জীবন সেখানে যেমন

ঘরে অন্ধকার, তাই বাইরে বসে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন নুরজাহান বেগম। ছবি: শাহীন মোল্লা

দুর্গন্ধময় পানি বয়ে যায় সারি সারি ঘরের পাশের খাল দিয়ে। মশাদের ‘অভয়াশ্রম’ বললেও অত্যুক্তি হবে না মোটেই। খাল পাড়ের এই বস্তিতে মাথা গুজে থাকেন প্রায় ৫০০ মানুষ। বলছি, মিরপুর-১১ এর মিল্কভিটা খালপাড়ের বস্তির কথা।

বস্তির মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া খালটি মাস দুয়েক আগে প্রশস্ত করা হয়েছে। তাতে বিপদ আরও বেড়েছে। ঘরের দেয়াল আর খালের মাঝে এক ফুট জায়গাও অবশিষ্ট নেই। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে ছোট ছেলে-মেয়েরা।

যোগাযোগের জন্য বাঁশের সাঁকোই তাদের ভরসা। ছবি: শাহীন মোল্লা


বস্তির বাসিন্দা আমেনা আক্তার দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। কিছুদিন আগে বাঁশের সাকো দিয়ে খাল পার হওয়ার সময় সে পড়ে যায়। নোংরা পানিতে হাবুডুবু খেলেও প্রাণ সংশয় হয়নি। খুব কাছেই ছিলেন বাবা। পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গুড্ডু মিয়া ঝাঁপ দিয়ে আমেনাকে তুলে আনেন।

গুড্ডু মিয়া কাজ করেন পাশের বেনারসি পল্লীতে। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে পনেরশ টাকা পাই। এই দিয়েই সংসার চালাতে হয়। এখানে ঘর ভাড়া মাসে দুই হাজার টাকা। মহল্লায় উঠলে ভাড়া দিতেই যাবে কমপক্ষে পাঁচ হাজার। খাব কী? এ জন্যই সন্তানদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আছি খাল পাড়ের বস্তিতে।’

শিশু ও বৃদ্ধরাও ঝুঁকি নিয়েই পার হন সাঁকো। ছবি: শাহীন মোল্লা


মিনারা বেগম (৫০) নাতনীকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘরের সামনে খালের ধারে। তিনি বলেন, ‘এই নাতনীর বড় আরও তিনটা নাতি-নাতনী আছে। বাসাবাড়িতে কাজ করি। স্বামী রিকশা চালায়। সাত জনের পরিবার নিয়ে একসঙ্গে থাকি।’ কোলে দেড় বছরের শিশুটির দিকে ইশারা করে বলেন, ‘ছোট বাচ্চাগুলো নিয়ে সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। বড়রাই খালে পড়ে যাওয়ার ভয়ে থাকে। সামনে আসছে বর্ষা। খাল ভরে যাবে, ঘরেও পানি উঠবে।’

ঘরের সামনে বসে শাক বাছতে দেখা গেল নুরজাহান বেগমকে (৬০)। ২০ বছর আগে স্বামী হারানো নুরজাহান ভাত জোগাড় করেন রাস্তায় পিঠা বিক্রি করে।

বর্ষায় বাড়বে খালের পানি। সেই আতঙ্কে রয়েছেন এই বস্তির বাসিন্দারা। ছবি: শাহীন মোল্লা


রাতে পিঠা বিক্রি করে ঘরে ফেরা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তার বর্ণনা দিতে গিয়ে নূরজাহান বলেন, ‘একবার তো মরতেই বসেছিলাম। অন্ধকার রাইতে খাল পার হওয়ার সময় চিকন বাঁশের সাঁকো থিকা পা পিছলায়ে যায়। ভাগ্য ভালো ধরার জন্য আরেকটা বাঁশ পাইছিলাম।’

৬৭ বছর বয়সী দিনমজুর আব্দুল খালেক এই বস্তিতে থাকেন ২৭ বছর ধরে। স্ত্রী, পাঁচ সন্তান আর নাতি-নাতনীদের নিয়ে থাকেন তিনি। বস্তির দুটি ঘিঞ্জি ঘরে তাদের বসবাস।

এত ঝুঁকির পরেও বস্তি ছাড়তে নারাজ এখানকার বাসিন্দারা। ছবি: শাহীন মোল্লা


পটুয়াখালীর রাঙাবালিতে পূর্বপুরুষের ভিটা নদী ভাঙনে বিলীন হওয়ার পর এই শহরে আসেন আব্দুল খালেক। মাটি কাটা, রিকশা চালানো, সুইপারের কাজ থেকে শুরু করে দিন মজুরের কাজ করে জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘ওদের কষ্ট দেখে খুব খারাপ লাগছে আমার। কিন্তু, এখন নিজেদের জন্য আরও বেশি খারাপ লাগে। যখন টিভিতে দেখি ওরা নতুন নতুন ঘর পায়, বিনামূল্যে খাবার পায়, সবই পায়। আর এই দেশের মানুষ হয়ে আমরা কী পেলাম?’

বস্তির বাসিন্দাদের একমাত্র পানির উৎস। ছবি: শাহীন মোল্লা


‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গৃহহীনদের ঘর দিচ্ছেন। আমারা শহরে থাকি এ জন্য পাই না। কিন্তু, আমাদের তো আর গ্রাম নাই। সব নদীতে। আর গ্রামে গেলেও খাব কী, কাজ দেবে কে?,’ প্রশ্ন রাখেন আব্দুল খালেক।

Comments

The Daily Star  | English

Publish newspaper ads asking Hasina, Asaduzzaman to appear on June 24: ICT

Another accused, former IGP Mamun, is already under custody and was produced before the court today

26m ago