দরপত্র জটিলতায় থেমে গেছে ইবির দুটি হল নির্মাণ প্রকল্প
দরপত্র নিয়ে জটিলতায় থেমে আছে ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) হল নির্মাণ প্রকল্প। শঙ্কা তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৫৩৭ কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন নিয়েও।
অবকাঠামোগত উন্নয়নে ২০১৮ সালে ৫৩৭ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রকল্পের আওতায় আবাসিক হল ও একাডেমিক ভবনসহ মোট নয়টি ১০তলা ভবন এবং ১৯টি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়।
এর মধ্যে গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হল-২ ও ৫ মার্চ ছাত্রী হল-২ নামে দুটি হল নিমার্ণে ১০৬ কোটি টাকা মূল্যমানের দরপত্র আহ্বান করে কর্তৃপক্ষ। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ১৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর দুই দফায় তারিখ পিছিয়ে গত বছরের ১৩ ও ১৪ মে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দরপত্র দুটি উন্মুক্ত করা হয়। এর মধ্যে দরপত্রের তথ্য ফাঁসের অভিযোগ উঠে। তবে সেই অভিযোগ আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর জানায়, ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেওয়ার পরে ছয়টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কারণে তাদের দরপত্র প্রত্যাহার করেন। দুটি কাজের জন্য মেসার্স রহমান ট্রেডার্স (এমআরটি) ও ম্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের দরপত্র বাছাই করা হয়।
রহমান ট্রেডার্স সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও নির্ধারিত সব শর্ত যথাযথ পূরণ না করায় প্রতিষ্ঠানটির দরপত্র বাতিল করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতার কাজ পাওয়া কথা। ম্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান এবং সব শর্ত পূরণ করেছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ম্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে কাজ না দিয়ে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয়।
সে সময় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের মধ্য দিয়ে তৎকালীন উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়। নতুন উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক শেখ আব্দুস সালাম যোগ দেন। গত ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সঙ্গে সভা করেন এবং পুনরায় দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত দেন।
সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চক্র পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বিষয়টি জেনে আব্দুস সালাম ই-টেন্ডার আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেন।
এই জটিলতার মধ্যে গত ২ ফেব্রুয়ারি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি পুনর্গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবর রহমানকে বাদ দেওয়া হয়। তার পরিবর্তে কুষ্টিয়া অঞ্চলের গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে বাইরের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নতুন কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক এইচ এম আলী হাসানকে সভাপতি ও বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মুন্সী শহীদ উদ্দীন মো. তারেককে সদস্য সচিব করা হয়।
ম্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহেদ মুরাদ গত ৯ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতে রিট করেন। এতে উপাচার্য, উপউপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সাবেক ও বর্তমান সদস্যসহ ১১ জনকে বিবাদী করা হয়। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ মার্চ বিচারপতি খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মাহমুদ হাসান তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ ছয় মাসের জন্য দরপত্র স্থগিতের আদেশ দেন। পাশাপাশি আবেদনকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কেন কার্যাদেশ দেওয়া হবে না সে মর্মে রুল দিয়েছিলেন। ছয় সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। করোনা মহামারির কারণে ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালিত হওয়ায় রুলের ওপর শুনানি হয়নি। আদালত জানিয়েছেন, আপাতত এ ধরনের আবেদন শোনা হবে না।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক শেখ আব্দুস সালাম জানিয়েছিলেন, টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি সাতটি সভা করেও ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। ২০১৮ সালের রেট অনুযায়ী এস্টিমেট করা হয়েছিল, ২০২১ সালে নতুন রেট চূড়ান্ত করা হয়েছে। সব কিছুর বাজারমূল্য বেড়ে গেছে। এ ছাড়া, পিপিআর’র নিয়ম অনুযায়ী এখানে কাজের প্রতিযোগিতা হয়নি। যেহেতু সময় পাওয়া যাবে, তাই রি-টেন্ডারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দরপত্র কিনেও কাজ পাননি এমন বেশ কয়েকজন ঠিকাদার পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘যে কটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়, তাদের নাম আগেই ফাঁস হয়ে যায়। একটি মোবাইল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রজেক্ট ডিরেক্টর ও প্রধান প্রকৌশলীকে সেল ফোন মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেনি।’
জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মুন্সী সাইদ মো. তারেক বলেন, ‘এ ধরনের নাম ফাঁস হয়ে যাওয়ায় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কোনো ক্ষতি হয় না। কারণ কে কত শতাংশ দর দিয়ে দরপত্র জমা দিয়েছে, তা তো আর ফাঁস হয়নি। এতে মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নেও কোনো সমস্যা হবে না।’
এ বিষয়ে কোনো ঠিকাদার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন উপাচার্য শেখ আব্দুস সালাম।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে আরও বলেন, ‘নতুন করে এখন কিছু বলা যাবে না। কারণ বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।’
যোগাযোগ করা হলে ম্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহেদ মুরাদ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
Comments