চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার: ভ্যাকসিন সংকটের মধ্যেও চলবে প্রথম ধাপের টিকাদান
ভারত থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেও প্রথম ধাপের টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে আবার দ্বিতীয় ধাপের টিকাদান কর্মসূচিও শুরু হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছেন। সেরাম ইনস্টিটিউট বা অন্য কোনো উৎস থেকে নতুন করে ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত অবিলম্বে প্রথম পর্যায়ের টিকাদান বন্ধ রাখারও দাবি জানিয়েছেন তারা।
এই মুহূর্তে সরকারের হাতে ভ্যাকসিন আছে আর মাত্র ২৭ লাখ ডোজ।
স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমান গতিতে টিকাদান কর্মসূচি চললে আগামী ১০-১২ দিনের মধ্যে এই ভ্যাকসিনও শেষ হয়ে যাবে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘আমি মনে করি না যে, আমরা আবার খুব দ্রুতই ভ্যাকসিন পাব। তাই প্রথম ধাপের টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ করা উচিত বলে আমি মনে করি। যদি দ্বিতীয় ডোজের ভ্যাকসিন না দেওয়া যায়, তাহলে প্রথম ডোজের ভ্যাকসিনের অপচয় হবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘দ্বিতীয় ডোজের ভ্যাকসিন দেওয়ার দিকে সরকারের মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে সরকার অন্যান্য উৎস থেকে বেশি দামে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন কিনতে পারে। প্রথম ধাপের টিকাদান কর্মসূচি এখনই বন্ধ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পর্যাপ্ত ভ্যাকসিনের মজুদ থাকা সাপেক্ষে সরকার আবার দ্বিতীয় পর্যায়ের টিকাদান কর্মসূচি শুরু করতে পারে।’
তবে সরকারের দাবি, চলমান টিকাদান কর্মসূচি নির্বিঘ্ন করতে আগামী মাসের প্রথম দিকেই ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চলমান টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের টিকাদান কর্মসূচিও একইসঙ্গে চলবে। এখন আমাদের চিন্তার বিষয় হচ্ছে সংগ্রহে থাকা ভ্যাকসিনের মজুদ শেষ হওয়ার আগেই অন্যান্য উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা।’
এ ছাড়া, অন্যান্য উৎস হিসেবে চীন ও রাশিয়া থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
বিস্তারিত না জানালেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অন্য উৎস থেকে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন সংগ্রহেরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
চীনের তৈরি ‘সিনোফার্ম’ ভ্যাকসিন যে পরিমাণ সম্ভব সংগ্রহ করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা পাঁচ লাখ ডোজ সিনোফার্ম ভ্যাকসিন সংগ্রহের অনুমোদন দিয়েছি।’
রাশিয়ার তৈরি ‘স্পুটনিক ভি’ ভ্যাকসিনের বিষয়েও একই কথা জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, ‘বিকল্প উৎসগুলো থেকেও ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। আমরা আশাবাদী যে, মজুদ শেষ হওয়ার আগেই ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে পারব।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সংবাদিকদের জানিয়েছেন, সম্প্রতি রাশিয়া বাংলাদেশে তাদের ‘স্পুটনিক ভি’ ভ্যাকসিন উৎপাদনে সহায়তা দিতে প্রস্তাব জানিয়েছে।
তিনি আরও জানান, রাশিয়ার সহায়তায় দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন ছাড়াও বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ভ্যাকসিন কিনতে পারতো।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘...বাংলাদেশের যে পরিমাণ ভ্যাকসিনের প্রয়োজন, তারা সেটা দিতে পারবে না। তাই তারা ভ্যাকসিন তৈরির ফর্মুলা দিতে রাজি হয়েছে, তবে বাংলাদেশ এটা কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে না।’
সেরামের ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয়ে বাংলাদেশের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন জানান, ভ্যাকসিন পাঠাতে দেরি হওয়ার বিষয়ে সেরাম এখনো কিছু জানায়নি এবং ভ্যাকসিন রপ্তানির জন্য তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশাবাদী যে, ভ্যাকসিন পাব এবং চলমান টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হবে না।’
অন্যান্য উৎস থেকেও এই ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি উল্লেখ করে পাপন বলেন, ‘অন্য উৎসগুলো থেকে ভ্যাকসিন কেনার অনুমতির জন্য গত বুধবার আমরা অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। এই অঞ্চলের ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে সেরাম। এ ছাড়া, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও এই ভ্যাকসিন উৎপাদিত হচ্ছে। সুতরাং আমরা এসব জায়গা থেকেও ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছি।’
সেরামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদর পুনেওয়ালা ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ভ্যাকসিন রপ্তানির বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়, আপাতত মাস দু-একের মধ্যে ভ্যাকসিন রপ্তানির বিষয়ে আমরা চিন্তাও করছি না। আশাকরি, জুন-জুলাই থেকে আমরা আবারও স্বল্প পরিসরে ভ্যাকসিন রপ্তানি শুরু করতে পারব।’
‘এই মুহূর্তে আমরা দেশের প্রয়োজনকে বড় করে দেখছি’, বলেন আদার পুনেওয়ালা।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে মজুত থাকা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভারতে তৈরি ‘কোভিশিল্ড’ ভ্যাকসিনের এক কোটি দুই লাখ ডোজের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৭৫ লাখ ৭৭ হাজার ৮৮৯ ডোজ দেওয়া হয়ে গেছে।
গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার স্থানীয় এজেন্ট বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি তিন কোটি ডোজ কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা। কিন্তু, গতকাল পর্যন্ত দুই ধাপে মাত্র ৭০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ। আর ভারত সরকার উপহার হিসেবে দিয়েছে ৩২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন।
সম্প্রতি ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে সেখানে ভ্যাকসিন সংকট দেখা দেয়। ফলে ভারত সরকার আগে দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ রেখেছে।
এ বিষয়ে আদর পুনেওয়ালা এনডিটিভিকে বলেন, ‘আগামী জুলাই পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে পারে।’
চুক্তি অনুযায়ী সেরাম ইনস্টিটিউট ছয় ধাপে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে বিকল্প উৎস সন্ধানে আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে ভারতের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী।
তিনি বলেন, ‘ভারতেও বর্তমানে ভ্যাকসিনের বড় ঘাটতি রয়েছে। প্রতিটি বড় শহরেই ভ্যাকসিন সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশকে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের যে পরিমাণ ভ্যাকসিন সরবরাহ করার সুযোগ থাকবে, আমরা নিশ্চয়ই তা সরবরাহ করব।’
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ‘বিশেষ’ সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে দোরাইস্বামী বলেন, ‘আমরা বর্তমান সমস্যা মোকাবিলার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছি।’
ভারত এই মুহূর্তে খুব কঠিন সময় পার করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি। দেখা যাক, দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে একে অপরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে পারি।’
Comments