সিলেট শহরের প্রাচীন ভাস্কর্য
দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে বাংলার প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র শ্রীহট্ট তথা সিলেটে পাথরের প্রাচীন চারটি মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে দুটি প্রমাণ আকৃতির বিষ্ণু মূর্তি, একটি মিনিয়েচার গণেশ মূর্তি এবং পঞ্চভূত পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। সম্প্রতি সিলেট অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে এই ভাস্কর্যগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়। এর আগে যার উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।
ভাস্কর্যগুলো বর্তমানে সিলেট শহরের অন্যতম প্রাচীন বৈষ্ণব প্রতিষ্ঠান মিরাবাজার মহল্লার শ্রী শ্রী বলরাম জিউর আখড়ায় পূজিত হচ্ছে।
গবেষকেরা মনে করছেন, বলরাম আখড়ায় রক্ষিত দুটি বিষ্ণু মূর্তি এবং গণেশ মূর্তির নির্মাণের সময়কাল খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে হতে পারে। অন্যদিকে শিবলিঙ্গটি পনের থেকে ষোল শতকের বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও মূর্তিতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বলেন, সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসম্পদ। সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস লিখতে গেলে বলরাম আখড়ায় রক্ষিত নতুন সন্ধান পাওয়া এই মূর্তিগুলোর প্রয়োজন হবে।
ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে, প্রায় তিনশো বছর আগে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে বলরাম জিউর আখড়াটি জমিদার মদন মুন্সি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বলরাম আখড়া পরিচালনা কমিটির সভাপতি সুব্রত চক্রবর্ত্তী জুয়েল জানান, মদন মুন্সি ছিলেন সিলেটের বিখ্যাত জমিদার এবং মৌলভীবাজার জেলার রাজনগরে ছিল তার প্রাসাদ।
তিনি আরো জানান, বলরাম আখড়া আধুনিক সিলেট শহরের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান।
মিরাবাজারের বলরাম আখড়া চত্বরে শ্রী মন্দির তথা মূল মন্দির, শিব মন্দির, দুর্গা মন্দির, নাটমন্দির, রয়েছে। এর মধ্যে দুটি বিষ্ণু মূর্তি এবং গণেশ মূর্তি আখড়ার শ্রীমন্দিরে পূজিত হচ্ছে। আর শিবলিঙ্গ পূজিত হচ্ছে মূল মন্দিরের পূর্বপাশে শিব মন্দিরে।
মিরাবাজার ও শিবগঞ্জের মাঝে একটি প্রাচীন সেতু আছে, যা স্থানীয়ভাবে ফরহাদ খাঁর পুল নামে পরিচিত। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সিলেট জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং বলরাম আখড়া পরিচালনা
কমিটির সহ সভাপতি গোপিকা শ্যাম পুরকায়স্থ জানান, ফরহাদ খাঁর পুল সংস্কারের সময় ১৯৭৩ সালে পুলের নিচে একটি বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া যায়। একই বছর কিছুদিন পর মিরাবাজারের দক্ষিণ দিকের মহল্লা হিন্দুয়ানি পাড় পুকুর খননকালে পাওয়া যায় আরও একটি বিষ্ণু মূর্তি।
আখড়া কর্তৃপক্ষ জানান, বিষ্ণু মূর্তি দুটি প্রাপ্তির পর জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে চলে যায় এবং এক দশক পর ১৯৮৪ সালে জেলা প্রশাসন মূর্তি দুটি তৎকালীন আখড়া পরিচালনা কমিটির কাছে পূজা-অর্চনার জন্য হস্তান্তর করে।
আখড়া কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, মূর্তি দুটির নিচের হাত ভাঙ্গা ছিল। দু-একটি স্থান ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। এরপর মূর্তিটির সংস্কার করা হয়। মূর্তি দুটির সামনের দিক বিভিন্ন রংয়ের মাধ্যমে রঙিন করা হয়েছে। আর বিষ্ণু মূর্তি মন্দিরের দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে দেয়া হয়।
বাংলায় প্রাপ্ত প্রাচীন ভাস্কর্যের মধ্যে বিষ্ণু মূর্তির সংখ্যাই সর্বাধিক। বাংলাদেশে নানা ধরনের বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া যায়। তবে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী চতুর্ভুজ দণ্ডায়মান বিষ্ণু এবং দুপাশে শ্রীদেবী ও ভূদেবী-এরূপ বিষ্ণু ভাস্কর্যের সংখ্যাই বেশি দেখা যায়।
বিষ্ণু ও বিষ্ণুর অবতারদের উপাসকদের বৈষ্ণব বলা হয়। প্রাচীন বাংলায় বিষ্ণুর অবতারের মূর্তি পাওয়া গেলেও সংখ্যায় তা ছিল খুব কম। প্রাচীনকালে বৈষ্ণবরা প্রধানত বিষ্ণুরূপে উপাসনা করতেন। পরবর্তীকালে বৈষ্ণবদের আরাধ্যের রূপ বদলে যায়। রাম, বলরাম, কৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ প্রমুখ বিষ্ণুর অবতার হয়ে উঠেন বৈষ্ণবদের প্রধান আরাধ্য। ফলে বিষ্ণু মূর্তি নির্মাণ প্রবণতা কমে আসে। ত্রয়োদশ শতকের পর বাংলায় বৈষ্ণব বা হিন্দুদের
সমপদস্থানক চতুর্ভুজ বিষ্ণু মূর্তি নির্মাণ করতে দেখা যায় না। বাংলায় প্রাপ্ত সমপদস্থানক ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান বিষ্ণু মূর্তি তাই সাধারণত ত্রয়োদশ শতক বা এর পূর্ববর্তী আমলের হয়ে থাকে।
সিলেট বিভাগে ইতিপূর্বে ৪টি বিষ্ণু মূর্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল বলে জানা যায়। কমলাকান্ত গুপ্ত চৌধুরীর লেখা ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘কপার প্লেট অব সিলেট’ বইয়ে সিলেট বিভাগে ৩টি বিষ্ণু মূর্তি প্রাপ্তির উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে সিলেট শহরে আম্বরখানা মহল্লায় রাজার মায়ের দীঘি থেকে প্রাপ্ত একটি, সুনামগঞ্জে জগন্নাথপুরে মন্দিরে পূজিত একটি এবং পঞ্চখণ্ড বাসুদেব অঙ্গনের একটি বিষ্ণু মূর্তি।
বলরাম আখড়ায় রক্ষিত বিষ্ণু মূর্তি দুটির উচ্চতা প্রায় এক। ৭ ফুট ৩ ইঞ্চি। তবে হিন্দুয়ানী পাড় পুকুর থেকে প্রাপ্ত মূর্তিটি প্রস্থ ৩ ইঞ্চি বেশি। হিন্দুয়ানী পাড় পুকুর থেকে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তিটির প্রস্থ ৩ ফুট ৯ ইঞ্চি। আর ফরহাদ খাঁর পুল অঞ্চলে প্রাপ্ত মূর্তিটির প্রস্থ ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি। আখড়ায় রক্ষিত বিষ্ণু মূর্তি দুটির মধ্যে কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। দুটি বিষ্ণু মূর্তিতেই বিষ্ণুর আয়ুধের কম্পোজিশন এক।
