মমতার জয় মোদির পরাজয়ের নেপথ্যে
ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল বাংলা বিজয়। যার কারণে বছর তিনেক আগে থেকেই বাংলা-জয়ের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করছিল বিজেপি। বিশেষত, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফল দেখে গেরুয়া শিবির পূর্ণ শক্তি নিয়ে নেমে পড়ে বাংলা বিজয়ে। একের পর এক তৃণমূল বিধায়ক ও হেভিওয়েট নেতাকে দলে ভিড়িয়ে বিধানসভা ভোটে জোরকদমে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজেপি। শুধু কি তাই, শেষমেশ ড্যান্সিং হিরো মিঠুন চক্রবর্তীকে পর্যন্ত দলে ভিড়িয়ে চমক দেয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভিযোগে অভিযুক্ত এই দলটি।
কিছু পরিসংখ্যান দেখলে হয়তো পরিষ্কার হবে যে, তারা কতটা সিরিয়াস ছিল। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচন উপলক্ষে প্রায় ২০টির মতো জনসভা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপি নেতা অমিত শাহ এই নির্বাচন উপলক্ষে বাংলায় ৫০টিরও বেশি জনসভা করেছেন। আর অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাদের কথা নাইবা বললাম। কিন্তু, তারপরেও কেন কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পায়নি? তাই নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ঘেঁটে যা পেলাম, তা হলো—
প্রথমত, নারী ভোট। বিজেপি আশা করেছিল বিহারে যেভাবে তারা নারী ভোট পেয়েছিল, সেভাবে তারা বাংলাতেও পাবে। কারণ গত কয়েক বছর যাবৎ মোদি সরকার টয়লেট, এলপিজি কানেকশন, বাড়িতে বাড়িতে কলের পানিসহ আরও অনেক উদ্যোগ নিয়েছিল নারী ভোটারদের মন জয় করতে। কিন্তু, দিনের পর দিন পশ্চিমবঙ্গের নারীরা মমতার পাশেই থেকেছেন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গে নারী ভোটারের সংখ্যা তিন দশমিক সাত কোটি, যা মোট ভোটারের ৪৯ শতাংশ। মমতা এই ভোটারদের কথা চিন্তা করে কন্যাশ্রী, রুপশ্রী ও সবুজ সাথীসহ প্রায় ২০০ ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। তার ফল তিনি প্রতিটি নির্বাচনে পেয়েছেন।
বিজেপি নারীদেরকে নীরব ভোটার বিবেচনা করে তাদের নীরব সমর্থন প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু, নারী ভোটাররা বরাবরের মতো তাদের মমতা দিদিকেই বেছে নিয়েছে এই নির্বাচনেও।
দ্বিতীয়ত, মুসলিম ভোট। পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ হলো মুসলিম। ভোটের মাঠে তাদের প্রভাব থাকে ১০০-১১০টি আসনে। ২০১১ সালের নির্বাচন থেকেই তারা তৃণমূলকে ভোট দিয়ে আসছে। মমতাও তার প্রতিদান দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৬০ হাজার ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে মাসে আড়াই হাজার টাকা করে ভাতা দেন। মাদ্রাসায় মুসলিম নারীদের ভর্তিতে উৎসাহ দিতে তাদের মাঝে বাইসাইকেল দেন, মুসলমান ছাত্রদের প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। এবং মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় উর্দুকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দেন। তিনি মুসলমানদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কারণে সমালোচকরা তাকে অনেক সময় ‘মমতাজ বেগম’ বলেও ডাকে।
কিন্তু, এই নির্বাচনে তার এই ভোট ব্যাংকে হানা দেওয়ার চেষ্টা করে ফুরফুরা পীর সাহেবের ছেলে পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী নতুন জোট নিয়ে মাঠে নামেন। কিন্তু, মুসলমানরা মমতার ওপরই ভরসা রাখেন। তাই তার ভোট ব্যাংকে ওই অর্থে কোনো টান পড়েনি।
