একজন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার শেখ নিয়ামত আলী

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তাকে বলা যায় ধূমকেতু। চলচ্চিত্রের গল্প, চিত্রনাট্য, নির্মাণ কৌশল যে কতটা শক্তিশালী, জীবনমুখী ও নিখুঁত হতে পারে তার প্রমাণ তারই চলচ্চিত্র। অথচ, তাকে নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রে সবচেয়ে কম আলোচনা হয়। এই কালজয়ী ও কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার হলেন শেখ নিয়ামত আলী।
শেখ নিয়ামত আলী। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তাকে বলা যায় ধূমকেতু। চলচ্চিত্রের গল্প, চিত্রনাট্য, নির্মাণ কৌশল যে কতটা শক্তিশালী, জীবনমুখী ও নিখুঁত হতে পারে তার প্রমাণ তারই চলচ্চিত্র। অথচ, তাকে নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রে সবচেয়ে কম আলোচনা হয়। এই কালজয়ী ও কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার হলেন শেখ নিয়ামত আলী।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমান ও সঙ্গীত পরিচালক আমানুল হকের সঙ্গে শেখ নিয়ামত আলী। ছবি: সংগৃহীত

তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য চূড়ায়। তার চলচ্চিত্রে বাংলার অকৃত্রিম জীবন, অভাব, দুর্দশা, বাংলার প্রান্তিক মানুষের কথা উঠে এসেছে। যা সাধারণত আমাদের চলচ্চিত্রে দেখা যায় না। তাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কথা বললে, সর্বোপরি বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের কথা বললে কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার শেখ নিয়ামত আলীর নাম আগে বলতে হবে। তাকে ছাড়া হয়তো বাংলা চলচ্চিত্র কখনোই সম্পূর্ণ নয়।

শেখ নিয়ামত আলীর জন্ম ১৯৩৯ সালের ৩০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনার সোনারপুর জেলার বেনিয়াবউ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তবে, তার পূর্ব পুরুষদের আদি ভিটা ছিল বাগেরহাট জেলায়।

১৯৫৬ সালে তিনি দক্ষিণ গড়িয়া যদুনাথ বিদ্যা মন্দির স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর ১৯৬১ সালে নন কলেজিয়েট এক্সটারনাল স্টুডেন্ট হিসেবে কলা বিভাগ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেন।

অন্য জীবন চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে শেখ নিয়ামত আলী। ছবি: সংগৃহীত

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন শেখ নিয়ামত আলী। কাজ করেন একটি চলচ্চিত্র ম্যাগাজিনেও। তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বাংলা নাট্য আন্দোলনের দিশারীদের সঙ্গেও। ষাটের দশক ছিল বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন ধারা শুরুর এক অনন্য অধ্যায়। সেখানেই যেন নিজের ঠাঁই খুঁজে পেলেন শেখ নিয়ামত আলী। ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে কলকাতা ছেড়ে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। ঢাকায় এসেও তার আগ্রহ বিন্দুমাত্র কমেনি। এসেই যুক্ত হলেন পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে। আলমগীর কবির, জহির রায়হানের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। তখন পত্রিকায় নিয়মিত চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি করতেন শেখ নিয়ামত আলী। পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদই নতুন করে পথ খুলে দিল তার সামনে। দেশ স্বাধীনের পর তিনি ভাবলেন কিংবদন্তি ঔপন্যাসিক জহির রায়হানের বিখ্যাত উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ির উপর চলচ্চিত্র বানাবেন। কিন্তু, বললে তো হলো না, চলচ্চিত্র বানাতে চাই টাকা। তার আগে চিত্রনাট্য চাই। শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের দুজনে মিলে চিত্রনাট্য তৈরির কাজে লেগে পড়লেন। তার লেখার ভঙ্গিমাও ছিল চমৎকার। মাদুরের ওপর বসে খালি গায়ে চিত্রনাট্য  লিখতেন আর মাঝে মাঝে চলত সিগারেট। একসময় চিত্রনাট্যের কাজ শেষ হলো। এবার অর্থ সংগ্রহের পালা। সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া গেল আর্থিক অনুদান। সূর্য দীঘল বাড়ি ছিল প্রথম সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ চলচ্চিত্রের শুটিং শুরু হলো।

কিন্তু, অভিনয় শিল্পী নির্বাচন করতে গিয়ে আরেক বিপাকে পড়লেন। ‘জয়গুন’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথমে প্রখ্যাত অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য তিনি চরিত্রটি করতে পারেননি। ফেরদৌসী মজুমদার জয়গুন চরিত্রে রূপদানের জন্য ডলি আনোয়ারের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। তার প্রস্তাবনা অনুযায়ী জয়গুনের চরিত্রে ডলি আনোয়ারকে নেওয়া হয়েছিল। সূর্য দীঘল বাড়ি চলচ্চিত্রের কাহিনী ছিল পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে। যেখানে একাধারে উঠে এসেছে কুসংস্কার, সম্পদ, ধর্ম, প্রতিপত্তি, সামাজিক বাধা-নিষেধ, এমনকি জাতীয়তাবোধ- এ সব কিছুকেই কাজে লাগিয়ে শ্রমজীবী ক্ষুধার্ত মানুষকে ক্রমাগত শোষণ। সূর্য দীঘল বাড়ি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৯ সালে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সূর্য দীঘল বাড়ি পুরস্কৃত হয়েছিল আটটি বিভাগে। এই চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন শেখ নিয়ামত আলী। বাচসাস পুরস্কারের মোট ছয়টি বিভাগে পুরস্কার লাভ করেছিল সূর্য দীঘল বাড়ি।

সূর্য দীঘল বাড়ি পুরস্কৃত হয়েছিলো বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতেও। সিনেমাটি ১৯৮০ সালের জার্মানির ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসব তিনটি বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছিল। পর্তুগালের  ফিগুএরা দা ফোজ চলচ্চিত্র উৎসবে ডন কিজোট বিভাগে পুরস্কার জিতেছিল সূর্য দীঘল বাড়ি।

অন্য জীবন চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে শেখ নিয়ামত আলী। ছবি: সংগৃহীত

শেখ নিয়ামত আলীর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ছিল ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিখ্যাত চলচ্চিত্র দহন। এটিও ছিল রাষ্ট্রীয় অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র। যে চলচ্চিত্রে ব্যক্তিগত প্রেমের চেয়ে সমষ্টিগত প্রেম গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে। একটা চলচ্চিত্রে  যে সমাজের কতো দিক তুলে আনা যায় তা দেখিয়েছেন শেখ নিয়ামত আলী। এই চলচ্চিত্রে দেখা যায়, বাজেট নিয়ে আলোচনা, মানুষ নিয়ে রাজনীতি, শেরে বাংলা নগরে প্রেম অভিসার। চলচ্চিত্রের গল্পে অর্থনৈতিক সামাজিক পুরানো পদ্ধতি ভাঙার সংগ্রামী প্রচেষ্টাকে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে মানুষ খুঁজছে  মুক্তির পথ। এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি চরিত্র ছিল গভীর বাস্তবিক ও জীবনমুখী। পোড় খাওয়া, মার খাওয়া জীবন যে কতোটা নির্মম হতে পারে তার দেখা মিলে এই চলচ্চিত্রে। দহন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন- বুলবুল আহমেদ, ববিতা, হুমায়ুন ফরীদি, শর্মিলী আহমেদ, প্রবীর মিত্র, ডলি আনোয়ার, রওশন জামিল, আবুল খায়ের, সাইফুদ্দিন, আসাদুজ্জামান নূর ও সৈয়দ আহসান আলীর মতো বিখ্যাত সব অভিনয়শিল্পীরা। দহন চলচ্চিত্রের প্রযোজনা করেছিল শেখ নিয়ামত আলীর প্রযোজনা সংস্থা এস নিয়ামত আলী প্রোডাকশন্স।

দহন চলচ্চিত্র তিনটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিল। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার ও কাহিনীকার হিসেবে শেখ নিয়ামত আলী পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। দহন বাচসাস পুরস্কার পেয়েছিল ১০টি বিভাগে। যেখানে শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার, শ্রেষ্ঠ রচয়িতা বিভাগে পুরস্কার পেয়েছিলেন শেখ নিয়ামত আলী।

শেখ নিয়ামত আলীর তৃতীয় চলচ্চিত্র ছিল ‘অন্য জীবন’। এই চলচ্চিত্র ছিল একজন রাজনৈতিক নেতা ও অসহায় গরীব তাঁতি সম্প্রদায়কে নিয়ে। যেখানে দেখা যায়, পান্তব মিয়া নামের এক  রাজনৈতিক নেতা শহরে থাকেন। নির্বাচনের সময় তিনি গ্রামে আসেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য গ্রামের তাঁতি সম্প্রদায়কে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু,  নির্বাচনে জয়লাভ করার পর পান্তব মিয়া গ্রামে তাঁতের মেশিন বসালেন। ভেঙে গেল তাঁতিদের স্বপ্ন। এই ভোটের রাজনীতি ও তার প্রভাব গ্রামের তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনে নিয়ে আসে চরম দুর্ভোগ। তাই নিয়ে এক অসামান্য চলচ্চিত্র অন্য জীবন। এই চলচ্চিত্রটিরও প্রযোজক ছিল শেখ নিয়ামত আলীর প্রযোজনা সংস্থা এস নিয়ামত আলী প্রোডাকশন্স। এই চলচ্চিত্র পেয়েছিল ১১টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে ১৯৯৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন শেখ নিয়ামত আলী।

দহন চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে শেখ নিয়ামত আলী। ছবি: সংগৃহীত

অন্য জীবন চলচ্চিত্রই ছিল শেখ নিয়ামত আলীর শেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।  এরপর রানী খালের সাঁকো  নামে একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র ও  আমি নারী নামে ১৯৯৬ সালে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন শেখ নিয়ামত আলী। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি এর আগে জনপরিবহন নামে  একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন তিনি। এছাড়া  ১৯৯৬ সালে বিটিভির জন্য নির্মাণ করেছিলেন শেষ দেখা  নামে একটি অসামান্য নাটক।

শেখ নিয়ামত আলী কোন মাপের নির্মাতা ও চলচ্চিত্রকার ছিলেন তা অবর্ণনীয়। তিনি শিল্পের নিপুণ তুলিতে এঁকেছেন মানুষের জীবন। এমন নিখুঁতভাবে বাংলা চলচ্চিত্রে খুব কম নির্মাতাই বলেছেন মানুষের কথা। জীবনে মাত্র ৩টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। সেই তিনটি চলচ্চিত্রই যেন বাংলা চলচ্চিত্রকে ছাড়িয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রেও নতুন করে চেনাল বাংলার জীবনকে।

বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার হওয়ার পরেও তার জীবনযাত্রা ছিলো অতি সাধারণ। আড়ম্বরতা পছন্দ করতেন না। প্রচারের অন্তরালেই থাকতেন তিনি। যখন চলচ্চিত্র মুক্তি পেত কেবল তখনই তাকে প্রকাশ্যে দেখা যেত।

শেখ নিয়ামত আলী আমাদের চলচ্চিত্রের নির্মাতা ও দর্শকদের শিখিয়েছেন বিদেশি চলচ্চিত্র থেকে বিন্দুমাত্র অনুপ্রাণিত না হয়েও কী করে বাংলার মানুষ, বাংলার মাটি, বাংলার জীবনযাপন নিয়ে দুর্দান্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব। শেখ নিয়ামত আলীকে বাদ দিলে বাংলা চলচ্চিত্র কেন অসম্পূর্ণ, তা তার নির্মিত তিনটি চলচ্চিত্রই প্রমাণ করে। বাংলা চলচ্চিত্র যতদিন থাকবে, এই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে শেখ নিয়ামত আলী থাকবেন চিরভাস্বর হয়ে। বাংলা চলচ্চিত্র যাকে মনে রাখবে এক অবিস্মরণীয় কিংবদন্তি রূপে।

আজ প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্রকার শেখ নিয়ামত আলীর জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা এই ক্ষণজন্মা চলচ্চিত্রকারের প্রতি।   

ছবি সূত্র: শেখ নিয়ামত আলীর মেয়ে শর্বরী ফাহমিদা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক ওয়েবসাইট ফিল্ম ফ্রি থেকে প্রাপ্ত।

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Age limit for govt job entry: 35yrs for men, 37 for women

A government committee has recommended raising the maximum age for applying for public service jobs to 35 years for men and 37 years for women.

8h ago