নারায়ণগঞ্জে মাদ্রাসাছাত্রকে হত্যার অভিযোগে ৩ শিক্ষক ও ৪ সহপাঠী গ্রেপ্তার
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলায় মাদ্রাসার এক ছাত্রকে হত্যার অভিযোগে তার চার সহপাঠী ও তিন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
আজ শুক্রবার দুপুরে রসুলবাগ মাঝিপাড়া এলাকার রওজাতুল উলুম মাদ্রাসা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে, সকালে ভুক্তভোগী ছাত্রের বাবা বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
নিহত মাদ্রাসাছাত্র সাব্বির হোসেন (১৪) রূপগঞ্জ উপজেলার শান্তিনগর এলাকার জামাল হোসেনের ছেলে। সে রওজাতুল উলুম মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র ছিল।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মাদ্রাসার শিক্ষক শওকত হোসেন সুমন (২৬), জোবায়ের আহম্মেদ (২৬) ও আব্দুল আজিজ (৪২)। ১৮ বছরের নিচে হওয়ায় চার সহপাঠীর নাম প্রকাশ করা হয়নি।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) এ এস এম শামীম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সাব্বির রওজাতুল উলুম মাদ্রাসার আবাসিক ছাত্র ছিল। গত ১০ মার্চ সকাল ১১টার দিকে মাদ্রাসার শিক্ষক জোবায়ের নিহতের পরিবারকে জানায়, সাব্বির মাদ্রাসার ছাদে উঠার সিঁড়ির পাশে ফাঁকা রডের সঙ্গে গলায় গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে, আপনারা মরদেহ নিয়ে যান। মরদেহ নিতে আসলে পরিবারটিকে ভয় দেখিয়ে বলা হয়- থানায় অভিযোগ দিয়ে কিছু হবে না। পরে স্বজনরা পুলিশে কোনো অভিযোগ না দিয়ে মাদ্রাসা থেকে মরদেহ নিয়ে রূপগঞ্জে নিজ এলাকায় দাফন করেন। তবে দাফনের আগে গোসলের সময় নিহতের শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান তারা। পরে আজ তারা থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এর ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই মাদ্রাসার তিন শিক্ষক ও সাব্বিরের চার সহপাঠীকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে।’
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সাব্বিরের পরিবার অভিযোগ করেছে যে- তাকে মারধর করে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছে। এটা হত্যা না আত্মহত্যা, ময়নাতদন্তের পরই বিষয়টি বলা যাবে। এখন কবর থেকে মরদেহ উদ্ধারের জন্য আদালতে আপিল করা হবে। পরবর্তীতে ধারবাহিকভাবে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সাত জনকে জিজ্ঞাসাবাদে অসম্পূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তাই তিন শিক্ষককে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। আর সাব্বিরের চার সহপাঠী কিশোর হওয়ায় তাদের কিশোর আইনে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত চলছে, বিস্তারিত পরে জানানো হবে।’
নিহত সাব্বিরের বাবা জামাল হোসেন দ্য ডেইল স্টারকে বলেন, ‘১০ মার্চ সকাল সোয়া ৯টায় আমার ছেলে মাদ্রাসার শিক্ষক জোবায়েরের মোবাইল থেকে তার মাকে ফোন দেয়। সেসময় সে সুস্থ ছিল, বাসার সবার খোঁজ খবর নেয়। শুক্রবার মাকে মাদ্রাসায় যেতে বলে। জানায়- মাদ্রাসায় অফার চলছে, আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে ভর্তি হলে ১০৫০ টাকা ছাড় পাওয়া যাবে। অন্যথায় ২৫০০ টাকা দিতে হবে। তাই ওর জন্য শুক্রবার ৫০ টাকা বেশি নিতে বলে। এ বিষয়ে পরে আরও কথা বলবে বলে ফোন রেখে দেয়। এর ঠিক এক ঘণ্টা পর মাদ্রাসার শিক্ষক জোবায়ের ফোন দিয়ে বলেন- সাব্বির ফোন করে কী বলেছে? ওর মা তখন ভর্তির অফারের বিষয়টি বলে। আর শুক্রবার যাওয়ার জন্য বলেছে জানায়। এ কথা শুনে জোবায়ের ফোন রেখে দেন। পরে আবার সাড়ে ১১টার দিকে ফোন দিয়ে ওর মাকে বলেন- সাব্বির আত্মহত্যা করছে, দ্রুত মাদ্রাসায় আসেন।’
