করোনাকালে সচল: গার্মেন্টস খাত থেকে শেখার আছে
এক.
লকডাউন ব্যর্থ হলো। লকডাউন ঘোষণার দুদিনের মাথায় গণপরিবহন চলতে শুরু করেছে। ব্যক্তিগত বাহন তো প্রথম দিনেও চলেছে। গতকাল শুক্রবার থেকে খুলেছে দোকানপাট। ওদিকে বাড়ছে করোনার প্রকোপ। প্রতিদিন করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিটি দিন ঠিক তার আগের দিনের চেয়ে খারাপ যাচ্ছে।
গণমাধ্যমের খবরে দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর কোনো হাসপাতালে সিট পাওয়া যাচ্ছে না। রোগী এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে পথে মারা গেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। দেশের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন সারাহ বেগম কবরী, যিনি একজন সংসদ সদস্যও ছিলেন, তার জন্যে একটি আইসিইউ বেড খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। শেষমেশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে তিনি একটি হাসপাতালে আইসিইউ বেড পেয়েছেন। সহজেই ধারণা করা যায়, এরকম অবস্থায় সাধারণ মানুষের কী হাল। আইসিইউ দূরে থাক, হাসপাতালে সিটই নেই। মানুষ চিকিৎসা ছাড়াই থাকবে এই দুঃসময়ে?
করোনা শুরুর পরে আমরা পুরো একটি বছর পেয়েছি। এই লম্বা সময়টাকে কি আর একটু ভালোভাবে কাজে লাগানো যেতো না? শুরুতেই আমরা জেনে গিয়েছিলাম আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের দুর্দশার কথা। আইসিইউ বেডের অপ্রতুলতার কথা। এক বছরেও আইসিইউ বেডের সংখ্যা কেন সেরকম বাড়লো না এই প্রশ্নের কী জবাব দেবে রাষ্ট্র বা সরকার?
তারপর সমস্যা যখন একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার উপক্রম, তখন তড়িঘড়ি লকডাউন ঘোষণা করা হলো। দেখা গেলো লকডাউনের মতো চূড়ান্ত একটি ব্যবস্থা যতটা সুপরিকল্পিতভাবে নেওয়ার দরকার ছিলো ততটা সুপরিকল্পিতভাবে নেওয়া হয়নি। না কর্তৃপক্ষ এর জন্যে তৈরি ছিলো; না জনগণ এর জন্যে তৈরি ছিলো। গত একবছর ধরে আমরা যে দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, মানব ইতিহাসের একটি অন্যতম বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করছি, সেই অভিজ্ঞতা আর তার থেকে পাওয়া শিক্ষণের প্রতিফলন দেখা গেলো না।
অফিস খোলা রেখে যানবাহন বন্ধ করা হলো। মানুষকে বের হতে হলো। যাতায়াতের ভোগান্তি হলো। অফিস খোলা, কারখানা খোলা, অথচ দোকান বন্ধ। এই আপাত স্ববিরোধিতা সমাজে কারো কারো মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, যার প্রভাবে আমরা ঢাকার রাস্তায় বিক্ষোভ হতে দেখেছি।
লকডাউন কার্যকর হলে সবার দৈনন্দিন জীবনে ছন্দপতন হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গরীবের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি গরীব তার ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্র তার দৈনিক আয়ের পথ বন্ধ হওয়ার মতো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে সে কী খেয়ে থাকবে সেই চিন্তা করবে এটাই তো প্রত্যাশিত। লকডাউনের ঘোষণার সঙ্গে সেই ঘোষণাও আসা দরকার ছিলো। গতবছর সরকার সেই ব্যবস্থা নিয়েছিলো। এবার নেয়নি। গরীব মানুষ, যাদের প্রতিদিনের আয় দিয়ে প্রতিদিন চলতে হয়, তাদের জন্য তেমন কোনো সহায়তার ব্যবস্থা ছাড়াই লকডাউন দিলে তারা কি না খেয়ে থাকবেন? পেটে খাবার না দিয়ে মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যায়?
