ঘাস চাষে বদলে যাওয়া কৃষক জীবন

শুনতে কেমন লাগে যদি কোনো গ্রামের কৃষকেরা বলেন, তাদের প্রধান ফসল ঘাস! শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও বাস্তবে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার একটি গ্রামে তাই ঘটেছে।
165124208_3609815615794273_3628473312675592683_o.jpg
ঘাস চাষে স্বাবলম্বী গাইবান্ধার সুলতানপুর বাড়াই গ্রামের আব্দুল গফুর। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

শুনতে কেমন লাগে যদি কোনো গ্রামের কৃষকেরা বলেন, তাদের প্রধান ফসল ঘাস! শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও বাস্তবে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার একটি গ্রামে তাই ঘটেছে।

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরবাড়ী ইউনিয়নের সুলতানপুর বাড়াইপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠান, বাড়ির পিছনে পরিত্যক্ত জমিতে কৃষকরা লাগিয়েছেন নেপিয়ার জাতের ঘাস।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের গ্রামের ২০০ জন কৃষকের মধ্যে ১৫০ জনই চাষ করেন ঘাস। আর এই ঘাস চাষের মাধ্যমেই বদলে যাচ্ছে এলাকার কৃষকদের আর্থ সামাজিক অবস্থা। এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পাশের প্রজাপাড়া গ্রামেও একই দৃশ্য। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে অন্য ফসলের তুলনায় ঘাসই বেশি।

কীভাবে এলাকায় এই ঘাস চাষের সম্প্রসারণ হয়েছে, জানতে চাইলে কৃষকরা জানান, ১৮-২০ বছর আগে সুলতানপুর বাড়াই গ্রামের আব্দুল গফুর (৫৫) প্রথমে এই ঘাস চাষ করে সাফল্য পান। এরপর ওই এলাকার কৃষকরা অন্য ফসলের পরিবর্তে ঘাস চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হন। আস্তে আস্তে ঘাস ছড়িয়ে পরে উপজেলার ৩০-৪০টি গ্রামে। শুধু তাই নয়, পুরো গাইবান্ধা জেলার সাতটি উপজেলার হাজারো কৃষক এখন চাষ করছেন গবাদিপশুর খাদ্য নেপিয়ার ঘাস।

ঘাস চাষ যিনি শুরু করেছিলেন সেই আবদুল গফুরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘২০ বছর আগে আমি ছিলাম একজন হতদরিদ্র দিনমজুর। ক্ষুধা-দারিদ্র এবং ঋণে জর্জরিত ছিল ছয় সদস্যের সংসার। এসময় আমার গ্রামের এক স্কুলশিক্ষক আমাকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরের দিন আমি তাই করলাম।’

‘সেই সময়ের উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আমাকে নেপিয়ার ঘাসের কিছু চারা দিয়েছিলেন এবং এটি চাষ করতে বলেছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমি ঘাস চাষ করলে কী হবে? জবাবে তিনি বলেছিলেন- এটা তোমার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে। তার পর থেকে আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি,’ বলেন আব্দুল গফুর।

গফুর বলেন, ‘শুধু ঘাস চাষ এবং গরু পালন করে গত ১০-১২ বছরে জমি কিনেছি আট বিঘা, যার সেই সময়ের বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৮০ লাখ টাকা।’

এ ছাড়া, আরও ৮-১০ লাখ টাকা দিয়ে তিন ছেলেকে একটি আধা-পাকা ঘর তৈরি করে দিয়েছেন বলে জানান।

তিন ছেলেকে নিয়ে এখনো ২০ বিঘার মতো জমিতে ঘাস চাষ করেন আব্দুল গফুর। নেপিয়ার এবং সুপার নেপিয়ার-পাঞ্চচোগ-১ (হাইব্রিড) জাতের ঘাস চাষ করছেন তারা।

165052973_3609815535794281_6783312385112348234_o.jpg
নেপিয়ার ও সুপার নেপিয়ার-পাঞ্চচোগ-১ (হাইব্রিড) জাতের ঘাস চাষ করেছেন আব্দুল গফুর। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

ঘাস চাষে কীভাবে এত লাভ করছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্য যে কোনো ফসলের তুলনায় ঘাসের চাষ কম ব্যয়বহুল। কোনো কীটনাশক লাগে না। জমিতে সেচ কম লাগে। একবার কোনো জমিতে ঘাস লাগালে পরের টানা তিন বছর ধরে ফসল পাওয়া যায়। যদি এক বিঘা জমিতে নেপিয়ার চাষ করা যায় তবে প্রতি মাসে সেখান থেকে ঘাস কাটা যায়। এক বিঘা জমি থেকে ৩ হাজার আটি (৫-৬ কেজি ওজনের) ঘাস কাটা যায়, যার বর্তমান বাজারমূল্য ২০-৩০ হাজার টাকা (প্রতি আটি ৮-১০ টাকা)। এক বছরে এইভাবে একই জমি থেকে ৭-৮ বার ঘাস কাটা যায়। প্রতি বিঘা জমিতে বছরে খরচ হয় ৩০-৪০ হাজার টাকা আর লাভ হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা।’

তবে ২০০০ সালের দিকে গফুর যখন ঘাস চাষ শুরু করেন তখন গ্রামের লোক তার সমালোচনা করতে শুরু করেন। এমনকি তার নাম বদলে রাখা হয় ‘ঘাস গফুর’।

তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আবদুল গফুরের ছেলে ফারুক হাসান (২৮) বলেন, ‘আমরা ঘাস চাষ করে আমাদের দারিদ্র্য ঘুচিয়েছি। এলাকার হাজার হাজার কৃষক আমার বাবার সাফল্য অনুসরণ করছেন এবং তাদের দারিদ্র্য দূর করার জন্য ঘাস চাষ করছেন।’

ফারুক হাসান বলেন, ‘একসময় এই এলাকায় দরিদ্র মানুষের জন্য খুব বেশি কাজ ছিল না। বেকার বসে থাকতেন অনেক মানুষ। তবে এখন এলাকার অনেক কৃষক যারা কাজের সন্ধানে গার্মেন্টসে গিয়েছিল, তারা বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন এবং ঘাস চাষ করে নিজের দারিদ্রতা দূর করছেন।’

আশেপাশের গ্রামের প্রায় ৩০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা হলো, যারা সবাই এখন ঘাস চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং এলাকায় ঘাস চাষের প্রচলন করার জন্য আব্দুল গফুরের প্রশংসা করেছেন।

তার সাফল্য অনুসরণ করে সুলতানপুর বড়াইপাড়া ও সংলগ্ন প্রজাপাড়া, দিঘলকান্দি, বড় শিমুলতলা, কাছারিপাড়া, আশমতপুর, লোকমানপুর, কিশোরগাড়ি, কাসিয়াবাড়ী, কাতুলি এবং বেনগুলিয়া গ্রামের কয়েক হাজার কৃষক এখন ঘাস চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা।

সুলতানপুর বড়াইপাড়া গ্রামের কৃষক মো. জহুরুল ইসলাম (৪২) বলেছেন, ‘দশ বছর আগে তামাক এই এলাকার প্রধান ফসল ছিল, কিন্তু ঘাস তামাক চাষের জায়গা দখল করে নিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগে অন্যান্য ফসল যেমন তুলা, কলা, মরিচ, টমেটো এবং বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির আধিপত্য ছিল, তবে এখন নেপিয়ার সুলতানপুর এবং প্রজাপাড়া গ্রামের প্রধান ফসল।’

আসমতপুর গ্রামের আরেক কৃষক আবদুল জলিল (৩২) বলেন, ‘এমন কোনো ফসল নেই যা চাষ করলে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না, কিন্তু নেপিয়ার ঘাসই একমাত্র ফসল যা চাষ করলে কখনো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি। আমি এক বিঘা জমিতে ঘাস লাগিয়ে মাসে ২০ হাজার টাকা লাভ করছি।’

প্রজাপাড়া গ্রামের কৃষক মইনুল ইসলাম (৫০) বলেন, ‘নেপিয়ারের চাষ আমাদের এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করেছে। এই এলাকার কৃষকরা শুধু ঘাসই চাষ করছে না, একইসঙ্গে গরুও পালন করছে। গ্রামের প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে আপনি গরু দেখতে পাবেন। পাশাপাশি প্রত্যেকের রয়েছে একটি করে ভ্যান, যাতে করে কৃষকরা ঘাস নিয়ে যায় এলাকায় হাট-বাজারগুলোতে। কারও জরুরি টাকার প্রয়োজন হলে ঘাস বিক্রি করে সেই টাকার বন্দোবস্ত করে।’

একই গ্রামের কৃষক জাফর আহমেদ বলেন, ‘সকালে রাস্তায় দেখতে পাবেন ঘাসের ভ্যানের সারি। আমাদের গ্রামের ৫০-৬০ জন কৃষক প্রতিদিন সকালে ভ্যানে করে ঘাস নিয়ে গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, বগুড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাট-বাজারে নিয়ে যায় বিক্রির জন্য। এখন সবার ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, কষ্ট কমেছে।’

165223210_3609815782460923_688611811603207463_o.jpg
তিন ছেলেকে নিয়ে এখনো ২০ বিঘার মতো জমিতে ঘাস চাষ করেন আব্দুল গফুর। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

‘গতবছর এই এলাকায় তিন-চার দফায় বন্যা হয়। বন্যায় আমাদের এলাকায় খড়ের খুব অভাব হয়, তখন এই ঘাস আমাদের গবাদি পশুদের রক্ষা করেছে এবং অনেকে ভালো লাভও করেছে ঘাস বিক্রি করে,’ বলেন আরেক কৃষক সুরুজ মিয়া (৫০)।

‘শুধু তাই নয়, এই এলাকায় কৃষকদের মধ্যে রাসায়নিক সার ব্যবহারের প্রবণতা অনেক কমেছে। কারণ বাড়িতে গরু থাকায় তাদের গোবর সারের অভাব হয় না’, যোগ করেন তিনি।

পলাশবাড়ী উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলতাব হোসেন এলাকার কৃষকদের উন্নতি স্বীকার করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত ১০ বছরে এই এলাকায় নেপিয়ার ঘাস চাষ বেড়েই চলছে। জেলার মোট ঘাসের ৪০ শতাংশ এই উপজেলায় চাষ হয়। এমনকি এই ঘাস চাষের ফলে কমেছে ক্ষতিকর তামাক চাষ।’

গাইবান্ধা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাছুদার রহমান সরকার বলেন, ‘জেলায় এখন মোট ঘাসের আবাদি পরিমাণ ৩৭৩ হেক্টর। আস্তে আস্তে সারা জেলায় ঘাস চাষের পরিমাণ বাড়ছে। এমনকি যাদের নিজের জমি নেই তারা রাস্তার দুই পাশেও ঘাসের চাষ করছেন।’

ঘাস চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য আব্দুল গফুর বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছেন ২০১৪ সালে। তবে আব্দুল গফুর অভিযোগ করে বলেন, ‘স্থানীয় কৃষি অধিদপ্তর ঘাস চাষে কৃষকদের কোন রকম পরামর্শ বা প্রশিক্ষণ দেয় না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলাশবাড়ী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আসলে ঘাস কোনো ফসল নয়, তাই এই বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আমাদের সরকারি কোনো বরাদ্দ আসে না। বিষয়টি দেখে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস।’

Comments