বালির নিচে ৪৬ পরিবারের চাপা কান্না!

বালিতে ডুবে যাওয়া বাড়ি। ছবি: আমানুর আমান/ স্টার

প্রায় ৫০ বছর ধরে বহলা গোবিন্দপুর গ্রামের যে জায়গাটিতে বসবাস করে আসছিলেন বৃদ্ধ সুজন শেখ তা এখন কেবল ধূসর স্মৃতি। সেই বাড়ি নেই, নেই সেই উঠোন, আঙিনা, বাড়ির চৌহদ্দি জুড়ে এখন শুধু বালি আর বালি। বালির স্তুপের নিচে চাপা পড়ে গেছে সুজন শেখের ভিটেটি।

শুধু সুজন শেখ নয়, পাশেই আয়নালের বাড়ি, তার পাশে তোহা বিশ্বাসের বাড়ি, একটু অদূরেই লালন আলীর বাড়ি সবই একই ঘটনার শিকার। প্রায় ৪৬টি পরিবারের একাধিক ঘর তলিয়ে গেছে বালির রাজ্যে। কোনো বাড়ির জানালা অব্দি, আবার কোনটির চালা পর্যন্ত, আবার কোনো বাড়ি একেবারেই চলে গেছে বালির নিচে। 

ঘটনাটি ঘটেছে জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের বহলা গোবিন্দপুর গ্রামে। গড়াই নদীর ড্রেজিংয়ের বালিতে গত ১২ এপ্রিল রাতে এ ঘটনা ঘটে।

কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, সুন্দরবন এলাকায় মিঠাপানির সরবরাহ বাড়াতে ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ৬২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়াই নদী খননের ষষ্ঠ ফেজের খনন কাজ চলছে। পাউবো কর্মকর্তারা জানান, নদীর বহলা গোবিন্দপুর গ্রামের অংশে এখন সাতটি সিএসডি ড্রেজার কাজ করছে। কাজ শুরু হয় কয়েক মাস আগে। 

পাউবোর গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও গড়াই নদী খনন, তীর সংরক্ষণ ও বনায়ণ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান যে এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে তার পুরো জায়গাটিই পানি উন্নয়ন বোর্ডের। সেখানে যারা বসবাস করে আসছিলেন তাদের বৈধ জায়গা নয় এটি। তিনি জানান সেখানে পাউবোর প্রায় ৪০ বিঘা মতো জলাশয় রয়েছে। ওই জলাশয়ের আশপাশ ও নিচু জায়গাগুলোতে ঘর-বাড়ি বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছিল প্রায় শ খানেক  পরিবার।

তিনি জানান, ওই পুকুরগুলো মাছ চাষের জন্য লিজ দেয়া হতো। কিন্তু এলাকায় ড্রেজিং-এর বালির সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতো পুকুরগুলো  ড্রেজিংয়ের বালি ফেলে ভরাট করার সিদ্ধান্ত হয়।

এই কর্মকর্তা দাবি করেন ড্রেজিংয়ের বালি সেসব পুকুর ও আশেপাশে ফেলা হবে, সেটি স্থানীয়দের আগে থেকেই বলা হয়েছিল এবং সেভাবেই বালি ফেলার কাজ চলছিল। বালির বাঁধ সৃষ্টি করে বালি ফেলা হচ্ছিল।

তিনি জানান বাড়ি-ঘরগুলো তারা উচ্ছেদ করতে চাননি। কারণ যারা বসবাস করে সবাই গরীব। কিন্তু দুর্ঘটনাবশত বালির বাঁধ গত ১২ এপ্রিল রাতে ভেঙে যায়। তখন চাপা পড়ে যায় পুকুর পাড়ের বাড়িগুলো।

চাপড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির হাসান রিন্টু বলেন, পাউবো বাড়ি-ঘরগুলো উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এলাকার মানুষের অনুরোধে সেটা করেনি।

তিনি অভিযোগ করেন, তাদের দাবি ছিল পুকুরের ওয়াটার লেভেল ধরে বালু ফেলার। কিন্তু ড্রেজিংয়ে বালির পরিমাণ বেশি হওয়ায় বালির স্তুপ জমতে থাকে।

“এসময় আমরা নিষেধ করি। এরপর তারা (পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদার) বলেন, বেড়িবাঁধ দিয়ে ফেলা হবে যাতে মানুষের ঘরবাড়ির ক্ষতি না হয়। কিন্তু রাতের আঁধারে বালু ফেলে এই অবস্থা করা হয়েছে।

তিনি জানান, তিনি স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কেউ কথা শোনেননি। সবার একই কথা যেহেতু ওই মানুষগুলোর কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই তাই তাদের কিছু বলার নেই।

বাসিন্দারা জানান, ঘটনার আকস্মিকতায় তারা হতবিহব্বল হয়ে পড়েন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব ডুবে যায় বালির নিচে। এমনকি তারা তাদের ঘর থেকে আসবাবপত্র পর্যন্তও বের করতে পারেনি। তারা জানান এটা ঘটে রাতের অন্ধকারে।

ইতোমধ্যে ঘটনার দু’সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। পরিাবরগুলোর কয়েকশ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। কেউ এলাকা ছেড়েছেন, কেউ আশ্রয় নিয়েছেন স্বজনদের বাড়িতে, কেউ থাকছেন খোলা আকাশের নিচে।

তাদের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসতর্কতার জন্য এ ঘটনা ঘটেছে।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির হাসান রিন্টুও জানান একটু সর্তক হলেই এ ঘটনাটি এড়ানো যেত। মানুষগুলোর কথা একটু ভাবা দরকার ছিল। 

তিনি জানান ‘শুধু ঘরই না, বালিতে চাপা পড়েছে প্রায় ৫০টি টিউবওয়েল ও কয়েকটি কবরস্থান পর্যন্ত।

ভূক্তভোগীরা জানান, এখন খাবার পানি কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে আনতে হচ্ছে। মিলছে না কোনো সহায়তাও।

এই ঘটনার পর বালি উত্তোলন বন্ধ করা হয়। প্রায় তিন দিন ড্রেজিং বন্ধ থাকে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার ড্রেজিং শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী তাজমির হোসেন জানান, নির্দেশ ছিল পুকুরগুলোই ভরাট করতে হবে। কিন্তু ঠিকাদারদের অমনোযোগের কারণে এই ঘটনা ঘটে গেছে। তিনি বলেন, এটা অন্যায় ও অপরাধ। যে কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিল, অফিস খুললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাব ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার (এসডিই) আলী আফরোজ বলেন ঘটনার পর বোর্ডের আদেশে এই বিষয়টি সমাধানে ১১ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য সোহেল রানাকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটিতে আছেন সাবেক চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন বিশ্বাস ও স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন।

প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. মনিরুজ্জামান বলেন তারা বিষয়টি জানার পর উদ্যোগ নিয়েছেন। স্থানীয়ভাবে বিষয়টি ফয়সালার জন্য গঠিত কমিটির তত্বাবধানে এখন বালি ফেলা হচ্ছে, যাতে নতুন করে কারো কোনো ক্ষতি না হয়।

তিনি বলেন, ‘যাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাদের জন্য স্থানীয় ঠিকাদারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেয়া হয়েছে যেন তারা কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে দেয়। তিনি বলেন, কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে অফিসিয়াল পর্যায়ে আলোচনা করে উদ্যোগ নেয়া হবে। আর স্থানীয়দের পুনর্বাসনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যারা যেখানে ছিল সেখানেই বসবাস করতে পারবেন।’

কমিটির আহ্বায়ক স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সোহেল রানা বলেন, ‘যারা যেখানেই আছেন তারা সেখানে বালুর ওপর নতুন করে ঘর বানাবেন। নতুন করে ঘর তুলতে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং স্থানীয়রা সহায়তা করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই মোতাবেক আমরা কাজ করছি।

এরইমধ্যে অনেকে কমিটির সহায়তায় ঘর তুলতে শুরু করেছেন বলে তিনি জানান।

Comments

The Daily Star  | English
Kamal Hossain calls for protecting nation

Kamal Hossain urges vigilance against obstacles to nation-building effort

"The main goal of the freedom — gained through the great Liberation War — was to establish democracy, justice, human rights and build a society free from exploitation. But we have failed to achieve that in the last 54 years," says Dr Kamal

1h ago