তিনি বলেন, ‘খবর পেয়ে আমরা দ্রুত মাদ্রাসায় যাই। সেখানে যাওয়ার পর আমার সন্তানের মরদেহ দেখতে দেওয়া হয়নি। তার আগে মাদ্রাসার শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যরা আমাদের একটি আলাদা রুমে নিয়ে বসিয়ে বলেন- আগে কথা শুনেন, পরে মরদেহ পাবেন। তখন মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন বলেন, “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি। তোমরা যদি নিজের ছেলের মরদেহ নিয়ে যেতে চাও এবং নিজেরা ফাঁসতে না চাও, চুপ করে মরদেহ নিয়ে যাও। কারণ আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি, আমার কিছু হবে না। এ এলাকার লোকজন আমার হুকুমে উঠে বসে। থানায় মামলা করে কোনো লাভ হবে না। শুধু শুধু টাকা-পয়সা খরচ হবে। কারণ আমি যা বলব, সেটাই হবে। তোমরা একে গোপনে নিয়ে যাও, আর গোপনে আলাদাভাবে মাটি দিয়ে দাও। এমন কোনো কিছু করবা না, যাতে এ মাদ্রাসার ক্ষতি বা বদনাম হয়।” তিনি এ কথা বলায় আমি ও আমার স্ত্রী ভয় পেয়ে যাই। পরে আমার বড় মেয়ে ও তার স্বামী মাদ্রাসায় গেলে ওদের সঙ্গেও বাজে আচরণ করা হয়। মাদ্রাসার শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যরা বলেন, “তোদের না করেছি আত্মীয় স্বজন কাউকে আনতে”। এরপর তাদের কথায় রাজি হয়ে অভিযোগ করব না জানালে, তারা মরদেহ নিতে দেন।’
জামাল হোসেন বলেন, ‘মরদেহ বাড়িতে এনে গোসল করানোর সময় মহল্লাবাসী সবাই সাব্বিরের মাথায়, চোখের ওপর কপালে, ঠোঁটে ও দাঁড়ির নিচে এবং গলায় আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান। পায়েও ছিল মারধরের চিহ্ন, শরীর থেতলানো। তখন এলাকাবাসী বলতে থাকেন, এটা আত্মহত্যা না, সাব্বিরকে হত্যা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে অনেক কষ্ট দিয়ে মারা হয়েছে। আমার মনে হয়, মারধরে আমার ছেলে মলমূত্র ত্যাগ করে দেয়। কারণ তার শরীরে মলমূত্র লেগে ছিল। তারা আমার ছেলের গলায় ত্রিপলের রশি দিয়ে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে মেরেছে। কারণ তারা বলছে, “সাব্বির নিজের গামছা দিয়ে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সেক্ষেত্রে গলায় মোটা দাগ পরার কথা, কিন্তু সেখানে চিকন রশির দাগ ছিল। তারা আমার ছেলেকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
এতো কিছু দেখে মরদেহ দাফন করলেন কেন? প্রশ্নের জবাবে জামাল হোসেন বলেন, ‘সেসময় ওর মা অচেতন হয়ে পরে। আমরা অসহায় গরিব মানুষ, কী করব বুঝতে পারিনি। দাফনের পর সবাই বলল মামলা করতে। তাই থানায় অভিযোগ দিতে দেরি হলো।’
এ বিষয়ে জানতে রওজাতুল উলুম মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনের মোবাইলে ফোন করা হলে তার স্ত্রী (নাম বলতে চাননি) পরিচয়ে বলেন, ‘তিনি এখন ঘুমিয়ে আছেন। এখন ডাক দেওয়া যাবে না। পরে ফোন দেন।’
এর আধাঘণ্টা পর আবারও ফোন দেওয়া হলে মহিউদ্দিনের ছেলের বউ (নাম বলতে চাননি) পরিচয়ে ফোন ধরে একই কথা বলে ফোন রেখে দেন এক নারী।
Comments