নিত্যপণ্যের দামের চাপে দিশেহারা মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষ

ছবি: ফাইল ফটো

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকার ঘোষিত ‘সর্বাত্মক’ লকডাউনে চলাচল নিষেধাজ্ঞার কারণে দ্রুত বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। আর এই ঊর্ধ্বমূল্যে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষদের।

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ও লকডাউন দেশের অর্থনীতির ওপর যেভাবে চাপ ফেলছে, তা যেন গত বছরের দুঃসময়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওই সময় কিছু প্রতিষ্ঠান একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। অনেকগুলো আবার টিকে থাকতে কর্মী ছাঁটাই বা বেতন কমিয়ে দেওয়ার মতো ব্যবস্থাও গ্রহণ করে।

একটি প্যাকেজিং কোম্পানির হিসাবরক্ষক কফিলউদ্দিন আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত বছরের লকডাউনে আমার বেতন ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কেটে রাখা হয়েছিল। যখন আমাদের কোম্পানি একটু ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করল, ঠিক তখনই আবার নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো। আমি সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছি না। কিন্তু, পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের অবশ্যই কিছু করতে হবে। আমাদের দুই দিক থেকেই চাপে পড়তে হচ্ছে। এভাবে আমরা টিকে থাকতে পারব না।’

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে গত সপ্তাহে ‘বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কীভাবে মহামারির বিপর্যয় মোকাবিলা করছে’ শীর্ষক এক গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, যেসব পরিবার আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, তাদের মধ্যে ৭৮ দশমিক পাঁচ শতাংশই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। এ ছাড়া, ৮০ দশমিক ছয় শতাংশ পরিবারকে খাবারের খরচ কমিয়ে আনতে হয়েছে।

রাজধানীর শ্যামবাজারের একটি কাঁচাবাজারে কফিলউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা হয় এই প্রতিবেদকের। চলাচলে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও কম খরচে সবজি কেনার আশায় তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, বংশালে একটি দুই রুমের বাসায় স্ত্রী, মা ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন। মাস শেষে বেতন পান ৩৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১২ হাজার টাকাই চলে যায় বাড়িভাড়ায়। সঙ্গে দিতে হয় আরও সাড়ে তিন হাজার টাকার আনুষঙ্গিক খরচ।

এ ছাড়া, মাসে দুই হাজার টাকা ডিপোজিট স্কিম জমা দেন তিনি। পাশাপাশি বৃদ্ধ মায়ের জন্য দুই হাজার টাকার ওষুধ আর বাচ্চাদের খাবার ও যাতায়াত বাবদ মাসে তিন হাজার টাকা খরচ হয় বলেও জানিয়েছেন তিনি।

কফিলউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিশেষ কোনো উপলক্ষ ছাড়া আমাদের প্রতিদিনের খাবারের আয়োজনে বেশিরভাগ সময়ই ভাত, ডাল, সবজি, ডিম, মাছ বা মুরগি থাকে। একদিনের খাবারের পেছনে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু, সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার পর আমি ওষুধ, যাতায়াত ও বাচ্চাদের খাবারের খরচ কমিয়ে এনেছি। গত বছর বেতন কমিয়ে দেওয়ার পর আমাকে ঋণ করতে হয়েছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘টাকা জমানোও বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। আমার বাচ্চারা এখনো ছোট। কিন্তু, আগামী বছর থেকে তাদের স্কুলে পাঠাতে হবে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে গড় মূল্যস্ফীতি পাঁচ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ থাকলেও মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক ৪৭ শতাংশে। এ ছাড়া, খাদ্য মূল্যস্ফীতি জানুয়ারির তুলনায় শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ থেকে বেড়ে মার্চে পাঁচ দশমিক ৫১ শতাংশে পৌঁছায়।

গত সোমবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তর তেল, চিনি ও খেজুরসহ বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয়।

তবে খুচরা দোকানগুলোতে এক কেজি শসা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। শ্যামবাজার পাইকারি বাজারে গত শুক্রবার শসার কেজি ছিল ৬০ টাকা। অথচ এক সপ্তাহ আগেও পাইকারি বাজারে ২৫ টাকা ও খুচরা বাজারে ৪০ টাকা কেজি দরে শসা বিক্রি হচ্ছিল।

পাইকারি বিক্রেতা মজিবর রহমান ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, সাধারণত শুক্রবারে ক্রেতার ভিড় বেশি থাকে। তবে, চলমান নিষেধাজ্ঞার কারণে খুচরা বিক্রেতারা গত বৃহস্পতিবারই প্রচুর পরিমাণে সবজি কিনে রাখেন। ফলে সবজির চাহিদা ও দাম- দুটোই বেড়ে যায়। নাম গোপন রাখার শর্তে এক পাইকারি বিক্রেতা ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, তাকে বিভিন্ন চেকপয়েন্টে পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়েছে। এজন্য পণ্যপরিবহন খরচ বেড়ে গেছে।

যাতায়াতের জন্য লকডাউনের একদিন আগে পুলিশ ‘মুভমেন্ট পাস’ ব্যবহারের ব্যবস্থা নেয়। মন্ত্রিপরিষদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, খামারে উৎপাদিত পণ্য, খাদ্য ও খাদ্যশস্য পরিবহনে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। কিন্তু, খাদ্য বহনকারী ট্রাকগুলোকেও পুলিশ হয়রানি করেছে জানিয়ে ওই পাইকারি বিক্রেতা বলেন, ‘আমরা সবাই জানি খাদ্য পরিবহনকারী ট্রাক নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই। পুলিশকে এই কথা বলার পর তারা আমাদের বাক্সগুলো খুলে দেখাতে বলে এবং আমরা নিষিদ্ধ পণ্য পরিবহন করছি বলে দাবি করে। হয়রানি এড়াতে তাদের টাকা দিতে হয়েছে।’

সব মিলিয়ে পাঁচটি চেকপয়েন্টে পুলিশকে টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের এক ফল বিক্রেতাও একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন।

এক সপ্তাহের মধ্যেই বেগুন, কচু, করলা, ঢেঁড়স, বরবটি ও পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের দাম কেজিতে পাঁচ থেকে ৬০ টাকা বা তারও বেশি পর্যন্ত বেড়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh races to expand air cargo capacity

In a first move to address the shortfall, Sylhet's Osmani International Airport is set to launch dedicated cargo operations today

10h ago