাক পড়ার আগ অব্দি ভদ্রলোক অনেকক্ষণ বাংলাদেশ নিয়ে নানান কৌতুহলী প্রশ্ন করলেন আর আফসোস করলেন এই বলে যে, বাংলাদেশ কত দূর এগিয়ে গেছে আর পাকিস্তান কত পিছিয়ে আছে!

বাংলাদেশ নিয়ে গর্বিত হবার সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তটি অপেক্ষা করছিল হিথ্রো এয়ারপোর্টে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে যুক্তরাজ্য সরকার ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অন্তর্ভূক্ত করে একটি রেড লিস্ট করেছে। সেসব দেশের নাগরিকদের জন্য নিজ খরচে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক আর বাদবাকি দেশের নাগরিকদের দশ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইন করলেই চলবে। হিথ্রো এয়ারপোর্টের বর্ডার কন্ট্রোলের প্রবেশমুখে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখাতেই যখন গ্রিন লিস্ট মানে নিরাপদ দেশের নাগরিকের লাইন ধরে এগিয়ে যেতে বলল, তখন সবুজ পাসপোর্টটার জন্য গর্ব হলো খুব। বর্ডার কন্ট্রোল এর পরবর্তী ধাপের অফিসারও কাগজপত্র পরখ করতে করতে ঠাট্টা করে বললো, “তুমিতো বরং নিরাপদ অঞ্চল থেকে অপেক্ষাকৃত কম নিরাপদ অঞ্চলে চলে এসেছ!”

বর্ডার কন্ট্রোল পেরিয়ে লাগেজ বেল্ট থেকে ভীষণ ভারী লাগেজ তুলতে গলদঘর্ম হচ্ছিলাম দেখে ব্রিটিশ পুলিশের এক সদস্য, নাম এন কে পাল, এগিয়ে এসে আমার উপমহাদেশীয় চেহারা ও পোশাকের দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন, ইন্ডিয়া থেকে এসেছ?

আমি উত্তরে বাংলাদেশ বলতেই, উনি মহা উৎসাহে “পড়শি দেশের মেয়ে!” বলে আহ্লাদের স্বরে কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি এসব গল্প করতে করতে আমার লাগেজ ট্রলিতে তুলে এগিয়ে দিলেন এক্সিট গেট পর্যন্ত। ওনাকে বিদায় জানিয়ে খানিক এগোতেই পেলাম আমার লন্ডননিবাসী বাংলাদেশি বন্ধুদের, সেখানে তারা অপেক্ষা করছিল আমার জন্য, সাথে নিয়ে এসেছিল হোম কোয়ারেন্টাইনের প্রথম দিনের রসদ।

লন্ডন থেকে ব্রিস্টল যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টলের ইন্টারন্যাশনাল অফিস। আমি আর ফ্রান্স থেকে আগত আরেকজন ছাত্রীকে নিয়ে গাড়ি চললো ব্রিস্টলের দিকে। এমেল নামের সেই ছাত্রীর সাথে গল্প হলো ফুটবল, খাবার, পোশাক এবং অবধারিতভাবে মহামারী নিয়ে। এমেল ফ্রান্সের কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে শংকার কথা বলল। আমার দেশের কথা জিজ্ঞেস করার পর গুগল করে বাংলাদেশ এর পরিস্থিতি জেনে নিয়ে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এতটুকু দেশে এত মানুষের মাঝে তোমরা মাস ভ্যাক্সিনেশন চালাচ্ছো কেমন করে!”

ব্রিস্টলে পৌঁছাতে দু’ঘণ্টা লাগলো। যদিও ইউনিভার্সিটির মেইলে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, নিজের ব্যাগ নিজেকেই টানতে হবে। তবু স্যাম নামের স্বল্পভাষী সেই ব্রিটিশ তরুণ ড্রাইভার কী ভেবে যেন আমার লটবহর ডরমিটরিতে তুলে দিয়ে গুডলাক জানিয়ে বিদায় নিলো। প্রফেশনাল ড্রাইভারের এই বদান্যতার কী কারণ ছিল তা আজো ভেবে পাইনি।  

হোম কোয়ারেন্টাইনের সময়ও পেরিয়ে গেছে নিশ্চিন্তে। ঘর থেকে বের হতে পারবো না জেনে ইংল্যান্ড এর নানান প্রান্তে থাকা পরিচিত বাংলাদেশি ভাই-বোন-বন্ধুরা এত এত গ্রোসারি পাঠিয়েছেন যে ফ্রিজ আর কিচেন কেবিনেট উপচে পড়ছে। এসব দেখে আমার ডর্মমেটরা বলেই ফেলল, “বাড়ি বাংলাদেশে হলে তো দেখছি হোম কোয়ারেনটাইন ব্যাপারটা মন্দ কিছু না!” আমিও কলার ঝাঁকিয়ে জবাব দিলাম, আমার দেশের মানুষ এমনই!

কোয়ারেন্টাইনের ষষ্ঠ দিনে ঘটনাচক্রে জানতে পারলাম, কোয়ারেন্টাইনের দ্বিতীয় ও অষ্টম দিন ভীনদেশিদের বাধ্যতামূলক কোভিড টেস্ট করার কথা নিজ খরচে, যার রেজিস্ট্রেশন আমি করিনি এবং এটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুনে খুব ঘাবড়ে গিয়ে ফোন দিলাম যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের হটলাইনে। তারা সব শুনে আশ্বস্ত করে বললো, “তোমার দেশের নাম যেহেতু রেড লিস্টে নেই, তোমার দেশের পরিস্থিতিও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, তোমার কোন লক্ষণও নেই, তাই এই পিসিআর টেস্ট নিয়ে অত ভেবো না। তুমি বরং কোয়ারেন্টাইন শেষে তোমার ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে ল্যাটারাল ফ্লো টেস্ট করিয়ে নিও”। ওদের পরামর্শ শুনে দেশের গর্বে মাথা এক হাত উঁচু হয়ে গেল। ঘরের দেয়ালে টানানো লাল-সবুজ পতাকাটা মনে হলো আরও বেশি উজ্জ্বল।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টলে অধ্যয়নরত।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago