উদ্বোধনের অপেক্ষায় পটুয়াখালীর ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী এলাকায় নির্মিত এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লা ভিত্তিক পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। যে কোনো সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখানকার উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
এ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শুরুর চার বছরের মধ্যেই গত বছরের ১৫ মে থেকে জাতীয় গ্রিডে প্রথম ইউনিট দিয়ে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে। আর দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু করে ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর। এখন পুরো ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম কেন্দ্রটি বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে একহাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে দৈনিক ১৩ হাজার টন কয়লা ব্যবহৃত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশের নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার কোম্পানি ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে গঠিত হয় বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী এলাকায় ৯৮২.৭৭ একর জমির ওপর বিসিপিসিএল নির্মিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা (২.৪৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার)। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে এক দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজোয়ান ইকবাল খান জানান, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) প্রথম পর্যায়ে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি ইউনিটের নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করেছে। যার একটি ২০২০ সালের ১৫ মে থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। আর দ্বিতীয় ইউনিট টি ৮ ডিসেম্বর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থকে গোপালগঞ্জ গ্রিড পর্যন্ত ১৬৩ কি.মি. সঞ্চালন লাইন নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকার আমিন বাজার পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ চলমান।
কেন্দ্রটিতে ২২০ মিটার বা ৭৫ তলা ভবনের সমান উচ্চতার চিমনি নির্মাণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে নির্গত ধোঁয়া বাতাসের নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছাবে এবং দূষণ নিয়ন্ত্রিত মাত্রার মধ্যেই থাকবে বলে জানান তিনি।
বিসিপিসিএল‘র সহকারী ব্যবস্থাপক শাহমনি জিকো জানান, সর্বাধুনিক আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কয়লা ভিত্তিক এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। কয়লাকে বয়লারে পুড়িয়ে ৬০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও ২৭ মেট্রিকটন চাপে বাষ্প উৎপন্ন করা হয়। বাষ্প দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। পরিবেশবান্ধব আধুনিক সব প্রক্রিয়া মেনে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের ফলে শতকরা ৯৯ ভাগ ফ্লাই এ্যাশ আটকানোর সক্ষমতা রয়েছে। কয়লা থেকে ফ্লাই এ্যাশ ও বটম এ্যাশ দুই ধরনের ছাই পাওয়া যায়।
এই দুই ধরনের এ্যাশ বা ছাই একটি দেশীয় কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘৭৬.৩০ একর আয়তনের ছাই ডাম্পিং জোন করা হয়েছে এবং এখানে ২৫ বছরের নির্গত এ্যাশ বা ছাই সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এখন দৈনিক ১৮০ মেট্রিক টন এ্যাশ নির্গত হয়। বর্তমানে এই প্লান্টে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আনা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখানে ৩৬৩.৭৬ একর জমিতে বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে ‘সবুজায়ন’ করা হচ্ছে। এখানে কয়লা আনলোডের ২৫ একর জায়গায় ৩৮৫ মিটার দীর্ঘ, ২৪ মিটার প্রস্থ এবং ৬.৭ মিটার উচ্চতার জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে ঘণ্টায় একত্রে চারটি জাহাজ মিলে তিন হাজার দুইশ মেট্রিকটন মালামাল খালাসের কাজ করতে পারছে। বর্তমানে কয়লা সরাসরি জাহাজ থেকে ঢাকনাযুক্ত কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থাপিত কয়লা রাখার ডোমে পৌঁছে যাচ্ছে। বাইরে থেকে দেখারও সুযোগ নেই। পরিবেশের কোনো ঝুঁকিও থাকছে না।’
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ এম খোরশেদুল আলম জানান, ইতোমধ্যে কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রটি সফলভাবে উৎপাদন শুরু করায় দেশে নতুন এক ইতিহাস সূচিত হলো।
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র খুব শিগগির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন।’
তিনি আরও জানান, প্রতিটি ১.৮০ লাখ টন ধারণ ক্ষমতার চারটি কোল ইয়ার্ড নির্মাণ করা হচ্ছে যেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৫৭ দিনের কয়লা মজুদ রাখতে পারবে। নির্গত গ্যাস ধরতে ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজার ইউনিট (এফজিডি) নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রটির ৯৬ ভাগ ফ্লু গ্যাস ধরা হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ ছাই ‘এ্যাশ হপারে’ ধরা হবে।
পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (বিসিপিসিএল) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. পিঞ্জুর রহমান জানান, গত বছর কোভিড-১৯-এর কারণে নির্মাণ কাজ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সকল নির্মাণ, কমিশনিং এবং পারফরমেন্স টেস্ট কার্যক্রম শেষ করে দুটি ইউনিট থেকেই জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে।
Comments