জাপানে সাড়ে সত্তর দিন
জাপানে এসেছি ঠিক দুই মাস সাড়ে দশ দিন আগে। জাপানে আসব শুনে আমার বন্ধুরা আমাকে রবীন্দ্রনাথের ‘জাপান যাত্রী’ পড়তে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু, করোনাক্রান্ত পৃথিবীতে ভ্রমণ প্রস্তুতির ব্যস্ততায় সেই অনুরোধ আমি রাখতে পারিনি।
ভাগ্যিস পারিনি। পারিনি বলেই রবি বাবুর চোখ দিয়ে দেখার আগে আমার নিজের চোখে জাপান দেখতে পেরেছি। আর এখন ‘জাপান যাত্রী’ পড়ে একশ বছর আগের কবিগুরুর দেখা জাপানের সঙ্গে আমার আজকের দেখা জাপানের মিল খুঁজে পেয়ে আপ্লুত হচ্ছি।
আমাদের দু’জনের জাপান সফরের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। আসলে গন্তব্যস্থল ছাড়া আর কোনো মিল নেই। কবিগুরু এসেছিলেন ভারতের মুম্বাই বন্দর থেকে জাহাজে চড়ে, নেমেছিলেন কোবে সমুদ্রবন্দরে। আমি এসেছি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে বিমানে চড়ে, নেমেছি টোকিওর হানেদা বিমানবন্দরে। কবিগুরু এসেছিলেন এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক হিসেবে জাপানের তৎকালীন দেশসেরা শিল্পী-সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণে এবং ছিলেন ইয়োকোহামার সমুদ্রতীরে অবস্থিত বিশিষ্ট রেশম-ব্যবসায়ী তমিতারো হারা-সানের সাংকেইন নামের বাগানবাড়িতে। আমি এসেছি জাপানের জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থার অর্থায়নে দুই বছরের বৃত্তি নিয়ে, থাকছি যদিও সেই ইয়োকোহামাতেই। কিন্তু সেটা আমার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছাকাছি এলাকায় একটা দুই-কামরার ভাড়া বাসায়। শত বছর আগেও কবিগুরু কোবেতে এসে উঠেছিলেন একজন ভারতীয়ের বাড়িতে, দেখা পেয়েছিলেন বাঙালির। আর দু’হাজার একুশ সালে ইয়োকোহামাতে এসে একজন বাংলাদেশি খুঁজে পেতে আমার লাগল প্রায় এক মাস।
ভ্রমণের গন্তব্যস্থলকে আপনি কীভাবে দেখবেন সেটা নির্ভর করবে আপনি কোথা থেকে যাত্রা শুরু করেছেন তার ওপর। এই যেমন আমি যখন অস্ট্রেলিয়া থেকে ইউরোপে যাই, ইউরোপ আমাকে প্রথম দেখায় মুগ্ধ করতে পারেনি। আমার মনে হয়েছিল আমি যেন একটা নতুন, চকচকে শহর থেকে প্রায় একই রকম দেখতে- কিন্তু একটু পুরনো আরেকটা শহরে এসে পড়েছি। অথচ ঢাকা থেকে দিল্লি গিয়ে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম, কারণ প্রথম দেখায় ঢাকা-দিল্লির পার্থক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কবিগুরুও তার ভ্রমণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জাপানকে তুলনা করেছেন একদিকে ভারত আর অন্যদিকে ইউরোপের সঙ্গে। ভারতের সঙ্গে তুলনায় হয়েছেন প্রচণ্ড হতাশ, আবার তার ঠিক একটু পরেই পশ্চিমের সঙ্গে তুলনায় জানিয়েছেন তার মুগ্ধতার কথা। আমিও আমার জাপান ভ্রমণে জাপানকে দেখছি একজন বাংলাদেশির চোখ দিয়ে। যে চোখে লেগে আছে দক্ষিণের রং-রূপ-রস। তাই আমাদের দেখার ভঙ্গী ও বিষয়বস্তুতে মিল-অমিল দুটোই থাকবে।
এই আড়াই মাসে জাপানিদের যে কয়েকটা বৈশিষ্ট্য আমার চোখে বিশেষভাবে ধরা পড়েছে তার মধ্যে একটি হলো এদের মিতভাষিতা। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া এরা কথা বলে না বললেই চলে। ট্রেনে-বাসে সহযাত্রীর সঙ্গে যেচে আলাপ করে না। সবচেয়ে অবাক হলাম এটা জেনে যে এদেশে ট্রেনে চেপে মুঠোফোনে কথা বলা বারণ। অবশ্য এতে এদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হল না। যোগাযোগের প্রয়োজনে এরা ক্ষুদেবার্তা আদান-প্রদান করে। জনবহুল এদেশে ট্রেনে প্রতিদিন অনেক মানুষ চলাচল করে- অনেকে বই পড়ে, হেডফোনে গান শুনে, অথবা ঘুমিয়ে সময় পার করে দেয়। এর মধ্যে কয়েকজন একসঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলা শুরু করলে জায়গাটা যে অনেকটা আমাদের দেশের মাছ-বাজারের মত হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জাপানি মাছ-বাজার যদিও উপাসনালয়ের মতোই নীরব। দর কষাকষি নেই, হুড়োহুড়ি নেই, নেই ছুরি-বটির ঝনঝনানি। কবিগুরু লিখেছিলেন জাপানিরা উচ্চস্বরে কথা বলতে জানে না, আর জাপানি ভাষার অভিধানে নেই কোনো গালি। আমারও মনে হলো জাপানিদের এই ভদ্রতা লোক দেখানো বা পোশাকি আচরণ নয়– একেবারে ভেতরকার, একান্ত স্বভাবজাত।
জাপানিরা ভ্রমণপিয়াসু। বিমানবন্দর থেকে যে ট্যাক্সিতে করে আমাদের এয়ার-বিএনবিতে এসেছিলাম তার চালক উৎসুমি-সান যখন কথা প্রসঙ্গে জানলেন আমরা সিডনি থেকে এসেছি, তিনি বললেন- সিডনি তার খুব পছন্দের শহর। আরও জানালেন- তিনি গত বছর সিডনি ঘুরে এসেছেন এবং সুযোগ পেলে আবারও যেতে চান। জাপানি পাসপোর্ট এখন বিশ্বের শক্তিশালী পাসপোর্টগুলোর তালিকায় সবার ওপরে আছে। যার মানে হলো জাপানিরা ভিসা ছাড়াই শুধু তাদের পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশেই যেতে পারে।
অধ্যাপক সেতা-সান, জাপানে যিনি আমার গবেষণা সহযোগী, আমাকে তার অফিসে জাতিসংঘের প্রতীক আঁকা কাপে কফি খেতে দিলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাপটা তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন। উত্তরে জানালেন- তিনি ঠিক মনে করতে পারছেন না। তবে জাতিসংঘের প্রধান অফিসগুলোর কোনো একটা থেকে হবে। প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের প্রধান অফিসগুলো নিউইয়র্ক, জেনেভা, নাইরোবি, ভিয়েনা এবং হেগ শহরে অবস্থিত। আর সেতা-সানের সঙ্গে এর আগে আমার দু’বার দেখা হয়েছিল। একবার সিডনিতে আর একবার ম্যানিলাতে। কত ঘুরতে পারেন লোকটা!
ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি জাপানিরা খুব সময়ানুবর্তী হন। এখানের রাস্তার মোড়ে, পার্কে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে স্থাপিত বিশালাকারের ঘড়িগুলো সে কথাটাই আবার মনে করিয়ে দিল। কিন্তু, জাপানে মাসদুয়েক থেকে কথাটার একটা আলাদা মানে খুঁজে পেলাম- এরা সময়ের কাজ সময়ের কিছুটা আগেই করে ফেলে। এই যেমন একদিন সেতা-সানের সঙ্গে আমার মিটিং ছিল দুপুর দুটোয়। অন্যদিনের মতো ঠিক সময়ে না পৌঁছে ওইদিন আমি একটু আগেই পৌঁছে গেছি এবং স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। ইয়োকোহামাতে সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল সেকারণে ট্রেনও কিছুটা দেরি করে গন্তব্যে পৌঁছচ্ছিল। দুটো বাজার দশ মিনিট আগে সেতা-সান ক্ষুদেবার্তা দিয়ে জানাল তার হয়ত কিছুটা দেরি হবে। কিন্তু, তিন একদম ঠিক সময়ে পৌঁছালেন এবং আরও আগে পৌঁছাতে না পারার কারণে অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন। আরেকদিন সেতা-সান তার এক জাপানিজ ছাত্রকে আমার ব্যাংক একাউন্ট খোলার ব্যাপারে সাহায্য করতে বললেন। আমি নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিটা আগে পৌঁছে দেখি সে আমার আগেই স্টেশনে এসে হাজির। জিজ্ঞেস করে জানলাম সে প্রায় দশ মিনিট যাবত আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিল। এই ব্যাপারটা ঠিক ভাল কিনা বুঝতে পারছি না, কারণ আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে ‘বেশি ভাল ভাল নয়’।
তবে, সবকিছু ছাপিয়ে সবার আগে যেটা চোখে পড়বে সেটা হচ্ছে জাপানিদের সৌন্দর্যবোধ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। এখানকার পথ-ঘাট, ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালত সবকিছু এমন ঝকঝকে তকতকে যে মাঝে মধ্যে অনেক জায়গায় জুতা পায়ে যেতে অস্বস্তি হয়। তাই বলে রাস্তায় তো আর খালি পায়ে যাওয়া যায় না! পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে তাদের সৌন্দর্যবোধও দৃষ্টি এড়াবে না, যেমন এড়ায়নি কবিগুরুর। তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্যের অনুভূতি এখানে এত বেশি করে এবং এমন সর্বত্র দেখতে পাই যে স্পষ্টই বুঝতে পারি যে, এটা এমন একটা বিশেষ বোধ যা আমরা ঠিক বুঝতে পারি নে।’ আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘জাপানের যে-সৌন্দর্যবোধ সে তার একটা সাধনা, একটা প্রবল শক্তি। বিলাস জিনিসটা অন্তরে বাহিরে কেবল খরচ করায়, তাতেই দুর্বল করে। কিন্তু, বিশুদ্ধ সৌন্দর্যবোধ মানুষের মনকে স্বার্থ এবং বস্তুর সংঘাত থেকে রক্ষা করে।’
জাপানের স্থলভাগের প্রায় ৭০ শতাংশই পাহাড়-পর্বতে আচ্ছাদিত। তাই প্রায় ১২ কোটি মানুষের সবাই থাকে অবশিষ্ট ৩০ ভাগ বাসযোগ্য সমতলে। যে কারণে জাপানের ঘর-বাড়ির আয়তন বেশ ছোট হয়। কিন্তু, সেই ছোট ছোট বসতবড়িগুলোকে এরা এত সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে যে তার আয়তনের সংকীর্ণতা অনুভব করার সুযোগ নেই। এদের দোকান-পাঠ, বাগান, আর রাস্তা-ঘাটের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এমনকি এখানকার পথের ধারের ম্যানহোলের লোহার ঢাকনা গুলোতেও রয়েছে দৃষ্টিনন্দন নানান নকশা। এ ছাড়া, জাপানিরা তাদের বাড়ির উঠানে ও রাস্তার পাশের গাছগুলোর ডাল-পালা এমন মাপমতো ছেঁটে রাখে যে, দেখে মনে হয় সেগুলো একেকটা শিল্পকর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আব্দুল্লাহ আল আরিফ, শিক্ষক ও গবেষক, পোস্টডক্টরাল ফেলো, ইয়োকোহামা সিটি ইউনিভার্সিটি, ইয়োকোহামা, জাপান।
Comments