সোমেন চন্দ: সাহিত্যিক নাকি বিপ্লবী
মাত্র ২২ বছরের জীবন পরিধি তার। সেই জীবনকে ভেঙে দাঁড়ালে হয় মাত্র পাঁচ কিংবা সাড়ে পাঁচ বছরের, এর মধ্যেই সমস্ত কর্ম পরিধি। এই ক্ষুদ্র জীবনেই, বিপ্লবী রাজনীতি, সাহিত্য, সাহিত্য আন্দোলন, মেডিকেলের পড়াশোনা সমস্ত কিছুই একত্রিত হয়েছে। প্রথম তিন ধারার কাছে শেষটি খসে গেছে যদিও। তবুও কি ক্ষুদ্র জীবন! এই ক্ষুদ্র জীবনের পরিমাপে নিজে কিন্তু ক্ষুদ্র থাকেন নি, বৃহদাকারে ছড়িয়েছেন কখনো বিপ্লবে কখনো রাজনীতিতে, কখনো গল্পে, সাহিত্যে, সাহিত্য আন্দোলনে। তাকে ঠিক সংক্ষিপ্তে কি নামে বলা যায়? বিপ্লবী নাকি গল্পকার; সাহিত্যিক নাকি মার্ক্সবাদী আন্দোলনকারী! সোমেন চন্দ, যার নাম বললেই চোখে ভাসে বিপ্লব আর সাহিত্য কি করে একাকার হতে পারে, জীবনের পথ কি করে মিলে যেতে পারে আঁধার রজনী ঘেরা পূর্ণিমা জ্যোৎস্নায়। যে পথ ইঁদুর গল্পে দেখা মিলে। জীবনের প্রতিচ্ছবি তো আঁকাই ছিল, কেবল সুযোগ বুঝে পুরে দেয়া, পাঠকের অন্তঃদৃষ্টি কি তাতে এড়ানো যায়?
সোমেন চন্দের জন্ম ১৯২০ সালের ২৪ মে ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাড্ডা ইউনিয়নের তেঘরিয়া গ্রামে নানার বাড়িতে। পার্শ্ববর্তী পারজুয়ার এর ধীতপুর গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। বাবা নরেন্দ্রকুমার চন্দ, মা হিরণবালা। অবশ্য তাদের আদি বাড়ি ছিল নরসিংদীর বালিয়ায়। নরেন্দ্রকুমার চন্দ কাজ করতেন ঢাকার মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের স্টোরস বিভাগে।
মাত্র চার বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন সোমেন চন্দ। হিরণবালার মৃত্যুর পর তার বাবা নরেন্দ্রকুমার সোমেন চন্দকে লালন-পালনের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ডা. শরৎচন্দ্র বসুর মেয়ে সরযূদেবীকে বিয়ে করেছিলেন নরেন্দ্রকুমার। সরযূদেবীর কাছেই বেড়ে ওঠা সোমেন চন্দের। একটা সময় সরযূদেবীর বাবার বাড়িই পুরোপুরি মাতুতালয় হয়ে উঠেছিল সোমেন চন্দের কাছে। বেড়াতে গেলেও তার যাওয়া হতো সরযূদেবীর বাবার বাড়ি ধউরে।
সোমেন চন্দের শৈশব কেটেছিল পুরাণ ঢাকার তাঁতবাজারে। ছেলেকে পোগোজ স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন নরেন্দ্রকুমার চন্দ। এখান থেকেই ১৯৩৪ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৩৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছিলেন তিনি। তার মেধার পরিচয় এসেছিল ফলাফলেও। ১৯৩৬ সালে মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজে ভর্তিও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অসুস্থতা বাদ সাধে। ডাবল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়াশোনায় ইস্তফা দিলেন।
১৯৩৫ সালের নভেম্বরে লন্ডনে ভারতীয় ও বৃটিশ লেখকদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে উপস্থিত ছিলেন ই এম ফরস্টার, হ্যারল্ড লাস্কি, হার্বাট রিড, রজনী পাম দত্ত, সাজ্জাদ জহির, মূলক রাজ আনন্দ, ভবানী ভট্টাচার্যের মতো বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সমাজতাত্ত্বিক সাহিত্যিকেরা। নানা আলোচনার পর তখন তারা একটি ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন ডিসেম্বরে। এরই সূত্র ধরে ভারতে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ গঠিত হলো। তার চার