বিষ্ণুর চার হাতে চক্র, শঙ্খ, পদ্ম ও গদা। দুটি মূর্তিতে রয়েছে বিষ্ণুর মস্তকে মুকুট, কর্ণে কুন্ডল, গলার হারে ঝুলন্ত কৌস্তভমনি, বক্ষদেশে যজ্ঞোপবীত এবং বনমালা। শ্রীদেবী ও ভূদেবীর দুপাশে রয়েছেন দুজন সহচরীর অপেক্ষাকৃত ছোট দুটি মূর্তি। বিষ্ণু মূর্তি দুটির শীর্ষে রয়েছে কীর্তিমুখ। আর কীর্তিমুখের দুপাশে নিচে রয়েছে উড়ন্ত বিদ্যাধর। দুটি মূর্তিতেই রয়েছে সপ্তরথ পেডেস্টাল। পেডেস্টালের সামনে মাঝে রয়েছে বিষ্ণুর বাহন গরুড়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূর্তি দুটির মধ্যে প্রার্থক্যও দেখা যায়। হিন্দুয়ানী পাড় পুকুরে প্রাপ্ত মূর্তিতে পেডেস্টালে গরুড়ের দুপাশে রয়েছে তিনটি করে ছয়টি প্যানেল।
অন্যদিকে ফরহাদ খাঁ পুলে প্রাপ্ত মূর্তিতে গরুড়ের দুপাশে রয়েছে ২টি করে চারটি প্যানেল। হিন্দুয়ানী পাড় পুকুরে প্রাপ্ত মূর্তিতে পৃষ্ঠপটের উর্ধ্বাংশ কৌণিক খিলানাকৃতি। অন্যদিকে ফরহাদ খাঁ পুলে প্রাপ্ত মূর্তিতে পৃষ্ঠপটের উর্ধ্বাংশ ত্রিভাজ খিলানাকৃতি।
মূর্তিতত্ত্ববিদ এবং বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলার প্রাচীন মূর্তির পট্টঠেস বা পৃষ্ঠপটের উর্ধ্বাংশ সাধারণত কৌণিক খিলানাকৃতি হয়ে থাকে। সিলেট শহরে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তিতে ত্রিভাজ খিলানাকৃতির বিষয়টি একটি বিরল ঘটনা।
তিনি বলেন, সিলেট অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছিল সপ্তম শতাব্দীর বৌদ্ধ মূর্তি লোকনাথ। বিয়ানীবাজারে পাওয়া গেছে ধ্যানীবুদ্ধ মূর্তি। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে সিলেটে বৌদ্ধ ধর্মের হয়তো প্রাধাণ্য ছিল। সিলেট শহরে বলরাম
আখড়ায় সন্ধান পাওয়া বিষ্ণু মূর্তি দুটির সময়কাল একাদশ-দ্বাদশ শতকের হতে পারে।
শিবলিঙ্গটি আরও পরবর্তী সময়ের হওয়ার সম্ভাবনা। বলরাম আখড়ায় রক্ষিত বিষ্ণু মূর্তি, শিবলিঙ্গ ও গণেশ মূর্তি থেকে ধারণা করা যায়, সিলেট অঞ্চলে দশম শতকে এসে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধাণ্য কমে যায়। বৈষ্ণব ও শৈব ধর্ম ক্রমশ বিস্তার লাভ করে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সিলেট জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং বলরাম আখড়া কমিটির সহ সভাপতি গোপিকা শ্যাম পুরকায়স্থ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সিলেট শহরের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহি পরিবারের পারিবারিক মন্দিরে পূজিত শিবলিঙ্গ, গণেশ মূর্তি এবং শালগ্রাম শিলা ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত
আখড়ায় প্রদান করা হয়। গণেশ মূর্তিটি কে দিয়েছিলেন-এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে সিলেট শহর থেকেই মূর্তিটি এসেছিল। কারণ মূর্তি ও শিলা দাতাদের সবাই ছিলেন সিলেট শহরের অধিবাসী।
তিনি আরও জানান, আখড়ায় রক্ষিত প্রস্তরের প্রাচীন শিবলিঙ্গটি দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত চন্দন শর্মার পরিবার।
চন্দন শর্মার ছেলে ও স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষক অমিতাভ শর্মা জানান, তার দাদা আশুতোষ শর্মা ১৯৬৫ সালে শিবলিঙ্গটি বলরাম আখড়ায় দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, রায়নগরে তাদের বাড়ি চত্বরে ছিল একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরটি বর্তমানে বিলুপ্ত। আখড়ায় দেওয়ার আগে শিবলিঙ্গটি সেই প্রাচীন মন্দিরে বংশানুক্রমিকভাবে পূজিত হয়ে আসছিল। কতদিন ধরে পূজিত হয়ে আসছিল-এ তথ্য তাদের কাছে নেই।
মৌলভীবাজার জেলায় খ্রিষ্টীয় দশম শতকে সিলেট অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত ৬ হাজার ব্রাহ্মণের মধ্যে তখন ভূমিদান করা হয়েছিল। রাজকীয় সিদ্ধান্তে ভূমিপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণদের মধ্যে শর্মা উপাধিধারী ব্রাহ্মণরাও ছিলেন বলে কমলাকান্ত গুপ্ত চৌধুরীর বই থেকে জানা যায়।
বর্তমানে বলরাম আখড়ায় রক্ষিত শর্মা পরিবারের মন্দিরের শিবলিঙ্গটির উচ্চতা ২ ফুট ১ ইঞ্চি। একটি অখন্ড পাথর কেটে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্যটি। পেডেস্টালের উপরে রয়েছে পাঁচটি স্তর। অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী শৈবরা এ মূর্তির পূজা করেন বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, দ্বৈতবাদী তথা পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্বে বিশ্বাসী শৈবরা পূজা করেন শিবলিঙ্গ- গৌরীপট্টে। শিবলিঙ্গ- গৌরীপট্টে পেডেস্টালের উপর থাকে
দুটি অংশ। পঞ্চভূত পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত শিবলিঙ্গে গৌরীপট্ট থাকে না। পেডেস্টালের উপর থাকে পাঁচটি স্তর। এই পাঁচটি অংশকে বলা হয় ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। অদ্বৈতবাদী শৈবদের মতে, এগুলো শিবের পাঁচটি সত্তা। বলরাম আখড়ায় সন্ধান পাওয়া পঞ্চভূত পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত শিবলিঙ্গটি পনের-ষোল শতকের হতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে পঞ্চভূত পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত শিবলিঙ্গ খুব একটা দেখা যায় না। পঞ্চভূত পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত শিবলিঙ্গ দেখা যায় দক্ষিণ ভারতে। সিলেট শহরে পঞ্চভূত পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত শিবলিঙ্গের সন্ধান পাওয়ার ঘটনা সিলেট অঞ্চলে দক্ষিণ ভারতীয় শৈবদের প্রভাবের ইঙ্গিত বহন করছে।
বলরাম আখড়ায় রক্ষিত মিনিয়েচার গণেশ মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় সোয়া ২ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ১ দশমিক ২ ইঞ্চি। সুধীরচন্দ্র সরকারের ‘পৌরাণিক অভিধান’ এবং হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের ‘হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’ গ্রন্থ অনুযায়ী, সকল দেবকার্যে ও পিতৃকার্যে প্রথমে গণেশ পূজিত হন।
গণেশ শৈবদের পাশাপাশি বাংলার প্রাচীন বৌদ্ধ এবং জৈনদেরও দেবতা। উপবিষ্ট, দণ্ডায়মান ও নৃত্যরত-তিন ধরনের গণেশ মূর্তি দেখা যায়। বলরাম আখড়ায় রক্ষিত মূর্তিটিতে গণেশ ললিতাসনে উপবিষ্ট। গণেশ মূর্তি
সাধারণত চতুর্ভুজ হয়ে থাকে। তবে দ্বিভুজ, ষড়ভুজ, অষ্টভুজ গণেশ মূর্তিও পাওয়া যায়।
বলরাম আখড়ায় রক্ষিত গণেশ মূর্তিটিতে হস্তির মতো মুখ, স্ফিত উদর, ললিতাসনের রীতি অনুযায়ী একটি পা নিচে ঝুলিয়ে রাখা স্পষ্টই দেখা যায়। কিন্তু গণেশের হাতের অবস্থান ততটা স্পষ্ট নয়। তবে এ ধরনের গণেশ মূর্তি সাধারণত চতুর্ভুজ হয়ে থাকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাম্মেল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, বলরাম আখড়ায় রক্ষিত গণেশ মূর্তিটি অবয়ব আছে। কিন্ত পূর্ণাঙ্গ মূর্তি নয়। তবে মূর্তিটি প্রাচীন। সিলেট শহরে আখড়ায় সন্ধান পাওয়া দুটি বিষ্ণু মূর্তি ও গণেশ মূর্তির নির্মাণকাল খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝে হতে পারে। কারণ নবম শতকের মূর্তিতে যে লম্বাটে ভাব থাকে, সিলেট শহরে আখড়ায় রক্ষিত মূর্তিগুলোতে তা অনুপস্থিত। আবার ত্রয়োদশ শতকের মূর্তিগুলোতে অলঙ্কার ও অলঙ্করণের যে বাহুল্য থাকে- সেটিও নেই।
সিলেটের বলরাম আখড়ায় রক্ষিত মূর্তিগুলোর কথা কোনো গ্রন্থে নেই বলে উল্লেখ করে অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বলেন, হযরত শাহজালাল (রা:) যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অঞ্চলটি হিন্দু রাজ্য ছিল। ফলে সিলেটে প্রাচীন এন্টিকুইটি থাকার কথা। কিন্তু সিলেটের প্রাচীন ইতিহাসের এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত উপকরণ খুব কম। প্রত্নতত্ত্ব, প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেন, পর্যাপ্ত প্রাচীন উপকরণ না থাকার কারণে রেকার করতে পারছে না। সিলেট শহরে আখড়ায় সন্ধান পাওয়া মূর্তিগুলো এক্ষেত্রে খুবই কাজের হবে।
অধ্যাপক হক আরও বলেন, সিলেটের আখড়ায় রক্ষিত শিবলিঙ্গটি বাংলাদেশে বিরল। আবার সিলেট অঞ্চলে শিব মূর্তি সন্ধান পাওয়ার ঘটনাটি আরো বিরল। শ্রীচৈতন্য, অদ্বৈত প্রমুখ সিলেটের সন্তান। সেখানে চৈতন্যের আগেই বৈষ্ণব মতবাদ বিকশিত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। দশম শতকের পর সিলেট হয়ে উঠেছিল বৈষ্ণব প্রভাবিত অঞ্চলে।
সেখানে শৈব মূর্তি পাওয়ার ঘটনা ইতিহাসকে নানাভাবে আন্দোলিত করবে, নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, সিলেটে বৈষ্ণব মূর্তি এবং শৈব মূর্তির সন্ধান পাওয়ার ঘটনা ধারণা দিচ্ছে, সেখানে তখন বৈষ্ণব ও শৈবদের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়েছিল।
শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ড. দিলিপ কুমার দাশ চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, শ্রীহট্ট তথা প্রাচীন সিলেট ছিল মন্দির নগরী। বৈষ্ণব, শৈব, শাক্তসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মঠ, মন্দির ও আখড়া ছিল প্রাচীন শ্রীহট্টে। নবদ্বীপ ছাড়া বাংলার আর কোনো শহরে শ্রীহট্টের মতো এতো অধিক সংখ্যক মন্দির ছিল না। শহরের বলরাম আখড়ায় রক্ষিত প্রাচীন বিষ্ণু, গণেশসহ প্রাচীন মূর্তিসমূহ শ্রীহট্টের মন্দির শহরের নিদর্শন বহন করছে।
তিনি মনে করেন, সিলেট শহর ও শহরতলীতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন হলে প্রাচীন আমলের আরও অনেক নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে।
Comments