১৩ এপ্রিল ১৯৭১: চারঘাট গণহত্যা ও ঘটনাবহুল একটি দিন
১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ছিল ঘটনাবহুল একটি এদিন। এদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় দালালদের সহযোগিতায় দেশের নানা স্থানে গণহত্যা চালায়।
পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে দেশের বহু জায়গায় সম্মুখ প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। বেশ কয়েকটি শহর দখল করে নেয় পাকিস্তানি হানাদারেরা। ১৩ এপ্রিলের সবচেয়ে নির্মম ও পৈশাচিক ঘটনা ছিল রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় পদ্মা নদীর তীরে। এদিন দুপুরে আট শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়।
পদ্মা নদীর তীরে চারঘাট গণহত্যা
২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তান হানাদারেরা তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল। রাজশাহীতে ইপিআর-এর ৪ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তরের অবস্থান ছিল। এই সেক্টরের অধীনে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৬ নম্বর উইং এবং নওগাঁয় ৭ নম্বর উইংয়ের দপ্তর ছিল। এই সেক্টর সদরে সেক্টর কমান্ডার সাব সেক্টর কমান্ডার থেকে সুবেদার প্রায় সবাই ছিল অবাঙালি। সৈনিকদের মধ্যে যারা বাঙালি ছিল তাদের সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখতো তারা। এদিকে মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে ইপিআরে বাঙালি সৈনিকদের পরিবর্তে অবাঙালি সৈনিকদের নিয়োগ দেয়া হয়। এটি ছিল মূলত কৌশলগতভাবে বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করা। রাজশাহীতে উপশহরের অবাঙালি এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনানিবাস ছিল।
২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফকাত বালুচ। শাফকাত বালুচ হজ করে এসে ঢাকায় পৌঁছালে তাকে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় হেলিকপ্টারে রাজশাহী সেনানিবাসে পৌঁছে দেয়া হয়। এরপর ২৫ মার্চ রাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি দল রাজশাহী শহরে ছড়িয়ে পড়ে এবং সারারাত টহল দেয়।
৭ নম্বর উইংয়ের অধিনায়ক মেজর নাজমুল হক ও সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীও ২৬ মার্চ দুপুরবেলা ইপিআরের সব বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সৈন্যদল রাজশাহীর ডিআইজি মামুন ও এসপি শাহ আবদুল মজিদকে তাদের বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় ২৬ মার্চ। পাকিস্তানি সৈন্যরা এই দুজন পুলিশ অফিসারকে বলে, রাজশাহীর পুলিশের বাঙালি সদস্যদের অস্ত্র সমর্পণ করলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তারা জানান যে, এটা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা বাঙালি পুলিশ সদস্যরা এখন আর অস্ত্র জমা দেবে না। এদিকে এই দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে আটকে রাখার সংবাদে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং সাধারণ জনগণ তাদের নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে পুলিশ বাহিনীকে সাহায্য করে। এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই দুই পুলিশ অফিসারকে নির্মম ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত রাজশাহী উপশহর তথা সেনানিবাস এলাকা ছাড়া বাকি এলাকা মুক্তই ছিল। ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারদের একটি বহর ঢাকা থেকে পাবনার নগরবাড়ি হয়ে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়। সেনারা সারদা পুলিশ একাডেমি ঘিরে ফেলে, জবাবে মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিগুণ হয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরপর উত্তেজিত পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল পুলিশ একাডেমির ভিতর ঢুকে পড়ে। তখন চারপাশ থেকে মর্টারের আঘাত হানছে, আর অন্যদিকে বৃষ্টির মতো মেশিনগানের গুলি চলছে। এসময় সারদা পুলিশ একাডেমির নিকটবর্তী থানাপাড়া, কুঠিপাড়া, মোক্তারপুর, হেদাতিপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের গ্রামবাসীরা পালিয়ে সারদা পুলিশ একাডেমির কাছে পদ্মা নদীর পাড়ে জমায়েত হয়েছিল। উদ্দেশ্য পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করা। কিন্তু পদ্মা নদীর তীরে এসে তারা দেখলেন নদী পারাপারের কোন ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে ততক্ষণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই গ্রামবাসীদের ঘিরে ফেলে। হানাদারেরা নির্দেশ দেয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মুসলমানদের থেকে আলাদা হয়ে সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়াতে। তাদেরকে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমন আশ্বাসের পর সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুরা লাইনে দাঁড়ায়। তারা সরল বিশ্বাসে লাইনে দাঁড়ালে, মুহূর্তের মধ্যেই গর্জে উঠে মেশিনগান। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবাইকে হত্যার পর নদীর পাড়ে উঁচু এক জায়গায় বেশ কয়েকটি মেশিনগান স্থাপন করে সব মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদারেরা। একটানা প্রায় ১৫ মিনিট ক্রমাগত ব্রাশফায়ার চলে। গণহত্যার কোন নিদর্শনই না রাখতে পাকিস্তানি হানাদারেরা নদীতীরে পড়ে থাকা লাশগুলোকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলে ছাই নদীতে ফেলে দেয়। এই গণহত্যা থেকে ভাগ্যক্রমে বাঁচতে পেরেছিলেন মাত্র কয়েকজন। তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সালাম জান্নাতুলসহ কয়েকজন। আবদুস সালাম শরীরে ৩টি গুলি খেয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পরে সাঁতরে অন্য পাড়ে উঠলে চরের গ্রামবাসীরা তাকে পানি থেকে তুলে আনে। সেদিন সারদা পুলিশ একাডেমির দক্ষিণে পদ্মা নদীর পারে সারদা থানাপাড়া ও কুঠিপাড়া এলাকার মানুষদের উপর অনুরূপ কায়দায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। গণহত্যা শেষে পাকিস্তানি হানাদারেরা আশপাশের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেয়।
ঢাকা: ১৩ এপ্রিল ১৯৭১
এদিন ঢাকায় শান্তি কমিটির উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা বলেন, ভারত সরকার অন্যায্যভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। এই বিক্ষোভ মিছিলে ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর, খাজা খয়েরউদ্দিন, গোলাম আজম, সৈয়দ আজিজুল হক, এ এস এম সোলায়মান, পীর মোহসেন উদ্দিনসহ অনেকে।
মার্কিন সিনেটর ফ্রেড হ্যারিস সিনেটে এক বিবৃতিতে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দান অবিলম্বে বন্ধের জন্য সিনেটে প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন ‘পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী কর্তৃক নারকীয় হত্যাকাণ্ডের খবরে আমরা উদ্বিগ্ন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশি সাংবাদিকদের যেভাবে বহিষ্কার ও পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে তাতে বহির্বিশ্ব ও যুক্তরাষ্ট্র জানে না সেখানে আসলে কী হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে নিরীহ নাগরিকদের উপর যে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হচ্ছে না বলে পাকিস্তান সরকার যে দাবি করছে সে দাবির সত্যতা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে রাখা।’
জেলায় জেলায় প্রতিরোধ যুদ্ধ ও গণহত্যা
এদিন সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগান পাকিস্তানি হানাদারেরা অসংখ্য চা শ্রমিককে নারকীয় কায়দায় হত্যা করে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাটে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয় ১৩ এপ্রিল। সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী হানাদারদের একটি নৌযান ডুবিয়ে দেয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তানি হানাদারেরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। অন্যদিকে এদিন নড়াইল শহর দখল করে নেয় পাকিস্তানি হানাদারেরা।
এদিন রাজশাহীর বানেশ্বরে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের অনেকে শহীদ হন। এরপর বানেশ্বর দখল করে পাকিস্তানি হানাদারেরা।
এদিন বিকেলে গঙ্গাসাগর ব্রিজে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার গোলন্দাজ বাহিনী গোলাবর্ষণ করেছিল। জবাবে মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণ গড়ে তুলে হানাদারদের পর্যদুস্ত করে তোলে। এই যুদ্ধে হানাদারদের ৩ জন অফিসারসহ ২০ জনের বেশি সেনা মারা যায়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল শহীদ হন এই যুদ্ধে।
এদিন সকালে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে না পেরে তিস্তা ব্রিজের অবস্থান ছেড়ে দেয়। এরপর তারা পিছু হটে শিঙ্গের ডাবরি, রাজার হাট ও টগরাইহাট বাজারে অবস্থান নিয়েছিল।
১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারেরা বগুড়া শহর দখল করে নিয়ে বদরগঞ্জে ট্যাংক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। হানাদারদের তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা সরে যায়।
১৩ এপ্রিল সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি, কন্ট্রোল রুম ও ঠাকুরগাঁও মহকুমার বিভিন্ন স্থানে ২০টি প্রতিরক্ষা ক্যাম্প গড়ে তুলে সীমান্তে অবস্থান করে। সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা ঠাকুরগাঁও শহর ছেড়ে চলে যায়।
হানাদারেরা এদিন ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে না এসে খানসামার পথ ধরে পেছন থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী হানাদারেরা একটি নদী পার হতে থাকলে পেছন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালায়। হানাদারদের বালুচ ডি কোম্পানি অবস্থা বেগতিক দেখে সরে যায়।
১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারেরা টাঙ্গাইল দখলের পর ময়মনসিংহ শহর দখলের লক্ষ্যে এগিয়ে এলে মধুপুরগড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এইসময় দুপক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলিতে পাকিস্তানু হানাদার বাহিনীর দুজন ড্রাইভার ঘটনাস্থলে মারা যায়। তবে মুক্তিবাহিনীর হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র (ত্রয়োদশ খণ্ড)
দৈনিক পাকিস্তান, ১৪ এপ্রিল ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২, ৭ এবং ৮ নং সেক্টর।
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
আরও পড়ুন-
১২ এপ্রিল ১৯৭১: বালারখাইল গণহত্যা ও ঘটনাবহুল একটি দিন
১১ এপ্রিল, ১৯৭১: দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান তাজউদ্দীন আহমদের
১০ এপ্রিল: মুজিবনগর সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস
Comments