পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বাংলাদেশ কেন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন চলছে। ১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার যতগুলো ভোট হয়েছে, তার সবগুলোর সঙ্গে তুলনা করেও এবারের ভোটকে বিশেষ ব্যতিক্রমী বলা যায়। স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা কিংবা বিধানসভা, কোনো নির্বাচনেই এবারের মতো রাজনৈতিক ইস্যুর বদলে ধর্ম, জাত, ভাষা, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক— এ বিষয়গুলো প্রধান হয়ে উঠেনি।
নির্বাচনকালে পশ্চিমবঙ্গের একটি দেয়ালে বাংলাদেশি স্লোগান। ছবি: সংগৃহীত

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন চলছে। ১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার যতগুলো ভোট হয়েছে, তার সবগুলোর সঙ্গে তুলনা করেও এবারের ভোটকে বিশেষ ব্যতিক্রমী বলা যায়। স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা কিংবা বিধানসভা, কোনো নির্বাচনেই এবারের মতো রাজনৈতিক ইস্যুর বদলে ধর্ম, জাত, ভাষা, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক— এ বিষয়গুলো প্রধান হয়ে উঠেনি।

দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে বিজেপি হিন্দুত্ববাদকে গোটা ভারতজুড়েই কার্যত সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদে পরিণত করেছে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদ বজায় রাখতে গেলে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের বিজেপিকে ভারতের পূর্বাঞ্চলে মেরুকরণের রাজনীতিকে প্রবল করে, মুসলিম বিদ্বেষ আর বাংলাদেশ বিদ্বেষকে একপর্যায়ে নামিয়ে আনা ছাড়া বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সম্পর্কে অসত্য কথা বলে, বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার নাগরিকেরা খেতে না পেয়ে ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে চলে আসছে, আর এভাবেই পশ্চিমবঙ্গে অচিরেই হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে— এই প্ররোচনার রাজনীতির ভেতর দিয়ে এখন বিজেপি নির্বাচনে জিততে চাইছে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে অসত্য প্রচার করে বিজেপি যে পশ্চিমবঙ্গ দখল করতে চায়, এই ইঙ্গিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেই তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা থেকে পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল। অটল বিহারি বাজপেয়ীর আমলে মুরলী মনোহর যোশী, এল কে আদভানি, ভেঙ্কাইয়া নাইডু প্রমুখের নেতৃত্বাধীন বিজেপির সঙ্গে মমতার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) তখন প্রকাশ্যেই মমতাকে ‘দেবী দুর্গা’ বলে সম্বোধিত করেছিল। বিবিসিকে মমতা নিজেও বলেছিলেন, বিজেপি তার স্বাভাবিক মিত্র।

মমতার ক্ষমতায় আসার পেছনে আরএসএস ও বিজেপির ভূমিকা ছিল, অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তা মনে করেন। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে দেওয়া নিয়ে আরএসএস-বিজেপির যে আপত্তি, মমতা সেদিন নিজের মনগড়া পশ্চিমবঙ্গের আবেগের কথা বলে খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে পর্যন্ত বেকায়দায় ফেলেছিলেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।

মোদি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর, তিনি যেভাবে বিজেপিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাতে আরএসএসের সঙ্গে একটা ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে মমতা এখন বাজপেয়ীর বিজেপি আর মোদির বিজেপির তুলনা প্রকাশ্যে করেন। আরএসএসের সঙ্গে মমতা সখ্যতার বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন সিপিআই (এম) নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। মমতা বা কোনো তৃণমূল নেতাকে সেই অভিযোগের জবাব দিতে দেখা যায়নি। মমতার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তোলা হয়েছে আর তিনি জবাব দেননি, সাধারণত এমন হয় না। এক্ষেত্রে নীরবতাই তাৎপর্যপূর্ণ।

মনমোহন সিংয়ের প্রথম ইউপিএ জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের নাগরিকদের অনুপ্রবেশের ইস্যু, যেটি একান্তভাবেই আরএসএস ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ইস্যু, সেটি লোকসভায় তুলে তৎকালীন উপাধ্যক্ষ আটোয়ালকে মমতা কাগজ ছুড়ে মেরেছিলেন লোকসভার ভেতরে। কিন্তু, এখন মমতা নীরব।

ভারতকে মুসলমান-শূন্য করার লক্ষ্যে আরএসএস-বিজেপির অনেককালের লক্ষ্য এনআরসি (জাতীয় নাগরিকপঞ্জি)। ভারতীয় মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করে বিজেপি একদিকে ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদকে নিশ্চিত করতে চায়, অপরদিকে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানি দিয়ে সেখানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের জীবন দুর্বিষহ করতে চায়। সেই কারণেই বাংলাদেশ থেকে খেতে না পেয়ে মুসলমান নাগরিকেরা ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এসে হিন্দুদের সংখ্যালঘু করতে চাইছে ভারতে— এই অসত্য প্রচার পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে ছড়াচ্ছে বিজেপি।

গত শতকের চারের দশকে দেশভাগের সময়ের ছিন্নমূল মানুষদের উত্তরসূরিদের ভেতরে বাংলাদেশের মুসলমানরা এসে তাদের আবার দেশছাড়া করবে— ভোটে এই প্রচার পুরোদমে চালাচ্ছে বিজেপি। এই প্রচারের ভেতর দিয়ে দুই বাংলার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া নষ্ট করাই বিজেপির লক্ষ্য। বাংলাদেশকে ঘিরে বিজেপির যে অসত্য অপপ্রচার, সেটিকে তারা আরও শক্তিশালী করতে বামপন্থিদের সঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকীর দল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের নির্বাচনী বোঝাপড়াকেও একটা ইস্যু করে তুলছে। আদ্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ আইএসএফের নেতৃত্বে যেহেতু ফুরফুরা শরীফের আব্বাস সিদ্দিকী আছেন, তাই ওই দলটিকে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে বিজেপি। মমতা আজ পর্যন্ত সেই অপপ্রচারের বিরোধিতা করেননি। দুর্ভাগ্যের বিষয় সিপিআইএম (লিবারেশন), এসইউসিআই ইত্যাদি বামফ্রন্টের বাইরের বামপন্থি দলগুলোরও এই আব্বাসকে ঘিরে ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। সিপিআইএমের (লিবারেশন) সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক যেভাবে ধর্মীয় পরিমণ্ডল থেকে উঠে আসা আব্বাসকে ঘিরে মন্তব্য করেছেন, তা বিজেপির সাম্প্রদায়িক আক্রমণেরই সমতুল্য।

বাংলাদেশকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের চলতি বিধানসভা নির্বাচনে যে অপপ্রচার চলছে, বামপন্থিরা ছাড়া তার বিরুদ্ধতায় এখানে আর কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে দেখা যাচ্ছে না। যাদের ঘিরে এই অপপ্রচার, সেই আইএসএফ বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার। তবে, তারা বিষয়টি ঘিরে বেশি সরব হলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিই লাভবান হবে। তাই আইএসএফকে অত্যন্ত সতর্কভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।

কংগ্রেস দল এই ভোটে বামপন্থি ও আইএসএফের সঙ্গে সংযুক্ত জোটে আছে। তবে, নির্বাচনী প্রচার, বিশেষ করে বিজেপির সাম্প্রদায়িক প্রচার ও তৃণমূলের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক প্রচারকে মোকাবিলার প্রশ্নে কংগ্রেসের ভূমিকা মামুলি গোছের। বাংলাদেশকে ভোটে টেনে এনে সেখানকার জামায়াতে ইসলামের মতো যে সাম্প্রদায়িক প্রচার বিজেপি চালাচ্ছে, তার পাল্টা রাজনৈতিক উদ্যোগ কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত সেভাবে দেখা যায়নি।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলছেন। কিন্তু, তিনি ক্ষমতায় এসেই কার্যত গায়ের জোরে বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে মুসলমান বিদ্বেষকে বাংলাদেশ বিদ্বেষে রূপান্তরিত করার হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের চেষ্টায় একটি বিশেষ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাই আজ যখন খেতে না পেয়ে বাংলাদেশের মুসলমানেরা ভারতে এসে আবার দেশভাগের ষড়যন্ত্র করছে বলে অসত্য প্রচার করছে বিজেপি, তখন এর সামান্য প্রতিবাদও মমতা করছেন না।

বিজেপি পরিকল্পিতভাবে মুসলিম বিদ্বেষের পরিবেশ গত দুই দশক ধরে ভারতে তৈরি করেছে। বামপন্থিরা ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হয়। তারপর থেকে ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির আর প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শিবিরের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় এখানে মুসলিম বিদ্বেষ ক্রমবর্ধমান। কিন্তু, যেটি ছিল না, সেই বাংলাদেশ বিদ্বেষ এখন চলতি ভোটের দৌলতে পশ্চিমবঙ্গবাসীর প্রাপ্তি। মুসলমান বিদ্বেষ নিয়ে মমতা মাঝে-মধ্যে সরব হলেও বাংলাদেশ বিদ্বেষ নিয়ে একেবারেই নীরব। অসত্য প্রচারে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হলে পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক পরিবেশও যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেই রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার প্রতিফলন মমতার রাজনীতিতে দৃশ্যমান নয়।

মমতার এই বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরবতার কারণ অস্পষ্ট নয়। আরএসএস ভারতের গোটা পূর্বাঞ্চলজুড়ে মুসলমানদের ওপর আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অত্যাচার চালানোর জন্যেই বাংলাদেশ বিদ্বেষ তৈরি করছে। আরএসএসের মুখপাত্র ‘স্বস্তিকা’য় মহান একুশ উদযাপনকে ঘিরে বাংলাদেশের বাঙালিদের কটাক্ষ করা হয়। একুশের চেতনাকে বাংলাদেশের মানুষদের একান্ত নিজস্ব ভাবনা হিসেবে বাঙালি জাতিসত্তার সম্যক অভিমুখকেই অন্য খাতে বইয়ে দিতে চায় ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি। এর সুফল মমতাও পেতে চায়। ফলে সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার চলতি নির্বাচনে বাংলাদেশ বিশেষ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।

গৌতম রায়: ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

13h ago