দেশে মোট রসুনের অর্ধেক উৎপাদন নাটোর ও পাবনায়, দাম নিয়ে হতাশ চাষিরা
বাঙালির রান্নার অন্যতম প্রধান মসলা রসুন আবাদে চলনবিলের দুই জেলা পাবনা ও নাটোরের রসুন চাষিরা দেশের মধ্যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এ বছর দেশের মোট উৎপাদিত রসুনের অর্ধেকই উৎপাদিত হয়েছে নাটোর ও পাবনা জেলার চলনবিল অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। তবে, কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় রসুন উৎপাদন করেও উৎপাদন খরচ তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন চাষিরা।
তবে, চাষিরা কাঙ্ক্ষিত দাম না পেলেও খুচরা বাজারে আগের চড়া দামেই রসুন কিনছেন সাধারণ ক্রেতারা। পাইকারি বাজার ও খুচরা বাজারে দামের পার্থক্যের জন্য কৃষকরা অবশ্য অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করছেন।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) অতিরিক্ত উপপরিচালক ড. শামিম আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ বছর দেশে ৮৬ হাজার ৪৯৯ হেক্টর জমিতে রসুনের আবাদ হয়েছে। আবাদকৃত জমি থেকে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় সাত দশমিক ২৪ লাখ মেট্রিকটন রসুন।’
তিনি জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর রসুন আবাদের জমি কিছুটা কমলেও আবহাওয়া ভাল থাকায় উৎপাদন বাম্পার হয়েছে। দেশের উৎপাদিত মোট রসুনের প্রায় অর্ধেকই উৎপাদিত হয়েছে নাটোর ও পাবনা জেলায়।
নাটোর ও পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নাটোর জেলায় এ বছর ২৫ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে রসুন আবাদ করে উৎপাদন হয়েছে প্রায় দুই দশমিক ৩৮ লাখ মেট্রিকটন রসুন আর পাবনা জেলায় ১৩ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে রসুন আবাদ করে উৎপাদন হয়েছে প্রায় এক দশমিক ২৭ লাখ মেট্রিকটন রসুন।
কৃষি বিভাগ জানায়, দেশের মোট উৎপাদিত সাত দশমিক ২৪ লাখ মেট্রিকটন রসুনের প্রায় তিন দশমিক ৬৫ লাখ মেট্রিকটন রসুন আবাদ হয়েছে নাটোর ও পাবনা জেলার চলনবিল অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক সুব্রত কুমার সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চলনবিলের কৃষকরা বর্ষার সময় আমন ধান আবাদ করে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর কাদামাটিতে বিনা চাষে রসুনের কোয়া বপন করে আমনের খড় দিয়ে ঢেকে দেয়। এতে করে রসুন আবাদের খরচ কম হয় পাশাপাশি বন্যা পরবর্তী পলিমাটিতে উর্বরতার জন্য রসুনের উৎপাদন বেশি হয়।’
‘লাভজনক হওয়ায় গত কয়েক বছরে চলনবিলের এ অঞ্চলের কৃষকরা রসুনের আবাদের দিকে ঝুঁকছে। ফলে দেশির বেশিরভাগ রসুন এ অঞ্চল থেকেই উৎপাদিত হয়,’ বলেন তিনি।
সরেজমিনে চলনবিল অঞ্চলের রসুন আবাদের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চলনবিলের পাইকারি বাজারে ভাল মানের এক মণ রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ থেকে ১৭০০ টাকায়। আর অপেক্ষাকৃত কম মানসম্মত রসুন বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরে। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
চলনবিলের চাটমোহর উপজেলার করকোলা গ্রামের রসুন চাষি বাচ্চু আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত বছর ভাল মানের এক মণ রসুন বিক্রি হয়েছে ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা দরে। আর এক মণ কম গুণগত মানসম্পন্ন রসুন বিক্রি হয়েছে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা দরে। গত বছর রসুন আবাদ করে লাভবান হওয়ায় এ বছর প্রায় পাঁচ বিঘা জমিতে অধিক খরচ করে রসুনের আবাদ করে এখন উৎপাদন খরচ তুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
বাচ্চু বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে রসুন আবাদ করতে এ বছর খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আর উৎপাদিত রসুন বাজারে বিক্রি করে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার টাকার বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন খরচ তুলে কৃষকরা লাভবান হতে পারছে না। এক বিঘা জমি থেকে ২৫ থেকে ২৮ মণ রসুন পাওয়া যায় যার ৭৫ শতাংশ ভাল মানের রসুন। আর ২৫ শতাংশ কম মানসম্মত রসুন উৎপাদিত হয়। ফলে গড়ে রসুন বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে না কৃষকরা।’
চলনবিলের রসুনের বড় পাইকারি হাট ছাইকোলা হাটের রসুনের পাইকারি ব্যবসায়ী সোহরাব আলি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পাইকারি বাজারে রসুনের আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এবং বাজারে পর্যাপ্ত রসুনের সরবরাহ থাকায় এ বছর রসুনের পাইকারি বাজার দর অনেক কম।’
চলনবিলে উৎপাদিত রসুন দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হলেও বর্তমানে প্রতিটি বাজারেই দেশি ও আমদানিকৃত রসুনের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকায় দাম বাড়ছে না বলে জানান তিনি। তবে আগামী দুই তিন মাসের মধ্যে রসুনের দাম বাড়বে বলে আশা করেন সোহরাব।
এদিকে, পাইকারি বাজারে রসুনের দাম কম থাকলেও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে এখনো প্রায় আগের মতোই ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে রসুন বিক্রি করছে খুচরা বিক্রেতারা।
পাবনা শহরের আব্দুল হামিদ রোডের সবচেয়ে খুচরা ব্যবসায়ী মো. নান্নু দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য কিনে তারা বিক্রি করতে পারছেন না। কৃষকদের কাছ থেকে পাইকাররা রসুন কিনে শহরের বাজারের পাইকারদের কাছে বিক্রি করে।
‘আমরা তাদের কাছ থেকে কিনে খুচরা বিক্রি করি। কয়েক দফায় হাত বদল হওয়ায় পণ্যের পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় খুচরা বাজারের সঙ্গে মাঠের দামের তারতম্য হয়,’ বলেন তিনি।
পাইকারি বাজার ও খুচরা বাজারে দামের পার্থক্যের জন্য কৃষকরা অবশ্য অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনাকেই দোষারোপ করেছে।
পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার সঞ্জয়পুর গ্রামের রসুন চাষি রওশন মোল্লা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থাপনায় কৃষকের কোনো ভূমিকা না থাকায় কৃষকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত পণ্যের মূল্য পাচ্ছে না। এছাড়া কৃষকের ঘরে কৃষি পণ্য মজুতের সুযোগ না থাকায় এবং সরকারিভাবে কোনো সংরক্ষণাগার গড়ে না ওঠায় এ অঞ্চলের রসুন চাষিরা পাইকারদের হাতে জিম্মি হয়ে আছেন।’
কৃষকদের স্বার্থে চলনবিল অঞ্চলে সরকারিভাবে কৃষি পণ্যের সংরক্ষণাগার গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে কৃষকরা রসুন সংরক্ষণ করে কাঙ্ক্ষিত দাম পেলে ভালো দামে বিক্রি করার সুযোগ হবে।’
Comments