মুক্তিযুদ্ধ

৩০ এপ্রিল ১৯৭১: ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীরা যুদ্ধে জয়ী হবেই’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩০ এপ্রিল ছিল ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন নেপালের প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীরা যুদ্ধে জয়ী হবেই।
৩০ এপ্রিল খাগড়াছড়ির রামগড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি পরিদর্শনে মুক্তিবাহিনীর প্রধান ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩০ এপ্রিল ছিল ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন নেপালের প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীরা যুদ্ধে জয়ী হবেই।

৩০ এপ্রিল রংপুরের দমদমা ব্রিজে এক নির্মম গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদারেরা। শেরপুরের জগৎপুর গ্রামে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম গণহত্যার শিকার হন ৪২ জন নিরীহ গ্রামবাসী।

এদিন ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ এক বিশেষ ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে তুরস্কে পাকিস্তানি প্রতিনিধি মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় চক্রান্ত বলে আখ্যায়িত করেন। দেশের ভেতরে বহু জায়গায় পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। দেশের প্রতিটি প্রান্তে পাকিস্তানি হানাদারেরা  গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ চালিয়ে যায়।

ঢাকা

৩০ এপ্রিল ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ এক বিশেষ ঘোষণা দেয়। সে ঘোষণায় বলা হয়, ‘নাগরিকদের স্বাভাবিক কাজকর্মে, কৃষিকাজে কেউ হস্তক্ষেপ করা করলে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে। আর ৩০ জুনের মধ্যে বকেয়া খাজনা পরিশোধ করতে হবে।’

রাষ্ট্রীয় নেতা ও রাজনীতিবিদের বিবৃতি

৩০ এপ্রিল তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় অনুষ্ঠিত সেন্টো সম্মেলনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি ইফতেখার আলী মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় চক্রান্ত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু তারা সফলকাম হতে পারবে না। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কঠোর হস্তে দমন করা হচ্ছে।

নেপালের প্রধানমন্ত্রী বিপি কৈরালা কাঠমুন্ডুতে এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন এবং গণহত্যার গভীর নিন্দা জানাই। আমি আশা প্রকাশ করি, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীরা এই যুদ্ধে জয়ী হবে।

রংপুরের দমদমা ব্রিজ গণহত্যা

গভীর রাতে গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো ক্যাম্পাসের শিক্ষক কোয়ার্টারগুলোর বাসিন্দাদের। কোথাও কোনো শব্দ নেই। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে শঙ্কিত ক্যাম্পাসবাসী শুনতে পায় হানাদার বাহিনীর বুটের শব্দ। গাড়ি থেকে নেমে মুখ বাঁধা কয়েকজন অবাঙালি চিনিয়ে দেয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষকদের।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এক এক করে ধরে নেওয়া হয় অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায় এবং অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়কে। শুরু হয় রাইফেলের বাট দিয়ে বেধড়ক পিটুনি। অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়ের সহধর্মিণী মঞ্জুশ্রী রায় সহ্য করতে পারলেন না তার স্বামীসহ অন্যান্য শিক্ষকদের ওপরে এমন অমানুষিক নির্যাতন। তিনি বেরিয়ে আসেন এবং ঘাতকের দল তাকেও রেহাই দেয়নি। রাইফেলের বাট দিয়ে মারধর, বুট পরা পায়ে লাথি মারতে মারতে সবাইকে টেনে হিঁচড়ে তোলা হয় গাড়িতে। রাতের নিস্তব্ধতায় আবারও গাড়ির ইঞ্জিন চালুর শব্দ ভেসে আসতে থাকে। এক সময় সেই শব্দ আর শোনা যায়নি। পাকিস্তানি হানাদাররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছে। এদিকে শিক্ষকদের বাসাগুলো থেকে ভেসে আসতে থাকে কান্নার আওয়াজ।

এরপর কারমাইকেল কলেজের ক্যাম্পাস থেকে মিলিটারিদের গাড়ি বের হয়ে এগিয়ে চললো রংপুর-বগুড়া মহাসড়ক ধরে। প্রায় দেড় মাইল যাওয়ার পরে দমদমা ব্রিজের কাছে গিয়ে হানাদাররা থামলো। রাস্তা সংলগ্ন একটি বাঁশের ঝাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো হাত-পিঠ মোড়া করে বাঁধা শিক্ষকদের। দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো সারিবদ্ধভাবে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্জে উঠলো হানাদারদের রাইফেল। মুহূর্তের মধ্যে লুটিয়ে পড়লেন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায়, অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় ও তার সহধর্মিণী মঞ্জুশ্রী রায়। পরে দমদমা ব্রিজের পাশে এক বাঁশঝাড়ে গণকবর দেয়া হয় তাদের। অধ্যাপক আব্দুর রহমান ও অধ্যাপক সোলায়মানকে একই রাতে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদারেরা।

শেরপুরের ঝিনাইগাতির জগৎপুর গণহত্যা

৩০ এপ্রিল শেরপুরের ঝিনাইগাতির ধানশাইল ইউনিয়নের জগৎপুর গ্রামে পৈশাচিক কায়দায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদারেরা। এই গণহত্যায় শহীদ হন ৪২ জন নিরীহ গ্রামবাসী।

দিনটি ছিল শুক্রবার। সেদিন সকাল ৮টার দিকে জগৎপুরের পাশের  শংকরঘোষ গ্রাম থেকে স্থানীয় রাজাকার মজিবর, বেলায়েত, নজর ও কালামের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জগৎপুরের ত্রিমুখী আক্রমণ করে ঘিরে ফেলে। হানাদার বাহিনীর তিনটি দল এসময় জগৎপুর গ্রামের তিন দিকে অবস্থান নিয়ে নির্বিচারে গুলি করতে শুরু করে। ওই সময় গ্রামবাসী কিছু বুঝতে না পেরে প্রাণ বাঁচাতে  গ্রামের পেছনের দিকের রঙ্গবিলের দিকে দৌড়ে পালাতে থাকে। কিন্তু বিলের মাঝখানে পানি থাকায় কেউ সাঁতরে, আবার কেউ বিলের দুপাড় ঘেঁষে পালিয়ে যায়।

ওই সময় শুকনো জায়গা দিয়ে পালাতে গিয়ে হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ৪২ জন। এসময় হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন নিরীহ গ্রামবাসীরা। যারা সে হামলা থেকে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিলেন তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যে।

বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজনীতিবিদদের বিবৃতি

৩০ এপ্রিল লিবিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রধান কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি লিবিয়ায় নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আবদুর রউফ খানকে বলেন, ‘পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার জন্য ইয়াহিয়া খান সঠিক ব্যবস্থাই নিয়েছেন। লিবিয়ার পূর্ণ সমর্থন ও আস্থা আছে পাকিস্তান সরকার, সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষের ওপর।’

শান্তি কমিটির কার্যক্রম

রংপুরে শান্তিবাহিনীর উদ্যোগে এদিন শহরজুড়ে মিছিল বের হয়। মিছিলের নেতৃত্ব দেন জাতীয় পরিষদের সদস্য সিরাজুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আমিন।

৩০ এপ্রিল সিলেটে শান্তি কমিটির আহ্বায়ক নাজমুল হোসেন ও যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার আবদুল জলিল সিলেট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রদত্ত এক ভাষণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে এবং   মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।

তারা বলেন, ভারতের সহায়তায় এবং নির্দেশে ভারতের চর মুক্তিবাহিনী দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষকে উসকানি দিচ্ছে। পাকিস্তানের সরকারি অফিস কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করছে। জনগণকে এদের বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করে এদের সমূলে উৎখাত করতে হবে।

খুলনার দৌলতপুরের দিয়ানায় শান্তিবাহিনীর আহ্বায়ক সবুর খানের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সবুর খান খুলনাবাসীকে দেশদ্রোহী মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘মুক্তিরা এদেশে অরাজকতা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীলতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে। জনগণকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আপনারা যদি আমাদের প্রাণপ্রিয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেন তাহলে মুক্তিরা দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে আর নিতে যেতে পারবে না। যারা এখনও শান্তি কমিটিতে নাম লেখাননি, তারা অতিসত্বর দেশ রক্ষার্থে শান্তিবাহিনীতে যোগ দিন।’

ঢাকার বাইরে প্রতিরোধ যুদ্ধ ও ঘটনাবহুল দিন

৩০ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর প্রধান ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী খাগড়াছড়ির রামগড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি পরিদর্শন করেন এবং চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর নেন। পরিদর্শন শেষে তিনি মীর শওকত আলীকে যেকোনো মূল্যে আরও অন্তত দুদিন রামগড়কে মুক্ত রাখার নির্দেশ দেন। যেন নিরীহ মানুষরা সবাই নিরাপদে ভারতে আশ্রয় নিতে পারেন।

পঞ্চগড়ে অমরখানার কাছে মাগুরামারীতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ১০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলের ওপর পাকিস্তানি হানাদারেরা অতর্কিত হামলা করে। এসময় দুজন মুক্তিযোদ্ধা হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন, দুজন গুরুতর আহত হন।

৩০ এপ্রিল চট্টগ্রামের চিকনছড়ায় থাকা মুক্তিবাহিনীর ওপর হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা করে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটে স্থানীয় এক বাগানবাড়িতে আশ্রয় নেন।

 

তথ্যসূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: ষষ্ঠ, অষ্টম, নবম খণ্ড

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা: ১ মে ১৯৭১

দৈনিক পাকিস্তান: ১ মে ১৯৭১

রক্তে ভেজা একাত্তর: মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম)

 

আহমাদ ইশতিয়াক, [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago