বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণা পশ্চিমবঙ্গে এসে ব্যর্থ

মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়ে বিজেপি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুদের মধ্যে যতটা সমর্থন পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তারা সেটি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে ভারতের দ্য হিন্দু এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে জানায়, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় এ বছর পশ্চিমবঙ্গে অনেক ভোট বেশি পেয়েছে, তুলনামূলকভাবে বেশি আসনেও জিতেছে। কিন্তু সেসময় হিন্দু জনগোষ্ঠীদের মধ্যে দলটির যে সমর্থন ছিল এবার তা কমে গেছে।

বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণায় এবার উল্টো তৃণমূলেরই লাভ হয়েছে। ২০১৯ সালে এই রাজ্যে হিন্দুদের মধ্যে তৃণমূলের সমর্থন ছিল ৩২ শতাংশ, যা এবার বেড়ে ৩৯ শতাংশ হয়েছে। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী প্রচারণার পরও হিন্দুরা বেশি করে তৃণমূলকেই ভোট দিয়েছে।

নির্বাচনী প্রচারণায় ‘জয় শ্রী রাম’ এর মতো বিতর্কিত স্লোগান, অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ে আলোচনা, তৃণমূলের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের অভিযোগ তুলে নিজেদের ‘মুসলিমবিরোধী’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে বিজেপি। বিজেপির নেতারা সরাসরি বলেছেন ‘পশ্চিমবঙ্গ মিনি-পাকিস্তান হয়ে উঠছে’। তারা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘বেগম’ কখনও বা ‘খালা’ বলেও সম্বোধন করেছেন।

দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়, লোকনীতি-সিএসডিএস পরিচালিত নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষা থেকে ‘হিন্দুদের একত্রীকরণে’ বিজেপির ব্যর্থতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের মনস্তত্ব কীভাবে কাজ করছে সেই চিত্রও সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

গত লোকসভা নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের অন্যান্য অংশে উত্তরদাতারা ধর্মনিরপেক্ষতা, মন্দির-মসজিদ বিরোধ ও সংখ্যালঘু অধিকার সম্পর্কে তাদের মতামত জানিয়ে একগুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর দেয়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, রাজনৈতিক মেরুকরণ সত্ত্বেও, পশ্চিমবঙ্গে তখন কিংবা এখনও সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দেয়নি। দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে যারা ভোট দিয়েছেন তারাসহ অধিকাংশ হিন্দুই বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তরে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের পক্ষে মতামত দিয়েছেন, যা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশি।

উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অন্য সব রাজ্য মিলিয়ে পাঁচ ভাগের দুই ভাগ মানুষ মসজিদ ভাঙার বিরুদ্ধে বলেছেন। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে প্রতি পাঁচ জন হিন্দুর মধ্যে মাত্র একজন বলেছিলেন যে, এটি কোনো অন্যায় ছিল না।

একইভাবে, বাংলায় হিন্দুদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ (৮১ শতাংশ) মনে করে যে, ভারত কেবল হিন্দুদের নয়, এটি সকল ধর্মের একটি দেশ। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে হিন্দুদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ এই উত্তর দিয়েছিল।

সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষার ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের ৩৮ শতাংশ হিন্দু এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের পছন্দ না হলেও সরকারকে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। সমীক্ষায় এই প্রশ্নটি দুবার রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয়বারে ৫৮ শতাংশ হিন্দু এ প্রস্তাবে একমত হয়।

এই প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় যে, বাঙালি হিন্দুরা ২০১৯ সালে বিজেপিকে সমর্থন করার পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল। তারা বিজেপির হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে সমর্থন করে না। এটিই সম্ভবত ব্যাখ্যা করে যে, কেন হিন্দু ভোটারদের মধ্যে বিজেপির সমর্থন এ বছর বাড়েনি বরং পরিবর্তে কমেছে।

গেল নির্বাচনে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা খুব সম্ভবত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে যে উদারপন্থী সহিষ্ণু অংশ আছে তাদেরকে বিজেপিবিরোধী করে তুলেছে। এ অংশটিই ২০১৯ সালে তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে বিজেপির প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিল।

২০১৯ সালে মুসলিমদের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের যে সমর্থন ছিল এ বছর সেটি আরও বেড়ে ৭৫ শতাংশ হয়েছে। তৃণমূলের পক্ষে মূলত হিন্দু-মুসলিম দুই জনগোষ্ঠীরই সমর্থন বেড়েছে।

এ চিত্রটির অবশ্য আরও একটা দিক আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘সংখ্যালঘুদের প্রতি অতিরিক্ত অনুগ্রহ দেখায়’ এইরকম প্রচারণা আছে গেরুয়া শিবিরে। উদ্বেগের বিষয় হলো, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই ধারণার পক্ষে ব্যাপকভাবে সমর্থন দেখিয়েছেন।

২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ হিন্দু, এমনকি যারা তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে ভোট দিয়েছে, তারাও একমত হয়েছিল যে দলটি মুসলমানদের অতিরিক্ত অনুগ্রহ দেখিয়েছে। তারা মনে করে, এটাকে পুঁজি করেই বিজেপি নিজেদের উত্থান ঘটানোর সুযোগ পেয়েছে।

কিন্তু, এখানে দেখার মতো ব্যাপার হলো, এই অভিমত পোষণ করার পরও অনেকেই তৃণমূলকেই ভোট দিয়েছেন।

এই নির্বাচনে যে ধর্মীয় মেরুকরণ দিয়ে ফল নির্ধারিত হয়নি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এটাও লক্ষণীয় যে, তৃণমূলের ভোটারদের মধ্যে হিন্দুরা ছিল ৫৭ শতাংশ ও মুসলমানরা ছিল ৪২ শতাংশ। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ভোটারদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয়ই ৫০ শতাংশ করে ছিল।

মোটকথা, হিন্দু মনস্তত্ত্ব নিয়ে রাজনীতিতে নামা বিজেপি সম্ভবত বাঙালি হিন্দু মানসিকতা বিশ্লেষণে ব্যর্থ হয়েছে। দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষের তৈরির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

এদিকে, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়- হিন্দুরাও বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ ও অন্যান্য সামাজিক পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভক্ত। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা নিশ্চিতভাবেই জীবন- জীবিকা নিয়ে তাদের নিত্যদিনের যে সংকট সেটা পূরণের আশ্বাস দেয় না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে দ্বি-মাত্রিক ধর্মীয় মেরুকরণের জন্য জায়গা খুবই সীমিত।

আরও পড়ুন:

মমতার জয় মোদির পরাজয়ের নেপথ্যে

 

মমতার সাফল্য এবং বাম বিপর্যয় প্রসঙ্গে

Comments

The Daily Star  | English

Cops gathering info on polls candidates

Based on the findings, law enforcers will assess security needs in each constituency and identify candidates who may pose risks.

13h ago