কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নজরদারি ডেটাই মূল অস্ত্র
কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মৃত্যুর হার যাচাইয়ে জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ কারিগরি পরামর্শক গ্রুপের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন, যেহেতু করোনাভাইরাস খুব সহজে দূর হচ্ছে না তাই জনস্বাস্থ্য নীতিনির্ধারকদের এই মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নির্ভুল এবং পর্যাপ্ত নজরদারি (সার্ভিলেন্স) ডেটার গুরুত্ব এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, কোভিড-১৯ মহামারি দেশে আঘাত হানার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বাংলাদেশ সুসংগঠিত এবং গবেষণা করার উপযোগী বৈজ্ঞানিক ডেটা তৈরি করার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে।
‘কোভিড-১৯ খুব শিগগির দূর হচ্ছে না। তাই আমাদের জনস্বাস্থ্য নীতিগুলোকে বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং এটা তখনই সম্ভব হবে যখন বৈজ্ঞানিকদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে গবেষণা করার উপযোগী নজরদারি ডেটা আসবে’, দ্য ডেইলি স্টারকে জানান নজরুল, যিনি একই সঙ্গে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক এবং মহামারি বিশেষজ্ঞ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম বিভাগের (ইউএন ডেসা) মধ্যে সমন্বিতভাবে কাজ করার উদ্দেশ্যে এই যৌথ পরামর্শক দলটি তৈরি করা হয়েছে। দলটির প্রাথমিক কাজ হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে মহামারিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে প্রাণ হারানো মানুষের সঠিক সংখ্যাটি খুঁজে বের করার কাজে দিক নির্দেশনা ও সহায়তা দেওয়া।
৩১ সদস্য বিশিষ্ট পরামর্শক দলে নজরুল ইসলাম একমাত্র বাংলাদেশি।
ডা. নজরুল ইসলাম এবং দলটির আরও দুজন সদস্য ২০১৬ থেকে শুরু করে ২৯টি দেশে নথিভুক্ত হওয়া সব মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করছেন। তবে এই ২৯টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই বলে জানিয়েছেন ডা. নজরুল।
তিনি জানান, ‘আমরা এসব দেশকে নির্বাচন করেছি, কারণ তাদের কাছে এ সংক্রান্ত নির্ভুল ডেটা আছে। আমরা একটি নতুন মডেলের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে মৃত্যুর ধারাকে বিশ্লেষণ করব, এবং তার ফলাফলকে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ের মৃত্যুগুলোর সঙ্গে তুলনা করব।’
নজরুল বলেন, ‘আমাদের পরিসংখ্যান মডেলটিতে প্রতি সপ্তাহে মারা যাওয়া শিশু, পুরুষ ও মহিলাদের বয়স অনুযায়ী বিস্তারিত তথ্য দরকার। মৃত্যুর হারের নির্ভুল হিসাব করার জন্য আমাদের হাতে গত কয়েক বছরের বিস্তারিত ডেটা দরকার। আমাদের জানা মতে, এ ধরনের ডেটা বাংলাদেশে এখনো উপলব্ধ নয়।’
নজরুলের মতে, ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ানো রোগ সম্পর্কে আরও ভালো করে জানার জন্যেও এ ধরনের বিস্তারিত তথ্যের প্রয়োজন আছে।
‘উদাহরণ হিসেবে, টেস্ট পজিটিভ হওয়ার হারকে ভাইরাস সংক্রমণের হার হিসেবে ধরে নিলে সেটি ভুল হবে। এখানে টেস্টের নির্ভুলতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে জনগোষ্ঠীর ওপর কোভিড-১৯ টেস্ট চালানো হচ্ছে, তারাও গুরুত্বপূর্ণ। যদি এক হাজার ফ্রন্ট-লাইন কর্মীদের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়, তাহলে ঘরে বসে নিরাপদে কাজ করছে এরকম এক হাজার মানুষের চেয়ে তাদের মধ্যে সংক্রমণের হার অনেক বেশি থাকবে’, বলেন তিনি।
তিনি বাংলাদেশে চলমান টিকাদান কর্মসূচির প্রশংসা করেছেন, তবে সাথে সতর্ক করে বলেছেন যে শুধু টিকার মাধ্যমে এই মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
‘আমি এখনো যুক্তরাজ্যে কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন নেওয়ার জন্য মনোনয়ন পাইনি। বাংলাদেশ ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে, যেহেতু কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন মানুষকে এই রোগের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে সুরক্ষা দিতে শুরু করেনা, তাই আমাদের উচিত হবে টিকা নেওয়ার পরও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা, সঠিক ভাবে মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা সহ অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া’, বলেন তিনি।
তবে তিনি এই কঠিন সময়ে সবার প্রতি সহমর্মিতা দেখানোরও আহ্বান জানান।
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি প্রায় এক বছর ধরে ঘরে আটকে আছি, এবং শারীরিক দূরত্ব এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছি। আমি জানি যে এ ব্যাপারটি অনেকের জন্যেই কঠিন। কিন্তু এটি সবার বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য। একজন আরেকজনকে সুস্থ রাখার জন্য এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’
সম্প্রতি বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্য নিয়ে অনেক কিছু করার আছে।
‘সেই সঙ্গে বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে কাজ করতে হবে, যেমন সঠিক পদ্ধতিতে টিকাদান চালিয়ে যাওয়া, মানুষকে মহামারির ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করা, এবং কার্যকর নজরদারি নিশ্চিত করা। যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে আমি বলব যে একটি জনস্বাস্থ্য ক্যাম্পেইন এবং নজরদারিতে বেশি বিনিয়োগ করা উচিত’, বলেন নজরুল ইসলাম।
নজরুল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহামারিবিদ্যায় মাস্টার্স, এবং ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীব-পরিসংখ্যানের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এর আগে তিনি মেডিকেল প্রশিক্ষণ নিয়ে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এরপর তিনি গবেষণা সহযোগী হিসেবে ‘কার্ডিওমেটাবোলিক ডিজঅর্ডার’ নিয়ে কাজ করার জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
তার সাম্প্রতিক গবেষণার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কোভিড-১৯ কে আরও ভাল করে বোঝার প্রচেষ্টা।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এখন ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য রেকর্ড, গবেষণা পদ্ধতি, মেডিকেল পরিসংখ্যান এবং মেশিন লার্নিংয়ের সমন্বিত ব্যবহারে কার্ডিওভাসকুলার রোগের প্রকোপ নিরূপণ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি একই সঙ্গে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের একজন গবেষণা সম্পাদক।
Comments