বাম্পার ফলন, হিমাগারে জায়গা নেই: লোকসানে লালমনিরহাট-কুড়িগ্রামের আলু চাষিরা
প্রতি কেজি আলু উৎপাদন করতে কৃষককে খরচ করতে হয়েছে ১১ থেকে ১২ টাকা। অথচ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন সাত থেকে আট টাকা কেজি দরে।
আলু আবাদ করে এ বছর চোখের পানি ঝরাচ্ছেন লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার ২০ হাজারেরও বেশি চাষি। হিমাগারগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণ আলু সংরক্ষণ করার পর আর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় আলু নিয়ে বিপদে পরেছেন কৃষক। সংরক্ষণ করতে না পেরে বাধ্য হয়েই তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীদের কাছে।
লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাটে পাঁচ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমি থেকে ২৭ লাখ ৮১ হাজার ৩০ বস্তা (প্রতি বস্তায় ৫০ কেজি আলু) আলু উৎপাদন হয়েছে। জেলার আটটি হিমাগারে আলু সংরক্ষণের সক্ষমতা রয়েছে ১৪ লাখ ৯১ হাজার ৪০০ বস্তা।
অপরদিকে কুড়িগ্রামে সাত হাজার ৩০০ হেক্টর জমি থেকে উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ ১৩ হাজার ৬০০ বস্তা আলু। জেলার চারটি হিমাগারে আলু সংরক্ষণ সক্ষমতা ছয় লাখ ২০ হাজার বস্তা।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর গ্রামের আলু চাষি মজিদুল ইসলাম (৪৮) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করে এক হেক্টর জমিতে আলু চাষ করেছি। ফলন পেয়েছেন ৪৬০ বস্তা (প্রতি বস্তায় ৫০ কেজি) আলু। এরমধ্যে মাত্র ১৫০ বস্তা হিমাগারে রাখতে পেরেছি। বাড়িতে বিশেষ ব্যবস্থায় ৫০ বস্তা আলু সংরক্ষণ করেছি। বাকী ২৬০ বস্তা আট টাকা কেজি দাম ধরে স্থানীয় ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিতে হয়েছে। কেজিতে তিন থেকে চার টাকা লোকসান হলো। শেষ পর্যন্ত পুঁজি হারাতে হয় কিনা সেই ভয়ে আছি। আলুর ফলন আশানুরূপ হয়েছে। অথচ বাজার এরকম হবে ভাবতেই পারিনি।’
লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোস্তফি এলাকার আলু চাষি মনিরুল ইসলাম (৫৫) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আলু আবাদ করে এবছর কাঁদতে হচ্ছে ভাই। গত বছর আলু চাষ করে লাভ হয়েছিলেন, তাই এবছর বেশি জমিতে চাষ করেছিলাম। প্রায় এক লাখ টাকা খরচ করে এক একর জমি থেকে ১৮৫ বস্তা আলু উৎপাদন করেছি। মাত্র ৭০ বস্তা আলু রাখতে পেরেছি হিমাগারে আর ৩০ বস্তা বাড়িতে সংরক্ষণ করেছি। বাকি আলু বিক্রি করে দিতে হলো সাত টাকা, আটা টাকা দরে।’
‘আরও বেশি ধারণ ক্ষমতার হিমাগার থাকলে আমরা বেশি আলু সংরক্ষণ করতে পরতাম। তাহলে আর লোকসানে পড়তে হতো না,’ বলে জানান লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী গ্রামের চাষি সুরেশ চন্দ্র বর্মণ (৫০)।
তিনি বলেন, ‘এবছর আলু বীজ বেশি দামে কিনতে হয়েছে। তাই উৎপাদন খরচ গত বছরের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু আলু বিক্রি করতে হয়েছে গত বছরের চেয়ে কম দামে।’
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার দাসেরহাট এলাকার চাষি সুনীল চন্দ্র দাস (৫৬) বলেন, ‘আলু চাষ করে এবছর চরম বিড়ম্বনায় পড়েছি। সাত-আট টাকা দরে আলু কেনার মানুষ পাই না। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আলু চাষ করেছি। বিক্রি করছি লোকসানে। ঋণ শোধ করব কিভাবে সেই চিন্তায় ঘুম আসে না।’
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ত্রিমোহিনী এলাকার আলু ব্যবসায়ী নবিউল ইসলাম জানান, আগের বছরগুলোতে আলু রপ্তানি করায় আলুর বাজার স্থিতিশীল ছিল। রপ্তানি চাহিদা কম থাকায় আলুর দামে মন্দ প্রভাব পড়েছে। ফলে কৃষক অপ্রত্যাশিতভাবে লোকসানের মুখে পড়েছেন।
কুড়িগ্রামে সেকেন্দার কোল্ড স্টোরেজের স্টোরকিপার আইয়ুব আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের হিমাগারে ৮০ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণের ধারণ ক্ষমতার পুরোটাই ভড়ে গেছে। হিমাগারের প্রধান গেট বন্ধ করে দেওয়া হলেও চাষিরা আলু নিয়ে এসে এখানে ভিড় করছেন।’
লালমনিরহাটের ফজল কোল্ড স্টোরেজের মালিক আশিকুর রহমান সোহাগ বলেন, ‘এক লাখ ৭০ হাজার বস্তা আলু আমার এখানে রাখা যায়। চাষিরা আলু নিয়ে হিমাগারের সামনে ভিড় করছেন। কিন্তু হিমাগারে তো আর জায়গা নেই। আমি নিরুপায় হয়ে তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছি।’
একই কথা জানা যায় লালমনিরহাটের শাহান কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার শহিদুল ইসলামের কাছ থেকেও।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামিম আশরাফ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কৃষকরা বাম্পার ফলন পেয়েছেন। আলু বীজের দাম বেশি থাকায় আলু উৎপাদন খরচও বেড়েছে। গত বছর আলুতে আশানুরূপ লাভবান হওয়ায় কৃষকরা এবছর বেশি জমিতে আলু চাষ করেছেন। ব্যবসায়ীরা আলু রপ্তানিতে ভূমিকা রাখলে কৃষকরা সন্তোষজনক মূল্য পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।’
Comments