১৬ এপ্রিল ১৯৭১: প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার শপথের অপেক্ষা, ঢাকায় কারফিউ শিথিল
১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। পরদিন ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তাই এদিন নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় কাটান প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তবে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ গোপন।
কারণ এর আগে একবার শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আওয়ামী লীগের সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আসহাবুল হক এমপি শপথ অনুষ্ঠানসহ চুয়াডাঙ্গাকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ঘোষণার তথ্য দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশ করে দেন। এরপরই বিমান হামলা করে চুয়াডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তান সরকার। ওই দিনই মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে শপথ অনুষ্ঠানের নতুন সিদ্ধান্ত হয়।
১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম কলকাতা প্রেসক্লাবে গিয়ে সাংবাদিকদের জানান, পরের দিন বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটা অনুষ্ঠান আছে। যারা অনুষ্ঠানে যেতে চান, তাদের অবশ্যই আগামীকাল ভোরের মধ্যে প্রেসক্লাবে উপস্থিত থাকতে হবে। সেখান থেকে বাংলাদেশ সরকার সবাইকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে।
১৬ এপ্রিল বিদেশি সংবাদপত্রে মুক্তিযুদ্ধ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিবৃতি
১৬ এপ্রিল ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র একটি প্রতিবাদপত্রে বলেন, ‘পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে যে পৈশাচিক হত্যালীলা চালাচ্ছে, তা থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণায় নেমেছে।’ প্রতিবাদপত্র পাঠের পর তিনি তা উপস্থিত বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেন।
এ দিনই কলকাতায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারা শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিচারপতি শঙ্কর প্রসাদ মিত্র ও বিচারপতি এস এ মাসুদসহ বিশিষ্টজনরা এক আবেদনে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি অবিলম্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গণহত্যা বন্ধের আহবান জানান।
এছাড়া বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে ভারতের এক্সপ্লোরার ক্লাব ১৬ এপ্রিল এক গণস্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে পেশ করার জন্য প্রস্তাবিত এই দাবিনামায় স্বাক্ষর অভিযানের উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী যামিনী রায়।
এদিন কলকাতায় সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির স্টিয়ারিং কমিটির এক সভায় পাকিস্তানকে জাতিসংঘ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস এন সেন। সভায় প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মাওলানা আজাদ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার মিশনের মুসলিম নেতারা ১৬ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গ মোতাওয়াল্লি সম্মেলনে বাংলাদেশে ধর্মস্থান ও মসজিদের ওপর বোমাবর্ষণের প্রতিবাদ জানান। সেই সঙ্গে ভারতের ক্ষুদ্রশিল্প ফেডারেশন বাংলাদেশ তহবিলে সাহায্য দিতে পশ্চিমবঙ্গের সব ক্ষুদ্র শিল্পপতিদের আহবান জানায়। এদিন একই সঙ্গে কলকাতার শিখ ধর্মাবলম্বীরাও পাকিস্তানি নৃশংসতার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
এ দিনেই বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে প্রবেশ করে।
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এদিন বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ক্রমেই চূড়ান্ত অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিংশ শতকে এটি একটি বিরল ধরনের মুক্তি আন্দোলন। এ আন্দোলনে মানুষের সমর্থন অকুণ্ঠ। তবে অস্ত্রশস্ত্রের অভাব প্রকট হলেও বেশ কয়েকটি ছোট শহরে মুক্তিযোদ্ধারা এখনও প্রশাসন চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিন কলকাতার নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় ‘যদি রক্ত হয়ে থাকে মানুষের স্বাধীনতার অধিকারের মূল্য, তবে বাংলাদেশ তা অতিরিক্তই দিয়ে ফেলেছে। আর যদি তাদের আন্দোলন কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ধ্বংস হয়েও যায়, তবে তা মুক্তিযুদ্ধের সাময়িক পরাজয় মাত্র। যা শেষ পর্যন্ত বাঙালির রাষ্ট্রসত্ত্বা হিসেবে স্বীকৃত হবে।’
ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ
এদিন খাজা খয়ের উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে পাকিস্তানের পক্ষে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হয়। সন্ধ্যায় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিনের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির নেতারা গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে জানান, শত্রু নিধনে তারা সেনাবাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা করবেন। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা হলেন খাজা খয়েরুদ্দিন আহবায়ক, সদস্য– নুরুল আমিন, এ. কিউ. এম শফিকুল ইসলাম, গোলাম আজম, মাহমুদ আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর, মাওলানা সিদ্দিক আহমদ, আবুল কাশেম, ইউসুফ আলী চৌধুরী, মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম, আবদুল মতিন, অধ্যাপক গোলাম সরোয়ার, ব্যারিস্টার আফতাব উদ্দিন আহম্মেদ, পীর মোহসেন উদ্দিন, এ এস এম সোলায়মান, এ কে রফিকুল হোসেন, মওলানা নুরুজ্জামান, আতাউল হক খান, তোয়াহা বিন হাবিব, মেজর (অব.) আফসার উদ্দিন, দেওয়ান ওয়ারেসাত আলী ও হাকিম ইরতাজুর রহমান খান।
সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকায় কারফিউয়ের মেয়াদ ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শিথিল করে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবিলম্বে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
ঢাকার বাইরের যুদ্ধ
এদিন চুয়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলায় মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর সরিয়ে ভৈরব নদের অপর পাড়ে ইছাখালী বিওপিতে স্থানান্তর করা হয়। ঈশ্বরদী থেকে ভেড়ামারার দিকে আসার সময় পাকিস্তানি হানাদারেরা পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে জমায়েত হতে থাকে। পাকিস্তানি হানাদারেরা মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পশ্চিম মাথার ইপিআর ক্যাম্প দখল করে নেয়। ভেড়ামারার বাসিন্দারা যখন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যাচ্ছে তখন পাকিস্তানি হানাদারেরা পাকশী যুদ্ধ শেষে পদ্মা নদী পাড় হয়ে ভেড়ামারায় অবস্থান নিচ্ছিল। ১৬ এপ্রিল ভোরে অসংখ্য সেনা চিরুনী অভিযান চালায় ভেড়ামারা ও কুষ্টিয়া অভিমুখে। এসময় ভেড়ামারার চণ্ডীপুরের পণ্ডিত পরিবারের ২০ জনের বেশি সদস্য পাকিস্তানি হানাদারদের অবস্থান জেনে পার্শ্ববর্তী চন্দনা নদী পাড় হয়ে হিড়িমদিয়ার দিকে রওয়ানা হতে চেষ্টা করে। কিন্তু চন্দনা নদী পাড় হওয়ার আগেই পণ্ডিত পরিবারের মেয়ে ও স্থানীয় মীর জালালের স্ত্রী সাজেদা বেগমের হঠাৎ প্রসব বেদনা উঠে। তখন তারা চন্দনা নদীর পার্শ্ববর্তী অনিল সরকারের বাড়ির পশ্চিম পাশে একটি ঝোপে অবস্থান নেয়। এদিকে পাকিস্তানি হানাদারেরা আসছে কিনা তা সাইকেলে করে দেখতে গেলে মীর আবুল হোসেনের ছেলে আখতারুজ্জামান বাবলুকে দেখে তার পিছুপিছু চলে আসে হানাদারেরা। এসময় সেই ঝোপের কাছে এসে অতর্কিত ব্রাশফায়ার শুরু করে পাকিস্তানি হানাদারেরা। ব্রাশফায়ারে সন্তানসম্ভবা সাজেদা বেগমের পেটে গুলি লাগলে তার গর্ভপাত হয়ে যায়। গর্ভপাতে তার পেটে থাকা নবজাতক নিহত হয়। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের পরও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সাজেদা বেগম। এসময় পণ্ডিত পরিবারের ১৪ জন সদস্য ঘটনাস্থলেই পাকিস্তানি হানাদারদের ব্রাশফায়ারে শহীদ হন। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদারেরা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়।
১৬ এপ্রিল সকালে চট্টগ্রামের কুমিরায় যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে সীতাকুণ্ড ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে এসে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করেছিলেন। হানাদারেরা মিরসরাই যুদ্ধ শেষে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত এগিয়ে এসে গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। একই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী সমুদ্র উপকুল থেকে নৌবাহিনীর কামান থেকে গোলাবর্ষণ করে। জবাবে মুক্তিবাহিনীও পাল্টা আঘাত হানে।
এদিন পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পঞ্চগড়ের ভবানীপুরের হাওয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে আট জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও বেশ কয়েকজন আহত হন। পঞ্চগড় দখলের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর দিনাজপুরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এই দিন পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে চলে যায়। এদিন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার দখলও তারা নিয়ে নেয়।
ময়মনসিংহের দখল নিয়েও হানাদারেরা নির্বিচার গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করেছিলো এই দিনে।
১৬ এপ্রিল কুমিল্লার গঙ্গাসাগর সেতুতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে প্রবল যুদ্ধ হয়। কুমিল্লার ত্রিপুরা সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদারদের হামলা প্রতিহত করে। এদিকে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও হানাদার ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একই সঙ্গে কসবা সীমান্তেও পুরো দিন থেমে থেমে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদারদের মধ্যে যুদ্ধ চলে।
এদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির খাগড়া রেস্ট হাউসেও পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ চালালে হানাদারদের বেশ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয়। একই সঙ্গে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র পুনর্দখল নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে দিনভর সংঘর্ষ চলে।
তথ্যসূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ত্রয়োদশ খণ্ড।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১, ২, ৭, ৮ এবং ১১
গার্ডিয়ান পত্রিকা, ১৬ এপ্রিল ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
আরও পড়ুন:
১৫ এপ্রিল ১৯৭১: নিভৃতে কেটেছে বাংলা নববর্ষ, ভয়ে-আতঙ্কে ঢাকা ছাড়ে মানুষ
১৩ এপ্রিল ১৯৭১: চারঘাট গণহত্যা ও ঘটনাবহুল একটি দিন
১২ এপ্রিল ১৯৭১: বালারখাইল গণহত্যা ও ঘটনাবহুল একটি দিন
১১ এপ্রিল, ১৯৭১: দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান তাজউদ্দীন আহমদের
১০ এপ্রিল: মুজিবনগর সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস
Comments