এদিকে গতবছর মানুষের মনে যে ভয় ছিলো করোনা নিয়ে, এবছর পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক খারাপ হলেও মানুষের সেই রকম ভয় নেই বলেই মনে হচ্ছে। যদিও ঢাকা শহরে এখন সম্ভবত এমন একজন মানুষও নেই যার পরিচিত কেউ না কেউ করোনায় আক্রান্ত নন। তবুও অনেকে আগের মতই মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করছেন। চায়ের দোকানে জটলা আছে লকডাউনের মধ্যেই।
দুই.
এর মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পখাত, যে খাত থেকে শতকরা ৮০ শতাংশের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, সেই গার্মেন্টস খাত করোনার প্রাথমিক ধাক্কার মাস দুয়েকের মাথায় সচল হয়েছে। ৪০ লাখের বেশি মানুষ নিয়মিত কাজ করে চলেছেন হাজার চারেক গার্মেন্টস কারখানায়।
অত্যন্ত শ্রমঘন এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো চালু হলে করোনা সংক্রমণের মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে- এরকম ধারণা প্রায় সব বিশেষজ্ঞই গোঁড়ার দিকে করেছিলেন। তাদের সেই কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অন্যান্য খাতের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন, এমন কোনো নজির নেই। বরং হয়তো দেখা যাবে অনেক খাতের চেয়ে এখানে আক্রান্তের হার কম। যদিও এটা কোনো গবেষণা দিয়ে এখনো প্রমাণিত নয়।
এক একটা গার্মেন্টসে হাজার হাজার মানুষ কাজ করেন। সেসব জায়গায় করোনা সংক্রমণ ঠেকিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়। তার ওপরে যেসব এলাকায় গার্মেন্টস কারখানাগুলো অবস্থিত সেখানে একের পর এক কারখানা। সব কারখানা মিলে অসংখ্য মানুষ সেখানে কাজ করেন। তারা এখন পর্যন্ত কোভিডকে ঠেকিয়ে রেখেছেন। এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কীভাবে এই প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, সেটি খতিয়ে দেখার মতো ব্যাপার। সেখান থেকে শিখে জাতীয় স্তরে সেটা প্রয়োগ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। হয়তো লকডাউনের একটি বিকল্পের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে এর মধ্য দিয়ে।
গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে জড়িত পক্ষগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রেতা (ব্রান্ড বা ব্রান্ডের প্রতিনিধি হিসেবে বায়িং হাউস), সাপ্লায়ার বা কারখানা (মালিক, শ্রমিক, ম্যানেজমেন্ট), মালিকদের সংগঠন, শ্রমিকদের সংগঠন, ক্রেতাদের সংগঠন, সরকার ইত্যাদি। এই খাতে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাও কাজ করে। প্রত্যেকটি পক্ষই জানতো, এই কারখানাগুলো কয়েকমাস বসে থাকলে পুনরায় চালু করা সহজ হবে না। মালিক চেয়েছে তার যন্ত্রপাতি ও মূলধনের সুরক্ষা, শ্রমিক ও অন্য কর্মীরা চেয়েছে জীবিকার নিরাপত্তা, ক্রেতারা চেয়েছে সচল সাপ্লাই চেইন, সরকার চেয়েছে রেমিট্যান্সের প্রবাহ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়েছে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনগুলোকে সচল রাখতে।
বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনগুলো ডেসটিনেশন কান্ট্রিগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ইথিওপিয়ার কফি বিন না গেলে ইউরোপের কোম্পানি ইনস্ট্যান্ট কফি বাজারে ছাড়তে পারবে না। ক্যারিবিয়ান দেশগুলো থেকে কলা না আসলে ইউরোপ-আমেরিকার মার্কেটে কলা থাকবে না। বাংলাদেশের মতো সস্তা শ্রমের দেশ থেকে কাপড় না গেলে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে কাপড়ের দাম বেড়ে যাবে। এই যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সেটা সবপক্ষকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে কোভিডের সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে। সবাই মিলে নিশ্চিত করেছে কোভিড সেফটি প্রটোকল বাস্তবায়ন।
