পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন: প্রচারে, স্লোগানে বাংলাদেশ

ছবি: সংগৃহীত

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এবারকার বিধানসভা নির্বাচনে নির্বাচনের প্রচার, স্লোগান, ইস্যু কিংবা অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ সবকিছুতেই চলে এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।

বাংলাদেশের সঙ্গে ২,২১৬ দশমিক ৭০ কিলোমিটার সীমান্ত ভাগ করা পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়া, মানুষ, পোশাক, সংস্কৃতি, ভাষা সবই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মানুষে মানুষে রক্তের ও আত্মার বন্ধন।

ফলশ্রুতিতে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ওঠে আসা স্বাভাবিক হলেও এই প্রথম বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী দেশের বিধানসভা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ নেতিবাচকভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে এবং হচ্ছে।

ছবি: ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে আদর্শিক রাজনীতির পরিবর্তে এবার পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে পরিচয় সত্তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে এভাবে নেতিবাচক প্রচারণা হচ্ছে।

প্রথমেই আসা যাক একটা স্লোগান নিয়ে।

প্রত্যেকবার পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের আগে বিভিন্ন স্লোগান তৈরি হয়। কিন্তু, এবার নির্বাচনে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে একটা স্লোগান ‘খেলা হবে’।

পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের সব পর্যায়ের নেতাদের মুখে এমনকি দেয়াল লিখনে সর্বত্র ব্যবহৃত হচ্ছে এই স্লোগান।

‘খেলা হবে’ স্লোগানটা আসলে প্রথমে বলেছিলেন নারায়ণগঞ্জের ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। ২০১৩-১৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের সময় শামীম ওসমান এক জনসভায় বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আস খেলব, খেলা হবে।’

পরে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এই স্লোগানটি ব্যবহার করেন তার বক্তব্যে। পরে স্লোগানটি তৃণমূলের ভোটের ‘থিমলাইন’ হয়ে গেছে।

এই স্লোগানের বিপরীতে ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্ব, এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকেও তার কাউন্টার দিতে দেখা গেছে।

এই স্লোগানের বিপরীতে বিজেপির কাউন্টার, ‘দিদি বলছেন খেলা হবে। আমরা বলছি, শিক্ষা হবে, স্বাস্থ্য হবে, বিকাশ হবে, উন্নয়ন হবে, হাসপাতাল হবে।’

ইস্যুভিত্তিক আলোচনাতেও বাংলাদেশ। এবার বিধানসভা ভোটে বড় ইস্যু বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ।

ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি বাংলাদেশ থেকে মুসলিম অনুপ্রবেশকে নির্বাচনের বড় ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেছে এবারের ভোটে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলাদেশের মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও নির্বাচনী প্রচারণায় তুলে ধরা হয়েছে বারবার।

ফেব্রুয়ারিতে বনগাঁর এক জনসভায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা অমিত শাহ ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে সীমান্ত দিয়ে কোনো মানুষ দূরে থাক- একটা পাখিও ঢুকতে পারবে না।’

তবে ১০ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে দেওয়া পার্লামেন্টে এক প্রশ্নের উত্তরে দেখা গেছে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা কমেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লিখিত উত্তরে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে সীমান্তে অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে আটক করা হয়েছিল ১,৬০১ জনকে, ২০১৮ সালে ৮৮৪ জন এবং ২০২০ সালে সেই সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে ৯৫৫ জনে।

বিজেপির অনুপ্রবেশের কাউন্টার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে দিলেও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় ৩ এপ্রিল এক জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘অন্য সময় বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুপ্রবেশকারী নিয়ে আসছেন। আর নির্বাচনের সময় (নিজে) ভোট চাইতে গিয়েছেন। গুণ্ডা আনতে গিয়েছেন।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে জনপ্রিয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ নিয়ে মুখোমুখি হয়েছে তৃণমূল ও বিজেপি।

২৩ জানুয়ারি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিবস পালন অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ঘোষণার পরেই ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান ওঠে। ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান বিজেপি রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে।

এই স্লোগানের প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী পাল্টা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বক্তব্য না দিয়েই মঞ্চ ত্যাগ করেন, যে মঞ্চে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীও।

তার পরপরই রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ তার ফেসবুকে লেখেন, ‘মাননীয় (মমতা) লড়ছেন গ্রেটার বাংলাদেশের লক্ষ্যে।’ ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশের অভিনেতা ফেরদৌসের তৃণমূলের হয়ে প্রচারের এবং বাংলাদেশি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের কালীপূজা উদ্বোধনের ছবিও শেয়ার করেন।

শুধু এখানেই থেমে থাকেননি দিলীপ ঘোষ। জানুয়ারিতে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি অভিযোগ করেন, রাজ্যে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের ভোটার লিস্টে রাখা হয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ২৬-২৭ মার্চ বাংলাদেশ সফরকে ঘিরেও উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছিল পশ্চিমবঙ্গে।

সফরের দ্বিতীয় দিন মোদি গোপালগঞ্জে মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান ওড়াকান্দির মন্দির পরিদর্শন করেন।

মোদির এই সফরে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ হয়েছে বলে অভিযোগ আনেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন কি, প্রধানমন্ত্রীর ভিসা বাতিলের দাবিও তোলেন তিনি।

পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুরে এক সভায় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি নির্বাচনী বিধি ভেঙে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মন্দিরে গেলেন। সেখানে মতুয়াদের সমর্থন আদায়ের জন্য আশীর্বাদ নিলেন। এবার কেন মোদির ভিসা বাতিল করা হবে না?’

সাড়ে তিন কোটি মতুয়া অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ ভোটে মতুয়ারা একটি ডিসাইডিং ফ্যাক্টর। ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে সরাসরি ৩০ সিটে মতুয়ারা জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে এবং আরও ৬৩ সিটে তাদের প্রভাব রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আবার ওঠে আসে মার্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারের সময়।

৭ মার্চ উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে এক নির্বাচনি সমাবেশে তিনি বলেন, ‘তিস্তা নিয়ে কোনও আপস হবে না। বাংলা ও উত্তরবঙ্গের মানুষের হিস্যা তিস্তা। আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি, পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার পানি যথেষ্ট পরিমাণে থাকলে তবেই আমরা ভাগাভাগিতে রাজি হবো।’

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তিতে প্রায় ১১ বছর ধরে আটকে আছে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রতিশ্রুত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি।

অতি সম্প্রতি, বিজেপির নির্বাচনি প্রচারে তৈরি একটা গানে আবার চলে এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।

‘দিদি তুমি আমাদের ভালোবাস না’ শিরোনামে ৪ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডের ভিডিওর শুরুতে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সিরাজগঞ্জে ধর্ষিতা পূর্ণিমার কথা বর্ণনা করা হয়েছে।

পূর্ণিমাকে নিয়ে সেই সময়কার ছাপানো ছবি ও সংবাদ দেখানো হয়েছে গানের বড় অংশ জুড়ে।

ভিডিওতে এখানকার টিভি ফুটেজ ও সংবাদপত্রের কাটিং ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে মৌলবাদীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ছবি, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে হামলা সংক্রান্ত সংবাদ। তুলে আনা হয়েছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে আরব গেরিলাদের প্রসঙ্গ- যেখানে ব্যবহার করা হয়েছে ইসলামিক স্টেটের পতাকার ছবি।

ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচারের প্রসঙ্গও ওঠে এসেছে সেই গানে।

ভিডিওতে গানের শুরুতে আছেন ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গায়ক বাবুল সুপ্রিয়, যিনি কলকাতার টালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে এবারের ভোটে লড়ছেন।

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে এবার নির্বাচনে আদর্শিক রাজনীতির চাইতে পরিচয়সত্তার রাজনীতি বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কারণে বাংলাদেশ ও এর নেতিবাচক দিক বেশি চলে আসছে।’

তিনি মনে করেন, তৃণমূল ও বিজেপি দুই দলই আদর্শ থেকে সরে এসেছে। আদর্শ থেকে সরে এসে আইডেনটিটি-ভিত্তিক রাজনীতি করলে সেখানে নেতিবাচক প্রচারণা হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান এ বিষয়ে ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিজেপি এবার যেকোনভাবেই পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করতে চায়। সে কারণে এই পার্টি এমন ইস্যু নিয়ে আসছে যাতে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ভোটারদের মধ্যে তারা সাড়া ফেলতে পারে।’

বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনের ইস্যু, কিংবা বাংলাদেশে মতুয়া মন্দির সফর সবই নরেন্দ্র মোদি করছেন হিন্দু ভোটারদের মন জয় করতে এবং খুব সূক্ষ্মভাবে এই ইস্যুগুলোকে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য: চিফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Air purifiers for Dhaka: hope or hype?

DNCC to set up 25-30 such industrial devices in public places to curb pollution; experts skeptical

12h ago