টিকা সংকট নিরসন: নতুন উৎস রাশিয়া ও চীন
চলমান কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার জন্য চীনের সিনোফার্ম ও রাশিয়ার স্পুতনিক-ভি টিকা আমদানির বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে সরকার।
সরকারের আট সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গতকাল সোমবার এ দুটি কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বলে জানিয়েছে কমিটি সূত্র।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘টিকার বিভিন্ন উৎস বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, এখন সিনোফার্ম ও স্পুতনিক-ভি ভ্যাকসিনই সবচেয়ে উপযোগী।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ছয় ধাপে তিন কোটি ডোজ টিকা পাঠাতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার টিকার বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করে।
এ লক্ষ্যে গত ১৯ এপ্রিল সরকার আট সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে টিকার বিকল্প উৎস খুঁজে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। এই কমিটির প্রধান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাহবুব জানান, দেশব্যাপী চলমান টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে তারা বিকল্প উৎসগুলো থেকে যত দ্রুত সম্ভব টিকা আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এ ছাড়া, সরকার অন্যান্য দেশের সঙ্গে যৌথ সহযোগিতার মাধ্যমে টিকা উৎপাদনেরও চেষ্টা করছে।
মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান গতকাল জানান, তারা সিনোফার্ম ও স্পুতনিক-ভি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নথি চেয়েছেন। নথি পাওয়ার পরই কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা মান বিবেচনা করে জরুরি প্রয়োজনে এগুলো দেশে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হবে।
আজ ইতোমধ্যে জরুরি ব্যবহারের লক্ষ্যে রাশিয়ার স্পুতনিক-ভি ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগামী মাস থেকে দেশে স্পুতনিক-ভি ভ্যাকসিনের ৪০ লাখ ডোজ আসা শুরু করতে পারে বলেও জানিয়েছেন মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান। শিগগিরই দেশে সিনোফার্মের ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেওয়া হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
সিনোফার্ম ও স্পুতনিক-ভি টিকার দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘দাম আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হবে। আমাদের সরকারের সঙ্গে ওই দেশগুলোর সরকারের আলোচনার ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ দুটি টিকাই কেনার ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।’
২০২০ সালের শুরুর দিকে বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টস বিবিআইবিপি-করভি নামের নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাসের একটি টিকা তৈরি করে। চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি দেশ বর্তমানে এ টিকা ব্যবহার করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এখনো এ টিকার অনুমোদন দেয়নি। তবে ডব্লিউএইচও’র পরামর্শক প্যানেল জানিয়েছে, সিনোফার্ম নিজেদের টিকার কার্যকারিতা বিষয়ক নথি তাদের সামনে উপস্থাপন করেছে।
অন্যদিকে, রাশিয়া দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য স্পুতনিক-ভি টিকার অনুমোদন দেয় গত বছরের আগস্টে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারত টিকা সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সম্প্রতি স্পুতনিক-ভি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ বিকল্প উৎস থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও, দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার অপেক্ষায় থাকা লোকজনের জন্য পর্যাপ্ত টিকা নিশ্চিত করাই এ মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেরামের তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ নেওয়া প্রায় ৩৫ লাখ বাংলাদেশি আছেন, যারা এখনো দ্বিতীয় ডোজ পাননি। কিন্তু, সরকারের কাছে আছে আর ২১ লাখ ডোজ।
দেশে টিকাদান কর্মসূচি বেশ ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু, গত শনিবার ভারত সরকার জানায়, কাঁচামাল সংকট ও অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে টিকা রপ্তানি স্থগিত রাখবে তারা।
ফলে গত রোববার থেকে প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ সরকার।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হাতে থাকা টিকাগুলো দুই সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যে যদি অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আর না পাওয়া যায়, তবে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা এমনকি বেসরকারি পর্যায়েও চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। স্থানীয় কোম্পানিগুলোও প্রস্তাব দিচ্ছে। তবে, সবকিছু এখনো যোগাযোগের পর্যায়েই আছে। এসব আলোচনাকে দ্রুত কাজে পরিণত করার চেষ্টা করছি আমরা।’
অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কাজ বাধাগ্রস্ত হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শেষ ডোজটি হাতে থাকা পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া অব্যাহত রাখা হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার জন্য শুধু একটি উৎসের ওপর নির্ভর করাটা সরকারের একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল এবং সরকারের কর্মকর্তারা এই সংকট আঁচ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) ড. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘আমরা সরকারকে দ্বিতীয় ডোজে একই টিকা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। কারণ দুটি ভিন্ন টিকা দেওয়ার বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো সমর্থন পাওয়া যায়নি।’
সরকার প্রথমে বিপুল সংখ্যক টিকা হাতে নিয়ে সফলতার সঙ্গেই টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছিল। সেরাম চুক্তির শর্ত পালন করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই সংকট দেখা দিয়েছে।
চুক্তি অনুসারে, বাংলাদেশকে ছয় ধাপে তিন কোটি টিকা দেওয়ার কথা ছিল সেরামের। ৫০ লাখ ডোজের প্রথম চালানটি ঠিকমতো দিলেও দ্বিতীয় চালানে মাত্র ২০ লাখ টিকা পাঠায় সেরাম। এরপর থেকে আর কোনো চালানই পাঠায়নি তারা।
এ অবস্থায় সরকার রাশিয়ার স্পুতনিক-ভি ও চীনের সিনোফার্মের টিকা সরবরাহকারীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আলোচনা চলছে। এখন পর্যন্ত সবকিছু ইতিবাচক। কিন্তু, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগে আমরা কিছু বলতে পারছি না।’
রাশিয়া ইতোমধ্যেই চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েক ধাপে বাংলাদেশের কাছে প্রায় আড়াই কোটি ডোজ স্পুতনিক-ভি টিকা বিক্রির বা স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে।
এ ছাড়া, আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে ধাপে ধাপে আরও সাড়ে তিন কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশে রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়ার সরকার।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিনোফার্ম বাংলাদেশকে বিনামূল্যে ছয় লাখ ডোজ টিকা দিতে চেয়েছে। এ ছাড়া, প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশকে প্রায় ১৫ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করতে পারবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলোজি বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সায়েদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রথম ডোজের দুই মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হলেও অক্সফোর্ড গবেষকরা জানিয়েছেন, দুই ডোজের মধ্যে ১২ সপ্তাহের ব্যবধান থাকলে তা সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেয়।’
তিনি বলেন, ‘এ কারণে যুক্তরাজ্য সরকার ১২ সপ্তাহের ব্যবধানে দুই ডোজ দিয়ে তাদের টিকাদান কর্মসূচি চালাচ্ছে। এমনকি, কানাডা দ্বিতীয় ডোজ দিচ্ছে ১৬ সপ্তাহ পর। তাই বাংলাদেশ সরকারের হাতে টিকা সংগ্রহের জন্য অতিরিক্ত আরও আট সপ্তাহ আছে।’
অধ্যাপক সায়েদুর যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় উদ্বৃত্ত থাকা অক্সফোর্ড টিকা এবং থাইল্যান্ডে নতুন অনুমোদন পাওয়া টিকা প্ল্যান্টের সঙ্গে চুক্তিতে যাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত আট সপ্তাহে সরকার এই উৎসগুলো থেকে টিকা সংগ্রহের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারে।’
অধ্যাপক সায়েদুর বলেন, ‘মহামারির এ সময়ে পর্যাপ্ত গবেষণা-প্রমাণ না থাকলেও কিছু দেশে দুটি ভিন্ন টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকার এই বিকল্পটির কথাও ভেবে দেখতে পারে।’
আরও পড়ুন:
‘আগামী মাস থেকে স্পুতনিকের ৪০ লাখ ডোজ টিকা আসতে পারে’
দেশে রাশিয়ার ‘স্পুতনিক-ভি’ ভ্যাকসিন অনুমোদন
শিগগির ভারত থেকে ভ্যাকসিন পাচ্ছে না বাংলাদেশ
ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের আহ্বান বিশেষজ্ঞদের
চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার: ভ্যাকসিন সংকটের মধ্যেও চলবে প্রথম ধাপের টিকাদান
বাংলাদেশকে আড়াই কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দিতে চায় রাশিয়া
টিকার বিকল্প উৎস সন্ধানে বাংলাদেশ
বাংলাদেশকে ৬০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দিতে চায় চীনের সিনোফার্ম
ভারত সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় বাংলাদেশে টিকা পাঠাতে পারছে না সেরাম
অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পাওয়ায় অনিশ্চয়তা: অন্য উৎস খুঁজছে সরকার
Comments