গার্মেন্টস কারখানাগুলো প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কমপ্লায়েন্স অডিটের মধ্য দিয়ে যায়। বিজিএমইএ, বাংলাদেশ সরকার, আইএলও, এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের করোনা বিষয়ক সুস্পষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। এছাড়া ক্রেতা ব্রান্ডগুলোর নিজস্ব প্রেসক্রিপশন আছে। সবমিলিয়ে কারখানাগুলোকে কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হচ্ছে।
কারখানার কমপ্লায়েন্স শাখার কর্মীরা করোনার সময়ে অন্য সময়ের চেয়ে আরও বেশি ভূমিকা রাখছেন। গার্মেন্টসের কথা আসলেই মানুষ সাধারণত মালিক আর শ্রমিকের কথা বলে। এর মাঝখানে ম্যানেজমেন্ট লেভেলে (অফিসার, ম্যানেজার ইত্যাদি পদে) এই খাতে প্রায় লাখ খানেক মানুষ কাজ করেন। তাদের কথা সাধারণত অনুচ্চারিতই থাকে। প্রোডাকশন ছাড়াও প্রশাসন, কমপ্লায়েন্স, সেফটি, ফায়ার সেফটি, মেডিকেল ইত্যাদি বিভাগের সেই সব কর্মীরা করোনাকালে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন।
সব কারখানায় একটা সেফটি কমিটি থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন কারখানায় কোভিড টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটি কোভিড নিরাপত্তার ব্যাপারগুলো সমন্বয় করতে ম্যানেজমেন্টকে সহায়তা করে।
প্রত্যেকটা কারখানার সব স্তরের সব কর্মীকে কোভিড থেকে নিরাপদ থাকার উপায় নিয়ে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কখনো কারখানা নিজ উদ্যোগে এই কাজে বিনিয়োগ করেছে, কখনো ক্রেতা বা ব্রান্ড এই কাজে বিনিয়োগ করেছে, কখনো কোনো উন্নয়ন সংস্থা বিনিয়োগটা করেছে। এর জন্যে প্রশিক্ষণ হয়েছে, পোস্টার টানানো হয়েছে, লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে, পিএ সিস্টেমের মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কোভিড সচেতনতামূলক গান ও নাটিকা বারবার বাজানো হয়েছে।
প্রায় সব কারখানায় ফ্লোর ও মেশিন নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। কারখানার প্রবেশ পথে জীবানুমুক্তকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রবেশ পথেই হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও জুতা পলিথিনে ঢুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারখানায় ঢোকার ক্ষেত্রে লেন সিস্টেম করা হয়েছে কোথাও কোথাও। একটা কারখানার কথা জানি, যেখানে ওঠা ও নামার সিঁড়ি আলাদা করা হয়েছে। যাতে ওঠানামার পথে কাউকে ক্রস করতে না হয়।
কোনো কোনো কারখানা দিনে তিন বার পর্যন্ত কর্মীদের শরীরের তাপমাত্রা মনিটরিং করে। তাপমাত্রা বেশি দেখলেই তাকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। আইসোলেশনে রেখে মেডিকেল টিম পর্যবেক্ষণ করছে, প্রয়োজনে হাসপাতালে রেফার করছে। প্রয়োজনে বৈতনিক ছুটি দিচ্ছে এবং ম্যানেজমেন্ট নিয়মিত তার খোঁজখবর রাখছে।
কিছু কারখানায় শিফটিং ডিউটি চালু করা হয়েছে, যাতে একবারে সবাই না ঢোকেন। একটি কারখানায় দুটো বিল্ডিং, দুটিতে শ্রমিকরা আসছেন দুই শিফটে।
এক শিফটের কাজ শেষ ও অন্য শিফটের কাজ শুরুর মাঝে আধাঘণ্টা সময় রেখেছে কোনো কোনো কারখানা। যাতে এক শিফটের কর্মীরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে অন্য শিফটের কর্মীরা কারখানায় ঢোকেন। কর্মীদের ঢোকা ও বের হওয়ার জন্য আলাদা গেইট ব্যাবহার করছে কোনো কোনো কারখানা।
ছোট ছোট উদ্যোগ কীভাবে বড় ভূমিকা রাখতে পারে তার একটি উদাহরণ হচ্ছে অনেক কারখানার ডাইনিং রুমে টেবিল প্রতি চেয়ারের সংখ্যা কমিয়ে একজন থেকে আরেকজনের দূরত্ব নিশ্চিত করা। শুধু তাই না, এক একটি ফ্লোরের কর্মীদের ডাইনিংয়ে আসার সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যাতে ডাইনিংয়ে একসঙ্গে অনেকের ভিড় না হয়।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য ফ্লোরে মার্কিং করা হয়েছে। কোথাও কোথাও ফ্লোরের লেআউট পরিবর্তন করে মেশিনগুলোর অবস্থান জিগজ্যাগ করে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। কোথাও কোথাও ফ্লেক্সিগ্লাস দিয়ে ওয়ার্ক স্টেশনগুলো আলাদা করা হয়েছে।
মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এককভাবে আর কোনো খাতে এরকম সবাই মাস্ক পরছে সেটা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কারখানার পক্ষ থেকে সবাইকে একাধিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য মাস্ক দেওয়া হয়েছে।
প্রত্যেকটি কারখানায় স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা থাকে। অধিকাংশের নিজস্ব ডাক্তার, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। একটি কারখানার কথা জানি যেখানে কোভিডকে মাথায় রেখে আগের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে একটি ১০ শয্যার হাসপাতাল করা হয়েছে। যেখানে আইসিইউ বাদে হাইফ্লো অক্সিজেনের ব্যবস্থাসহ কোভিড রোগীর চিকিৎসার প্রায় সব ব্যবস্থাই রয়েছে। প্রায় সব কারখানায় আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছে।
কিছু কারখানা এই দুর্যোগকালে ডাক্তারের পাশাপাশি নতুন করে সাইকোলোজিস্ট নিয়োগ দিয়েছে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে।
এই খাতে কর্মরত উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত কোভিড বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান পুনর্ব্যবহারযোগ্য মাস্ক, স্যানিটাইজার, সাবান ইত্যাদিও বিতরণ করেছে।
‘খুব জরুরি’ প্রয়োজন ছাড়া অতিথিদের কারখানায় ঢোকা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
শুরুর দিকেই কর্মীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থাও করেছিলো কিছু কারখানা। এক কারখানায় যেমন নিয়মিত খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত একটা করে ডিম দেওয়া শুরু করেছিলো কর্মীদের।
এতক্ষণ যেসব ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, তা প্রায় ৩০টি কারখানার কর্মীদের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে কথা বলে জানা গেছে। কিছু কারখানা সরেজমিনে দেখাও হয়েছে।
কয়েক মাস আগে এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ (ইটিআই) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গার্মেন্টস কর্মীরা করোনাকালে বাসার চেয়ে কর্মস্থলকে বেশি নিরাপদ মনে করেন।
তিন.
এই যে এরকম একটি শ্রমঘন শিল্প এরকম একটি মহামারি কাল অতিক্রম করছে সফলভাবে, এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখে অন্যান্য খাতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।
দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। মার্কেটে ঢোকা ও বের হওয়ার জন্য আলাদা গেইট ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রায় প্রতিটি মার্কেটেই একাধিক গেইট রয়েছে। গেইটে তাপমাত্রা মাপা, হাত স্যানিটাইজ করা, এগুলোতে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। মাস্ক সঠিকভাবে পরা নিশ্চিত করা দরকার। দোকানের কর্মীরা যাতে সার্বক্ষণিক মাস্ক পরে থাকেন এবং মাঝে মাঝেই হাত স্যানিটাইজ করেন সেটা মার্কেট কমিটি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে পারে।
পাঁচ তলা মার্কেটের পাঁচটি ফ্লোরে যদি পাঁচ রকম পণ্য থাকে, নিয়ম করে প্রতিদিন একটি বা দুটি ফ্লোর বন্ধ রাখা যায়। তাতে পুরো মার্কেট সপ্তাহে একদিন বন্ধ রাখার দরকার হবে না। কিন্তু প্রতিদিন কিছু ভিড় কমবে। মার্কেটের সামনে নোটিশ থাকতে পারে, সপ্তাহের কোন দিন কোন ধরনের পণ্যের দোকানগুলো বন্ধ থাকবে।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য মার্কেটের ভেতরের হাঁটার পথে ও দোকানের সামনে মার্কিং করা যায়। একটি দোকানের আকারের ওপর ভিত্তি করে একসঙ্গে কতজন ক্রেতা ঢুকতে পারবে সেটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়। এটা কিন্তু গত বছর আমরা বিভিন্ন দোকানে দেখেছি, লাইনে দাঁড়িয়ে দোকানে ঢুকেছে মানুষ। ভেতর থেকে একজন বের হলে লাইন থেকে একজন ঢুকেছে। ভেতরে সবসময় নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেতা থেকেছে।
মার্কেটের পিএ সিস্টেমগুলোতে প্রতিনিয়ত কোভিডে নিরাপদ থাকতে কী করণীয় তা ঘোষণা করা যেতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে কোভিড সচেতনতার ওপর গান বা নাটিকা তৈরি করেছে সেগুলো সেখানে বাজানো যেতে পারে। মার্কেটে, পথেঘাটে, গণপরিবহণে পর্যাপ্ত সংখ্যক সচেতনতামূলক পোস্টার টানানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
মার্কেটের ফ্লোর ও দোকান প্রতিদিন জীবাণুমুক্ত করা যেতে পারে। প্রতিটি দোকানে ক্রেতাদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। ফুডকোর্টগুলোতে আসন পুনর্বিন্যাস করে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যায়।
গণপরিবহনে ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি পরিবহনে ওঠা ও নামার সময় হাত স্যানিটাইজ করার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে এবং সেটা ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। গণপরিবহনে ওঠার ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
লেখার দরকার ছিলো রাস্তার মোড়ে মোড়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখলে ভালো হয়। কিন্তু যে শহরে পর্যাপ্ত গণশৌচাগারই নেই, সেখানে এটা হয়তো খুব বড় প্রত্যাশা হয়ে যাবে।
তবে যেসব জায়গায় ফুটপাথে দোকান বসে তার কাছাকাছি সরকারি উদ্যোগে হাত ধোয়ার বা হাত স্যানিটাইজ করার ব্যবস্থা করা দরকার।
‘খুব জরুরি প্রয়োজন’ ছাড়া বাসায় কোনো অতিথিকে আসতে না দেওয়া ও নিজে তেমন কোথাও না যাওয়ার ব্যাপারটি চর্চায় আনতে হবে। আসলে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে বের হওয়াই বন্ধ করতে হবে। সামাজিক অনুষ্ঠানাদি আয়োজন স্থগিত রাখতে হবে। জন্মদিন, বৌভাত পরেও করা যাবে।
আর লকডাউন যদি দিতেই হয়, তাহলে সংক্রমণের হার বিবেচনায় নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন দিতে হবে। পুরো দেশ একসঙ্গে লকডাউন দিলে সেটা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হবে, সেটা তো দেখাই গেলো।
এসব উদ্যোগের ক্ষেত্রে সরকারের মনিটরিং গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে স্পটচেক করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
চার.
গার্মেন্টস খাত নিয়ে ভালোমন্দ অনেকরকম কথাই শোনা যায় বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় এই খাত যে সফলতা দেখিয়েছে, তা অভূতপূর্ব। গার্মেন্টস খাতের মানুষ একেবারে আক্রান্ত হয়নি তা নয়, কিন্তু প্রাথমিক আশঙ্কার বিপরীতে সেই সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। গবেষণা দিয়ে প্রমাণিত না হলেও দৃশ্যত মনে হয়, জাতীয় গড়ের চেয়ে সেটা কম।
প্রবল জনঘনত্বের গার্মেন্টস শিল্প যেটা করে দেখিয়েছে, সেটা থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতীয়ভাবে কর্মপন্থা ঠিক করা যেতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, একক ম্যানেজমেন্টের অধীনে একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়ম মানানো যত সহজ, আমাদের রাস্তাঘাটে, বাজারে সেটা কতটা সম্ভব। সেই প্রশ্নের উত্তর মার্কেট কমিটি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে খুঁজতে হবে।
তাপস বড়ুয়া, প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর, এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ (ইটিআই) ; গার্মেন্টস সেক্টরে কোভিড রেসপন্স প্রজেক্টে কাজ করছেন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments