বাজেট ২০২১-২২: আর্থিক দুর্দশায় দরিদ্র ও কর্মহীনরা
নতুন দরিদ্রদের জন্য আগামী বাজেটে আরও বিস্তৃত আর্থিক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ মহামারি আঘাত হানার পর থেকে তারা যা সরকারি সহায়তা পেয়েছেন তা ছিল অপ্রতুল। এখন তারা অনটনে আছেন।
অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে দরিদ্র ও কর্মহীনদের জন্য বেশ কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল সরকার। ১২টি প্যাকেজের আওতায় সর্বমোট ২৪ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল।
তবে বাস্তবে এ উদ্যোগগুলো অদক্ষতা ও অঞ্চল ভিত্তিক পরিকল্পনার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্চ মাস পর্যন্ত সরকার বরাদ্দকৃত অর্থের ৩২ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে।
তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ও শহরের দরিদ্রদের একটা বড় অংশের কাছেই সহায়তা পৌঁছেনি। অথচ এই শ্রেণির মানুষের দুর্দশা লাঘবেই এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একটি পরিপূর্ণ ডেটাবেস না থাকার কারণেই তারা বঞ্চিত হয়েছেন।
পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডির) এর একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে মহামারির কারণে গত এক বছরে প্রায় দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ, অর্থাৎ জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ দরিদ্র হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ এবং অংশীজনেরা বলেছেন, যদি এ কর্মসূচিগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হতো, তাহলে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের উপার্জন পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না।
বাংলাদেশ হোটেল-রেস্টুরেন্ট-সুইটমিট-বেকারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আক্তারুজ্জামান খান বলেন, এই খাতে কর্মরত মানুষেরা মহামারির পুরোটা সময় জুড়ে সরকারি কোনো ধরনের সহায়তা পায়নি।
‘অনেক কর্মীদের খাবার জোগাড় করতেই অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। ক্ষুধা এখন আমাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী।’
আক্তারুজ্জামান বলেন, যদি সরকার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে সবার জীবন- জীবিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে।
‘আমাদের জমানো টাকা শেষ হয়ে গিয়েছে। আমরা বাঁচতে চাই।’
সংগঠনটি প্রত্যেক বেকার কর্মীকে সহায়তা হিসেবে মাসিক ১০ হাজার টাকা করে বছরে কয়েক দফায় ভাতা দেওয়ার দাবি করেছে।
আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘তবে কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবিকে পাত্তা দেয়নি।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোতে বরাদ্দ দ্বিগুণ করা উচিত।
গত বছর যে পরিবারগুলো সহায়তা পেয়েছিল, এ বছরও সরকার তাদেরকে আড়াই হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দিয়েছে। এক হাজার ২৫৮ কোটি টাকার প্যাকেজের আওতায় প্রায় ৩৫ লাখ পরিবারকে টাকা দেওয়া হয়েছিল গত বছর। এবারও তারা এই সহায়তা পেয়েছে।
রায়হান বলেন, ‘দরিদ্ররা যে ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন, সে অনুপাতে সাহায্য গ্রহীতার সংখ্যা এবং তহবিলের পরিমাণ যথেষ্ট নয়।’
তিনি বলেন, কমপক্ষে ৫০ থেকে ৭০ লাখ পরিবারের পাঁচ হাজার টাকা করে অন্তত তিন মাস ধরে অর্থ সহায়তা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর ২০১৬ সালের একটি সমীক্ষা বলছে চার সদস্যের একটি পরিবারকে শহর অঞ্চলে বসবাস করার জন্য মাসে অন্তত ছয় হাজার টাকা প্রয়োজন হয়।
রায়হান বলেন ‘সঠিক নির্বাচন ও বিতরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে রয়েছে।’
উপার্জনক্ষম সদস্যরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে এরকম ৫০ লাখ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল সরকার। কিন্তু কিছু অনিয়মের কারণে সংখ্যাটি কমে গিয়ে ৩৫ লাখে নেমে আসে।
নতুন দরিদ্ররা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর কোন তালিকায় জায়গা পায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক রায়হান বলেন, ‘সামাজিক পুনরুদ্ধার ছাড়া অর্থনীতির পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।’
মহামারির কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে ফেরার ব্যাপারটি নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে গ্রামগুলোতে। এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য স্কুলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ধরে রাখার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
অনেক পরিবারই তাদের সন্তানদের জন্য অনলাইন পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে পারেনি, কারণ দূরশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন: ইন্টারনেট এবং স্মার্ট ডিভাইস বেশ ব্যয়বহুল। অধ্যাপক রায়হান জরুরিভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের পর্যালোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
‘সরকারের উচিত মোবাইল ফোন অপারেটর এবং তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একত্র হয়ে সাশ্রয়ী ইন্টারনেট ও ডিভাইসের ব্যবস্থা করা। এই কর্মসূচির জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো উচিত।’
বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, বেশ কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ খাতে অনেক কর্মী চাকরি হারিয়েছেন।
‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রণোদনা প্যাকেজগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পে সহায়তা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
তিনি বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য নির্ধারিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ কোন ব্যাংককে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিতে উদ্বুদ্ধ করেনি।
এই প্যাকেজের আওতায় মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ৮৯ হাজার ৮৯২ জন ব্যবসায়ীকে প্রায় ১৩ হাজার ১১ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি এই প্যাকেজটিকে প্রাণবন্ত করার জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি দিয়েছে, তবুও এ কর্মসূচির আরও পরিবর্ধন প্রয়োজন। মতিন বলেন, ‘দরিদ্রদের ত্রাণ দেওয়ার চেয়ে এখন নগদ অর্থ সহায়তা অনেক বেশি জরুরি।’
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে পারলে নতুন দরিদ্রদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে এবং এতে তারা বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত সামাজিক পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করা। স্কুলের বৃত্তি কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ আরও বিস্তৃত করা উচিত।’
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা যাতে স্কুল ছেড়ে না দেয়, তা নিশ্চিত করার জন্য তাদেরকে ১০০ টাকার পরিবর্তে মাসে ৫০০ টাকা করে বৃত্তি দেওয়া উচিত।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদেরকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে তাদের কোনো ডেটাবেস নেই।
বিবিএস এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ছয় কোটি ৮০ লাখ কর্মীর মধ্যে ৮৫ দশমিক ১ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন।
মতিন বলেন, ‘সরকারের উচিত এখনই বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নেওয়া, কারণ সামনে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের আরও ঢেউ আঘাত হানতে পারে। আমরা মনে করি না যে দ্বিতীয় ঢেউ এর পরেও বাংলাদেশ প্রথম ঢেউ এর প্রভাব থেকে এখনও পুরোপুরি মুক্ত হতে পেরেছে।’
বাংলাদেশ হকার ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সভাপতি মো. মুরশিকুল ইসলাম বলেন, ফুটপাথের বিক্রেতাদের আয় কমে যাওয়াতে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে এবং তারা সরকারের কাছ থেকেও তেমন কোনো সহায়তা পাননি।
গত বছরের লকডাউনের সময় হকারদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের প্রায় ২০ শতাংশ এখনও কাজে ফিরতে পারেননি।
মুরশিকুল সুদ-মুক্ত ঋণ সুবিধা এবং হকারদের জন্য রেশন হিসবে খাদ্য সামগ্রী দেওয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘আসন্ন বাজেটে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে নগদ অর্থ সহায়তা প্রয়োজন। এটি না পেলে হকারদের সমস্যাগুলো আরও অনেক বেড়ে যাবে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বাজেটে নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোতে বর্ধিত বরাদ্দ দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।
২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল, যা জিডিপির ৩ দশমিক ০১ শতাংশ। সিভিল পেনশন বাদ দিলে, তা জিডিপির ১ দশমিক ৮ শতাংশ হবে।
রহমান বলেন, সরকারের উচিত হবে পেনশন বাদে এটিকে বাড়িয়ে জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া।
সিপিডির ভাষ্য অনুযায়ী, মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে বেকারদের একটি বড় অংশ কাজ খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু তাদের আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছে।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments