ব্ল্যাক ফাঙ্গাস: ভারতের উদাসীনতায় বিপদ বাড়বে বাংলাদেশের
ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে ভারত সরকার এই রোগকে মহামারির তালিকায় এনে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য সরকারগুলোকে।
কোভিড থেকে সুস্থ হওয়া মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসে। ফলে তাদের মতো শারীরিকভাবে দুর্বল মানুষের শরীরে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহামারি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এই রোগকে বিরল ও গুরুতর সংক্রমণ বলে চিহ্নিত করেছে।
ভারতের গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে এই রোগ গুজরাট থেকে এসেছে বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন। এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ জন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তার মধ্যে একজন কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন।
মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস করোনা মহামারির মধ্যেই রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, দিল্লিতে বিপদের সম্ভাবনাকে প্রবল করে তুলেছে। সেই সঙ্গে গোটা ভারতকেই ঠেলে দিয়েছে প্রবল সঙ্কটের মুখে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোধে যে ধরণের ওষুধ দরকার, সেই ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে অযথা গড়িমসি করছে ভারত সরকার। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ তোপে ইতোমধ্যেই অভিযোগ করেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার ব্ল্যাক ফাঙ্গাস মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে অহেতুক কার্পণ্য করছে।
মহারাষ্ট্র সরকার দেড় থেকে দুই লাখ ওষুধ চেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। কিন্তু, তারা পেয়েছে মাত্র ১৬ হাজার ভায়াল।
নরেন্দ্র মোদি সরকার যে এই মারণব্যাধি প্রতিরোধে আদৌ আন্তরিক নয়, তা বোঝা যায় দিল্লি হাইকোর্টের একটি সাম্প্রতিক রায়ে। দিল্লি হাইকোর্ট মারণব্যাধি ব্ল্যাক ফাঙ্গাস প্রতিরোধক ‘অ্যাম্ফোটেরেসিন বি’ ওষুধটি পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহের জন্যে ভারত সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বহনকারী ছত্রাক বাতাসে উড়ে বেড়াতে সক্ষম। সাধারণ মানুষ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে এই ছত্রাক সংক্রমণকে প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু কোভিড আক্রান্ত বা কোভিড থেকে সুস্থ হওয়া কারও শরীরে কিংবা যাদের ডায়াবেটিস, ক্যান্সার আছে তাদের শরীরে খুব সহজেই এই ছত্রাক আক্রমণ করছে। নাক, কান, গলা ইত্যাদির ভেতর দিয়ে সহজেই দুর্বল মানুষের শরীরে এই সংক্রমণ ঘটছে। কোভিড মোকাবিলায় যেসব রোগীদের অতিরিক্ত স্টেরয়েড দেওয়া হয়েছে তাদের শরীরে সহজেই এই মারণ ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটছে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের বিপদ ঘিরে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহল বহুদিন আগেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল। কোভিডের মতোই সেই সতর্কতা বার্তাকে পাত্তাই দেয়নি ভারত সরকার। আন্তর্জাতিক সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে এই রোগ যাতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে ছড়াতে না পারে তার জন্যেও ভারত সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলের ভারতীয় অংশে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এতোই দুর্বল যে সেখানে যদি একজন মানুষ ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হন, তাহলে খুব সহজেই বাতাসের মাধ্যমে সেই ছত্রাক ঢিল ছোড়া দূরত্বে থাকা বাংলাদেশের মানুষের শরীরেও সংক্রমণ ঘটাবে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যাতে এই রোগ কোনো অবস্থাতেই না ছড়ায় সে জন্যে ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনো স্বাস্থ্য পরিকাঠামোই তৈরি করেনি।
নিজের দেশের নাগরিকদের মধ্যে সংক্রমণ রুখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে যে অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় রেখেছিল ভারত সরকার, তার জেরে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারত সম্পূর্ণ বেহাল অবস্থার ভেতরে রয়েছে। দেশের নাগরিকদের ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে চরম উদাসীন থেকেছে ভারত সরকার। এখন সেই উদাসীনতা তারা দেখাচ্ছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রেও।
ভারতীয় আইন অনুযায়ী যাবতীয় ওষুধের মজুত রাখার অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের। নরেন্দ্র মোদি সরকার নিজেদের ভাণ্ডারে মজুত ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের ওষুধ অঙ্গরাজ্যগুলোতে সরবরাহের ক্ষেত্রে চরম রাজনীতি করছে। পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, দিল্লির মতো বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকা রাজ্যে ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে চরম পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে।
কোভিডের পাশাপাশি এই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ শুধু ভারতের বিপদ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বিপদ। বাংলাদেশও এই বিপদ থেকে নিস্তার পাবে না।
সংক্রমণ ঘিরে যে ধরণের উদাসীনতা ভারত সরকার দেখাচ্ছে তা গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে সহজেই একটা বড়ো বিপদের ভেতরে ফেলে দেবে। প্রগলভতার জন্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির খ্যাতি আছে। গত বছর লকডাউনের সময় থালা বাজানো, শঙ্খ ধ্বনি করা, আলো নিভিয়ে প্রদীপ-মোমবাতি জ্বালানো- এমন আজব ও অবৈজ্ঞানিক কথা বলা নরেন্দ্র মোদি কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে নিশ্চুপ। তার একান্ত সহযোগী অমিত শাহের মুখেও কথা নেই। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শোরগোল পড়ে গেলেও প্রগলভ মোদি এ নিয়ে আজ পর্যন্ত একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি।
ভারত সরকারের পাশাপাশি এই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ঘিরে মমতার সরকারেরও ভূমিকা সামনে আসছে। কেন্দ্রের ওষুধ সরবরাহের পক্ষপাতিত্বের কথা বলে মমতাও নিজের দায় এড়াবার চেষ্টা করছেন। আন্তর্জাতিক স্তরের বিজ্ঞানীদের এই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ঘিরে সতর্কতার বার্তা কেবল কেন্দ্রীয় সরকারই পান, তা নয়। এই ধরণের বিপদের বার্তা রাজ্য সরকারের কাছেও আসে। মমতার প্রশাসন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ঘিরে কী আগাম সতর্কতা নিয়েছেন?
কুম্ভমেলা, ভোট ঘিরে জনসমাগম করোনার সংক্রমণকে ভয়াবহ করে তুলেছে। একই সঙ্গে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের এই সংক্রমণেও ওই ধারাবাহিক বিপুল জনসমাবেশের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। তারপরেও মমতা নিজে নারদ মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে যেভাবে কয়েক ঘণ্টা সিআইডির কলকাতার অফিসে থেকেছেন, তার জেরে নিজাম প্যালেসের সামনে যেভাবে জনসমাগম হয়েছে, কোভিড ও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের এই ভয়াবহতার জন্যে সেগুলোও কম দায়ী নয়।
গোটা ভারত জুড়েই কোভিড ঘিরে যে জনসচেতনতার অভাব, সেই ছবি থেকে আলাদা নয় ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণের বিষয়টিও। পশ্চিমবঙ্গে এই সচেতনতা তৈরি করতে না শাসকের গরজ আছে, না আছে বিরোধীদের আছে। বামেরা একাংশের কর্মীদের ‘রেড ভলেন্টিয়ার’ হিসেবে নামিয়েছে কোভিড রোগীদের সাহায্যার্থে। প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলেও ন্যুনতম মেডিকেল প্রশিক্ষণ ছাড়া এই কর্মীদের করোনা রোগীর সেবা করা বেশ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। উত্তর চব্বিশ পরগণার গাইঘাটার বামপন্থী কর্মী শ্রীবাস হালদার রেড ভলেন্টিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। কোভিডে মারা গেছেন তিনি। যথার্থ প্রশিক্ষণ ছাড়া এভাবে দলের ছাত্র, যুবদের মহামারি মোকাবিলায় অংশ নেওয়ার বিষয়ে যদি এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা না করা হয়, এই বিপদ কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
গৌতম রায়: ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments