ঈদ ও ভারতের করোনা বিপর্যয়: উদ্বিগ্ন সরকার, কঠোর ব্যবস্থার চিন্তা
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করলে আরও মারাত্মক হতে পারে দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি। একইসঙ্গে আসন্ন ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভিড় সামলানো উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সামনে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবছে সরকার।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি সব অফিস ঈদ পর্যন্ত বন্ধ রাখা, ছুটির সময় কর্মস্থল ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, গার্মেন্টস শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে ছুটি দেওয়া এবং ঈদের পর দোকানপাট ও শপিং মল বন্ধ রাখার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া অনুপ্রবেশ, অনধিকার ও অবৈধভাবে প্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে সতর্কতা বৃদ্ধি করবে সরকার।
আগামী ৫ মে’র পর থেকে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়ার কথা থাকলেও ঈদের ছুটির এক সপ্তাহ পর আবারও এগুলো বন্ধ করে দিতে পারে সরকার।
এ ছাড়া, কলকাতার পরিস্থিতি যদি দিল্লির মতো হয়ে ওঠে, তবে আরও কঠোর পদক্ষেপের দিকে যেতে পারে সরকার।
দ্য ডেইলি স্টার এ সংশ্লিষ্ট সরকারের একাধিক কর্মকর্তার (যাদের মধ্যে মন্ত্রিসভার সদস্যরাও আছেন) সঙ্গে কথা বলে সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে জানতে পেরেছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এ বিষয়ে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে আগামী রোববার একটি বৈঠক হতে পারে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলে এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে গত ৫ এপ্রিল থেকে গণপরিবহন ও জনসাধারণের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। পরে এ বিধিনিষেধ কয়েক ধাপে বাড়িয়ে আগামী ৫ মে পর্যন্ত করা হয়।
উদ্বেগের বিষয় ভারত
কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বর্তমানে বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারত। করোনা রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির অনেকগুলো রাজ্যের হাসপাতাল। ভারতজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র অক্সিজেন সংকট।
গতকাল বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় সেখানে নতুন করে তিন লাখ ৭৯ হাজার কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ ছাড়া, মারা গেছেন আরও তিন হাজার ৬৪৫ জন।
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে দুই হাজার ২১৬ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। গত দুই সপ্তাহে ভারতের সার্বিক করোনা সংক্রমণ বাড়ার হার ৮৯ শতাংশ হলেও, পশ্চিমবঙ্গে এ সময়ের মধ্যে সংক্রমণের হার বেড়েছে ১৯২ শতাংশ।
পশ্চিমবঙ্গসহ পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন এবং উত্তরাখণ্ডে ৫০ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত কুম্ভ মেলার কারণেই মূলত সংক্রমণের গতি এতটা বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভারতের করোনাভাইরাসের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি বিবেচনা করে গত ২৬ এপ্রিল থেকে দেশটির সঙ্গে সীমান্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ সরকার। এরপর থেকে শুধু আটকে পড়া বাংলাদেশি ও মালবাহী যানবাহনগুলোকে দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে।
গত তিন দিনে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে অন্তত ৫১০ জন বাংলাদেশি দেশে প্রবেশ করেছেন। তাদের মধ্যে তিন জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের বেনাপোল প্রতিনিধি।
তিনি আরও জানান, চিকিৎসার জন্য তারা ভারতে গিয়েছিলেন এবং ভিসার মেয়াদ ১৫ দিনেরও কম ছিল। দেশে ফেরার পর তাদের সবাইকেই ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।
তবে, সারাবছর ভারত থেকে অনেক মানুষ অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাকেন। এটি এখন আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি’র ২০২০ সালের ডিসেম্বরে করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় অন্তত দুই হাজার ৬৩৮ জনকে আটক করে বিএসএফ। এ ছাড়া, ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৯৭১ জন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, প্রকৃত সংখ্যাটা আরও বেশি। যাদের বেশিরভাগই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়িয়ে অনুপ্রবেশ করে।
বিশেষ করে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকারী ট্রাকচালক ও তাদের সহকারীদের মাধ্যমে এখানে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রাশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আসবেই। তবে সরকারের উচিত দেশে এই ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ ঠেকাতে এবং বিস্তার রোধে প্রস্তুতি নেওয়া।’
ওষুধ ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান জানিয়েছেন, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে বা ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছে। বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারকে তিনটি ব্যবস্থা নিতে হবে। সেগুলো হলো- আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া, অক্সিজেন সরবরাহের সক্ষমতা বাড়ানো এবং অ্যান্টিজেন টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো।
এ ছাড়া, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে কোভিড-১৯ বিষয়ক ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি কমিটিও।
গত বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করলে নতুন করে সংকট তৈরি হবে। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত সীমান্তে পাহারা জোরদার করা।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যাত্রী চলাচলে (ভারত থেকে বাংলাদেশে) নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়ে বলেছে, কেউ যেন অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে।
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বি১.৬১৭ আগের যেকোনো স্ট্রেইনের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক।
বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ‘সেল’-এ গত ২০ এপ্রিল প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই ভ্যারিয়েন্টের এমন একটি মিউটিশেন আছে, যা মানুষের কোষকে সংক্রমিত করার শক্তি বাড়ানোর কাজে ভাইরাসকে সাহায্য করে। এ ভ্যারিয়েন্ট ২০ শতাংশ বেশি সংক্রামক বলেও গবেষণাগারে প্রমাণিত হয়েছে।
ঈদযাত্রার ভিড়
আগামী মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিত হবে ঈদুল ফিতর। ৫ মে চলমান বিধিনিষেধের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর সরকার গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দিতে পারে।
ধারণা করা হচ্ছে এ সময় বহু মানুষ তাদের বাড়ির উদ্দেশে রাজধানী ছেড়ে যাবেন। যাত্রীকল্যাণ সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, স্বাভাবিক সময়ে প্রায় ৮০ লাখ থেকে এক কোটি ২০ লাখ মানুষ ঈদ উপলক্ষে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর ছেড়ে যায়।
গত বছরের দুই ঈদে সরকারি নির্দেশনা তোয়াক্কা না করে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সারাদেশে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এটা একটা কারণ।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ঈদযাত্রার ভিড় কমাতে সরকারি-বেসরকারি অফিস ঈদ পর্যন্ত বন্ধই রাখা হবে। কারণ ৬ মে থেকে ঈদের ছুটির মাঝের সময়টায় মাত্র তিনটি কার্যদিবস থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া, সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মস্থল ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
গতকাল গার্মেন্টস কারখানা মালিকদেরও এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। পরিবহন সংকট এড়াতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বাড়ি যাওয়া নিশ্চিত করতে এলাকার অবস্থান বিবেচনা করে শ্রমিকদের ছুটি দিতে বলা হয়েছে।
ইউনিয়ন নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও কারখানা মালিকদের নিয়ে শ্রম ভবনে আয়োজিত এক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এ নির্দেশনা দেন।
এ বিষয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘যে যেখানে আছেন, তার সেখানেই ঈদ করা উচিত।’
অধ্যাপক রাশিদ বলেছেন, ‘প্রতি বছর ঈদ সামনে রেখে ঘরমুখো মানুষের যে ভিড় দেখা যায়, এবার তা ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
Comments