তৃতীয়ত, বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ববাদী কার্ড সাড়া ফেলতে ব্যর্থ। বিজেপি নির্বাচনের শুরু থেকে শিডিউল কাস্ট ও শিডিউল ট্রাইবদের মন জয় করতে মরিয়া হয়ে উঠে। এতটাই মরিয়া ছিল যে ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের সময় ভারতের নিম্নবর্ণের হিন্দু জনগোষ্ঠী মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি ভ্রমণ করেন। তিনি সেখানে বক্তব্যও রাখেন। এই মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটাররা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে প্রায় ৩৫টির মতো আসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল এই ভোট বিজেপির ঘরে গেলেও একতরফাভাবে যায়নি।
চতুর্থত কংগ্রেসের ওয়াকওভার। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে যখন বিজেপি ও তৃণমূল পুরো বাংলা চষে বেড়িয়েছেন ভোটারদের মন জয় করতে, সেসময় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা ছিল অনেকটাই নীরব। রাহুল একটা মাত্র সভা করেছেন, সেটাও ১৪ এপ্রিল। আর প্রিয়াংকা তো যানইনি। এটা তৃণমূলকে এক ধরনের ওয়াকওভার দিয়েছে। বিজেপি নেতারা ইতোমধ্যে কংগ্রেস ও বাম দলগুলোর সমালোচনা করে বলেছে যে তারা মমতার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে।
পঞ্চমত, করোনাভাইরাস মহামারি। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণে পুরো ভারত তছনছ। আর এই দুরবস্থার জন্য দায়ী করা হয় মোদি সরকারকে। কিন্তু, মোদি সরকার এর পাল্টা কোনো জবাব দিতে পারেনি। তার ওপর যখন শশ্মানগুলো উপচে পড়ছিল লাশে, আর রাস্তায় মানুষ অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছিল, তা মোদি সরকারকে একদম বেকায়দায় ফেলে দেয়। যা মোদি সরকার কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার ওপর আবার শেষ তিন ধাপের নির্বাচনে মোদি ও শীর্ষ বিজেপি নেতারা কোনো জনসভায় যোগ দিতে পারেনি করোনার সংক্রমণের কারণে। অন্যদিকে মমতা তার ক্যাম্পেইন চালিয়ে গেছেন সমানতালে।
ষষ্ঠত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন কারণে ভোটারদের সহানুভূতি পেয়েছেন। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে একক শক্তি হিসেবে তিনি যখন মোদি-অমিত শাহকে চ্যালেঞ্জ জানান, তা জনগণ খুব ভালোভাবে নেয়। তারপর মমতার ওপর ‘আক্রমণের’ কারণে তিনি যখন হুইল চেয়ারে করে জনসংযোগ করে গেছেন, তার ভোটাররা খুব ইতিবাচকভাবে সেটি নিয়েছে।
সর্বশেষ যে কারণটি চোখে পড়েছে সেটা হলো, বিজেপি সম্ভাব্য কোনো মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে আনতে পারেনি। মমতার বিকল্প কে হবে, সেটা বিজেপি পরিষ্কার করতে পারেনি। মমতার মতো জনপ্রিয় ও পোড় খাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সামনে টেক্কা দেওয়ার মতো কোনো সম্ভাব্য প্রার্থী না থাকা মমতাকে সুবিধা দিয়েছে।
এর বাইরেও আরও কারণ থাকতে পারে, যা ধীরে ধীরে বের হবে। তবে, পশ্চিম বাংলার মানুষের এই জয় যে মূলত গণতন্ত্রের জয়, তা বলাই চলে।
ভারতের পত্রিকা ডেকান ক্রনিকলে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লেখা হয়েছে এভাবে, ‘এটা ভূমিধস বিজয়। এটা হ্যাট্রিক। দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি পরাজিত করেছেন বিজেপির বাংলা বিজয়ের সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল, অগণতান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী মনোভাবকে।’
মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments