টাঙ্গাইলে নিষেধাজ্ঞায় সাড়া নেই, দোকান খোলার দাবিতে ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ

করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান সরকারি নিষেধাজ্ঞায় তেমন সাড়া মেলেনি রাজধানীর পাশের জেলা টাঙ্গাইলে। এক সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞার প্রথমদিন থেকেই শুধু গণপরিবহন ও শহর এলাকার কিছু দোকানপাট বন্ধ থাকলেও আর প্রায় সবকিছুই চলছে স্বাভাবিক দিনের মতোই।
Tangail-2.jpg
টাঙ্গাইল শহরের শহীদ জগলু সড়কে ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ। ছবি: স্টার

করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান সরকারি নিষেধাজ্ঞায় তেমন সাড়া মেলেনি রাজধানীর পাশের জেলা টাঙ্গাইলে। এক সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞার প্রথমদিন থেকেই শুধু গণপরিবহন ও শহর এলাকার কিছু দোকানপাট বন্ধ থাকলেও আর প্রায় সবকিছুই চলছে স্বাভাবিক দিনের মতোই।

জীবন জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে এসেছে মানুষ। জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে মানুষকে নিষেধাজ্ঞা পালনে কিছু প্রশাসনিক তৎপরতা দেখা গেলেও তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। শহরাঞ্চলে কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব থাকলেও গ্রামাঞ্চলে এর কোনো প্রভাবই পরিলক্ষিত হয়নি।

এমতাবস্থায় করোনা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি নিয়ে গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন জেলার অভিজ্ঞ ও সচেতন মহল। তাদের প্রশ্ন- জেলায় বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা, চিকিৎসক ও সেবাদানকারীর অপ্রতুলতা এবং আইসিইউসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকায় যেখানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি সামাল দিতেই হিমশিম খেয়ে হয়, সেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মত বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলা কীভাবে সম্ভব? তাদের আশঙ্কা- সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ নিতে না পারলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।

প্রায় সবকিছু সচল রেখে শুধু গণপরিবহন, মার্কেট, শপিংমল ও দোকানপাট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তকে চরম অযৌক্তিক উল্লেখ করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন জেলার ব্যবসায়ীরা। দোকান খোলা রাখার দাবিতে আজ মঙ্গলবার শহরে বিক্ষোভ করেছেন তারা।

বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে টানা লোকসানের পর করোনার এই দ্বিতীয় ধাক্কা তাদের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে এনেছে। আবার সবকিছু বন্ধের এই সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের জন্য মরার ওপর খরার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় পথে বসা ছাড়া তাদের আর কোনো গতি নেই।

শহরের কয়েকজন পোশাক ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, দুই ঈদ, পূজা এবং পয়লা বৈশাখের মতো বড় উৎসবের আগে তাদের বেশ ভালো বিক্রি হয়। এতে বছরের অন্য সময়ের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার একটা সুযোগ আসে।

ব্যবসায়ী মাসুদ মিয়া বলেন, ‘করোনার কারণে গত বছর আমরা কোনো উৎসবেই ব্যবসা করতে পারিনি। ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবারের বৈশাখ এবং ঈদের বেচাকেনার আশায় ধারদেনা করে দোকানে পোশাক তুলে ফেলেছি ঠিক তখনই এলো সরকারি নিষেধাজ্ঞা। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান পরিচালনার সুযোগ চাই।’

টাঙ্গাইলের কয়েক হাজার পরিবহন শ্রমিকের একজন দেলদুয়ারের মোহাম্মদ পারভেজ। তিনি ঢাকা-টাঙ্গাইল বাস সার্ভিস ধলেশ্বরী পরিবহনের একজন হেলপার। সোমবার দুপুরে তাকে দেখা গেল উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছেন টাঙ্গাইল বাস টার্মিনাল মালিক সমিতির কার্যালয়ের সামনে। তার আশা- নিয়োগকর্তা বাস মালিকের সঙ্গে দেখা হলে সাহায্য চেয়ে বন্ধের দিনগুলোতে পরিবারের সদস্যদের দুবেলা দুমুঠো খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা।

‘আমরা কী করতে পারি? গত বছরও অনেকদিন কষ্ট করছি, অনেক ধার-দেনা করছি, এখন আবার সেই একই বিপদ। গাড়ি বন্ধ থাকলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?’ বলেন পারভেজ।

পারভেজের মতো দিন আনে দিন খায় কিংবা নিম্নআয়ের এমন অসংখ্য মানুষ ইতোমধ্যেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অথবা পড়ার হুমকিতে আছেন। একদিকে আয় রোজগার বন্ধ, অপরদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে উৎকণ্ঠায় দুর্বিসহ দিন কাটছে তাদের।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. আতাউল গণি সাংবাদিকদের বলেন, ‘করোনাভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে, আক্রান্ত হওয়ার মাত্র এক-দুই দিনের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। তাই সরকারি নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে প্রয়োজনে আরও কঠোর হবেন তারা। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে জরিমানা ছাড়াও প্রয়োজনে কারাদণ্ড দেওয়ার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

নিষেধাজ্ঞা চলাকালে দরিদ্র এবং কর্মহীনদের খাদ্য বা আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কোনো সরকারি পরিকল্পনা আছে কি না? জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘দরিদ্রদের সহায়তার জন্য অনেকগুলো সরকারি কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এ ছাড়াও, রমজান উপলক্ষে প্রায় এক কোটি মানুষকে বিশেষ সহায়তা দেবে সরকার।’

শহরের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের কর্মচারী আব্দুল লতিফ বলেন, ‘করোনার ভয়ে লকডাউন ঘোষণার পর ক্লিনিকের অধিকাংশ ডাক্তার রোগী দেখতে চেম্বারে বসছেন না। এতে ক্লিনিকের আয় কমে গেছে। সামনে রমজান ও ঈদ, দুশ্চিন্তায় আছি বেতন পাব কি না।’

Tangail-1.jpg
সরকারি ঘোষিত নিষেধাজ্ঞার প্রথমদিনে গতকাল টাঙ্গাইল শহরের একটি মিস্টির দোকানে ভিড়। ছবি: স্টার

করোনার দ্রুত বিস্তারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জেলায় কর্মরত কয়েকজন চিকিৎসক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে দিনের সংক্রমণ হার সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। প্রতিবেশী দেশের এই ঢেউ আমাদের দেশে এসেও লাগতে পারে।

তারা আরও বলেন, টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া গেলেও তা আক্রান্ত না হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে না, কারণ এর জন্য কমপক্ষে ৬০-৬৫ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হবে। সে হিসেবে প্রায় ১২ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে, যা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

চিকিৎসক আনোয়ার সাদাত বলেন, ‘লকডাউন বা কঠোর নিষেধাজ্ঞাই যাই বলা হোক না কেন, কোনোটাই এখন মানুষ সেভাবে মানবে না। প্রথম দিনই তা বোঝা গেছে। দলীয় কিছু লোক ছাড়া দেশের অধিকাংশ জনগণের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বা ঘরে রাখতে সরকারের অভিভাবকসুলভ ভূমিকা নেওয়ার জন্য যে সামর্থ্য এবং গ্রহণযোগ্যতা থাকা প্রয়োজন ছিল বর্তমানে দায়িত্বশীলদের তা নেই।’

‘এই পরিস্থিতিতে ডাক্তার আর সেবাদানকারীদের কী দোষ, তাদেরও পরিবার-পরিজন আছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, তারাও ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর এভাবে আক্রান্ত হতে থাকলে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য ডাক্তার বা সেবার জন্য সেবাদানকারীদেরই আর পাওয়া যাবে না। তখন কী অবস্থা হবে?’, প্রশ্ন ডা. সাদাতের।

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু যদি সবাইকে মাস্ক পড়ানো আর সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত ঘরে রাখা যেতো, তবে করোনার বিস্তার আনেক কমে যেতো। শুধু পুলিশ এবং সিভিল প্রশাসন দিয়ে এখন তাদের মানানো যাবে না।’

জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবুল ফজল মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এর আগে লকডাউনে যেমন সাড়া পাওয়া গিয়েছিল, এবার তেমনটি হয়নি। উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট করোনা ডেডিকেটেড ইউনিট চালু আছে। একই হাসপাতালে দশ শয্যাবিশিষ্ট একটি আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে।’

তবে কবে নাগাদ কাজটি শেষ হবে তা বলতে পারেননি সিভিল সার্জন।

Comments

The Daily Star  | English

3 quota protest leaders held for their own safety: home minister

Three quota protest organisers have been taken into custody for their own safety, said Home Minister Asaduzzaman Khan

9m ago