বছর পর ঢাকায় চালু হলো এর শাখা। লন্ডনের বৈঠকে সাহিত্যিকরা এ সংগঠনের নাম ‘প্রগতি সাহিত্য সংঘ’ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যখন ইশতেহার প্রকাশিত হয় তখন প্রস্তাবিত নাম রাখা হয় ‘প্রগতি লেখক সংঘ’। ১৯৩৬ সালের ১০ এপ্রিলের এ সভায় সভাপতিত্ব করেন বিখ্যাত হিন্দি লেখক মুন্সী প্রেমচান্দ। সভায় সংগঠনের নামকরণ করা হয় ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’। ভারতে এর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রেমচান্দ ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন সাজ্জাদ জহির।
এর মধ্যে সোমেন চন্দ প্রগতি লেখক সংঘে যোগ দিলেন। মার্ক্সবাদী রাজনীতি ও সাহিত্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হলেন একাধারে ১৯৩৭ সালে সোমেন চন্দ প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন পুরোপুরিভাবে। ১৯৩৮ সালে কমিউনিস্ট পাঠচক্রের সম্মুখ প্রতিষ্ঠান প্রগতি পাঠাগারের পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন সোমেন চন্দ। তখন তিনি ও তার পরিবার থাকেন ওয়ারীর দক্ষিণ মৈশুন্দিতে। এসময় বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশীর মতো আজীবন বিপ্লবী শিক্ষকের রাজনীতি ও দর্শনের পাঠ নিলেন সোমেন চন্দ। বিপ্লবী, সাংবাদিক রনেশ দাশগুপ্তের সান্নিধ্যে থেকে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, ম্যাক্সিম গোর্কী, মোপাঁসা, রঁলা, বারবুস, জিদ, মারলো, কডওয়েল রালফ ফক্সসহ আরো অনেকের লেখা এ সময়ে পড়েছিলেন সোমেন চন্দ।
এসময় তিনি রালফ ফক্স নিয়ে একটি কবিতাও লিখেছিলেন। যেটির শুরুটা ছিল এমন
"রালফ্ ফক্সের নাম শুনেছো?
শুনেছো কডওয়েল আর কনফোর্ডের নাম?
ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকার কথা জান?
এই বীর শহিদেরা স্পেনকে রাঙিয়ে দিল,
সবুজ জলপাই বন হলো লাল,
মার – বুক হল খালি –
তবু বলি, সামনে আসছে শুভদিন।"
সোমেন চন্দের গল্পের প্রসঙ্গে আসি। সোমেন চন্দের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো তার সৃষ্ট গল্প। আর এর মধ্যে প্রথমেই আসবে ইঁদুর গল্পটি। যে গল্পটি আজ অব্দি ৬৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যেখানে সোমেন চন্দ তুলে এনেছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত এক পরিবারের চিত্র, ইঁদুরের রাজত্ব আর ইঁদুরের উপদ্রবকে ভিত্তি করে যেখানে উঠে এসেছে ওই পরিবারের অবস্থা, মানবিকতা, অভাব অনটন, কষ্ট বেদনা, আনন্দ থেকে শুরু করে স্বপ্নের কথা। সেই অভাবের সংসারে দুধ ছিলো দুর্লভ বস্তু। সেই দুর্লভ বস্তু যখন ইঁদুরে খায় খানিক আর বাকিটা মাটিতে ফেলে দেয়, সেই চিত্র ইঁদুর গল্পে কি অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন, "দেখলাম, আমাদের কচিৎআনা দুধের ভাঁড়টি একপাশে হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে আছে আর তারই পাশ দিয়ে একটি সাদাপথ তৈরি করে এক প্রকান্ড ইঁদুর দ্রুত চলে গেল। এখানে একটা কথা বলে রাখি, কোনো বিশেষ খবর শুনে কোনো উত্তেজনা ভাবান্তর প্রকাশ করা আমার স্বভাবে নেই বলেই বার বার প্রমাণিত হয়ে গেছে। কাজেই এখানেও তার অন্যথা হবে না, একথা বলা বাহুল্য। দেখতে পেলাম, আমার মা-র পাতলা কোমল মুখখানি কেমন এক গভীর শোকে পার হয়ে গেছে, চোখ দুটি গোরুর চোখের মতো করুণ, আর যেন পদ্মপত্রে কয়েক ফোঁটা জল টল টল করছে, এখুনি কেঁদে ফেলবেন। দুধ যদি বিশেষ একটা খাদ্য হয়ে থাকে এবং তা যদি নিজেদের আর্থিক কারণে কখনো দুর্লভ হয়ে দাঁড়ায় এবং সেটা যদি অকস্মাৎ কোনো কারণে পাকস্থলীতে প্রেরণ করার অযোগ্য হয়, তবে অকস্মাৎ কেঁদে ফেলা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। মা অমনি কেঁদে ফেললেন, আর আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম. এমন একটা অবস্থায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই।"
এই গল্পে ইঁদুরের উপদ্রবে দেখা যায় ইঁদুর ধরার কল কেনার সামর্থ্য নেই বলে মায়ের উত্তর, তেমনি মায়ের প্রচণ্ড ভয়। অভাবের কাছে সমস্ত কিছু মেনে নেয়া। আবার একই সঙ্গে শব্দের মেটাফোর ও অসামান্য গল্প বর্ণনার মুন্সিয়ানায় যেমন কমিউনিস্ট রাজনীতি ও পুঁজিবাদী প্রশাসনকে ইঁদুর ও ইঁদুর ধরার কলের মধ্যে আঁকড়ে রাখা।
তাইতো শেষটা এমন আমরা দেখি, “তারপর সন্ধ্যার অনুকূলে বাসায় ফিরলাম। কয়েকদিন পরে কোনো গভীর প্রত্যুষে একটি ইঁদুর মারা কল হাতে করে আমার বাবা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাসতে লাগলেন। দারুণ খুশিতে নারু আর মন্টুও দুই আঙুল ধরে বানরের মতো লাফাচ্ছিল। কয়েক মিনিট পরেই আরও অনেক ছেলেপেলে এসে জুটল। একটা কুকুর দাঁড়াল এসে পাশে। উপস্থিত ছেলেদের মধ্যে যারা সাহসী তারা কেউ লাঠি, কেউ বড়ো-বড়ো ইট নিয়ে বসল রাস্তার ধারে। ব্যাপার কিছুই নয়, কয়েকটা ইঁদুর ধরা পড়েছে।”
মাত্র ১৯ বছর বয়সেই সোমেন চন্দ লিখেছিলেন এই গল্প। শব্দের বুনট কৌশল, নিখুঁত ভাষারীতি, মনস্তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষণধর্মী কথোপকথন চির বাস্তবিক করে তুলেছিল এই গল্পকে। কিংবা বলা যায় তার প্রত্যাবর্তন গল্প নিয়ে। যেখানে আমরা দেখতে পাই পঁচিশ বছর পরে গ্রামে ফেরা প্রশান্তকে। যে কিনা স্বদেশী করে জেল খেটেছে। পঁচিশ বছর পরে গ্রামে ফিরে দেখা তার কৃষক কালু মিঞার সঙ্গে। কালু মিঞা তাকে ঘরে নিয়ে গেছে। তারপর একসময়ে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘তুমি আজকালও স্বদেশী কর?’ শুনে প্রশান্ত মনে মনে হাসে। সে বলে, “সেদিন বড় ভুল করিয়াছিলাম বন্ধু, একলা পথ চলিয়াছিলাম। তোমাদের কথা ভাবি নাই, আজ আর সেই ভুল হইবে না।” এই উপলব্ধিতে পৌঁছবার একটি বস্তুগত কারণও আছে। পঁচিশ বছর পরে গ্রামে ফিরে প্রশান্ত দেখে যে তার আত্মীয়স্বজন কেউ তো নেই-ই, বাড়িঘরও নেই। কৃষক কালু মিঞাই তার একমাত্র বন্ধু যে অবশিষ্ট আছে।
বলা যায় তার লেখা গল্প ‘বনস্পতি’ নিয়ে। বনস্পতি বড় গল্প। গল্পে দেখা যায় গ্রামের নাম পীরপুর, যে গ্রামের সমস্ত ঘটনার সাক্ষী একটি বটগাছ। সেই গ্রামের রাজেন মিত্রের ছেলে সতীন মিত্র কলকাতায় এক সাহেবকে মারতে গিয়ে ধরা পড়েছে। আমরা দেখি গল্পে এমন বর্ণনা সোমেন চন্দের বনস্পতি গল্পে, “কলিকাতা শহরে কোন্ এক সাহেবকে মারিতে গিয়া নাকি ধরা পড়িয়াছে।” নয় বছর পরে সেই সতীন মিত্রকে দেখা গেল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গ্রামে এসে কৃষকদের সঙ্গে মিলছে। তাদেরকে নিয়ে জটলা করছে। তারপর ওই বটতলাতেই একদিন কৃষকদের এক সমাবেশে সতীনের বক্তৃতা শোনা গেল। হায়দর নামে এক কৃষকের ছেলে, নাম বসির, সতীনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সতীন বলেছে, ভাইসব, সমাজের যারা পরগাছা – যারা আমাদের গায়ের রক্ত শুষে শুধু বসে খায়, তাদের উপড়ে ফেলার দিন এসেছে আজ। ভাইসব, আমাদের জিনিস দিয়েই ওরা মোটর হাঁকায়, ব্যাংকে লাখ লাখ টাকা জমা রাখে, কিন্তু আমরা না খেয়ে মরি। এ অত্যাচার কেন আমরা সহ্য করবো? কেন সহ্য করবো? দেখা গেল সতীন মিত্র আর জাতীয়তাবাদী নেই, সমাজতন্ত্রের পথ ধরেছে। হয়তোবা কমিউনিস্টই হয়ে গেছে। কিন্তু তার সেদিনের বক্তৃতা বেশিদূর এগোতে পারেনি। লাঠি হাতে মস্ত জোয়ান একদল লোক বটতলার বাঁধানো জায়গাটিতে উঠে অনবরত লাঠি চালাতে শুরু করে দিয়েছে। সতীন মিত্র চিৎকার করে শুধু এইটুকু বলতে পেরেছে : “ভাইসব, এদের চিনে রাখুন, এরা সেই জমিদারদেরই ভাড়াটে গুন্ডা, লাঠি চালিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করতে এসেছে।” এর বেশি আর বলা হয়নি। লাঠির ঘা খেয়ে নিচে পড়ে গেছে। রক্তে তার শরীর এবং মাটি লাল হয়ে গেল। শ্রোতাদের আরও কেউ কেউ মাটিতে পড়ে রইলো। অন্যরা পালিয়েছে। এটি ১৯৩৯ সালের ঘটনা। সোমেন তার এ-গল্পটি হয়তো ১৯৪০-এ লিখেছেন। তিনি জানতেন না, কেউ জানতো না যে, দেড় দু’বছরের মধ্যে গল্পের সতীন মিত্রের মতোই তিনি নিজেও মারা যাবেন, একই ভাবে, সামাজিক বিপ্লব-বিরোধী মানুষদের হাতে।
তার লেখা দাঙ্গা গল্পের কথা না বললেই নয়। পূর্ব বাংলায় সোমেন চন্দের দাঙ্গা গল্পই ছিল প্রথম দাঙ্গার গল্প। চল্লিশের দশকের ঢাকায় দাঙ্গা অতিপরিচিত ঘটনা। চারপাশে অস্থিরতা। দাঙ্গা গল্পে যেমনটি সোমেন চন্দ ফুটিয়ে তুলেছিলেন কিভাবে জানতেন নিজের সঙ্গেই পরবর্তীতে ঘটবে।
দাঙ্গা গল্পে দেখা যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কতোটা অস্থির ও আচমকা ঘটতো। যেখানে আমরা দেখি সোমেন লিখেছেন, "এমন সময় কথাবার্তা নেই দুটি ছেলে এসে হাজির, তাদের মধ্যে একজন কোমর থেকে একটা ছোরা বের করে লোকটার পেছনে একবার বসিয়ে দিল। লোকটা আর্তনাদ করে উঠল, ছেলেটি এতটুকু বিচলিত হলো না, লোকটার গায়ে যেখানে-সেখানে আরও তিনবার ছোরা মেরে তারপর ছুটে পালালো, কুকুর যেমন লেজ তুলে পালায় তেমনি ছুটে পালালো। লোকটা আর্তনাদ করতে করতে গেটের কাছে গিয়ে পড়লো, তার সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে গেছে, টাটকা লাল রক্ত, একটু আগে দেখেও মনে হয়নি এত রক্ত ঐ কংকালসার দেহে আছে।"
কিংবা শিক্ষিকা সুপ্রভা সেনের আচমকা ঘাত; বলা যায় রাস্তার সে ফেরিওয়ালার ভয়ংকর আঘাতের মধ্যেও তীব্র শ্লেষ। যেখানে সে বলছে, ‘বাবুরা হাসছেন। হাসুন, আপনাদেরই দিন পড়েছে, গবর্নমেন্টের যেমন পড়েছে। দিন পড়েনি শুধু আমাদের, আমরা মরবো, মরবো!’ এই গল্পের নায়ক তো অশোকই। সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য তো বটেই এক হিন্দু। যেখানে অশোকের গলায় সোমেন চন্দ তুলে ধরেছিলেন ক্ষোভ আর উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধাচরণ আর একই সঙ্গে অসহায়ত্ব। ‘ফ্যাসিস্ট এজেন্ট। বড়লোকের দালাল। আজ বাদে কালের কথা মনে পড়ে যখন ‘হিন্দু-মুসলমান ভাই-বোনেরা’ বলে গাধার মতো ডাক ছাড়বি? তখন তোর গাধার ডাক শুনবে কে? পেট মোটা হবে কার? স্টুপিড,জানিস দাঙ্গা কেন হয়? জানিস প্যালেস্টাইনের কথা? জানিস আয়ারল্যান্ডের কথা, মূর্খ! কিংবা অশোকের কণ্ঠে আশার প্রদীপ। যেখানে সোমেন চন্দ লিখেছেন 'কার দেহ থেকে এই রক্তপাত হয়েছে কে জানে? অশোকের চোখে জল এল, সবকিছু মনে পড়ে গেল। সে চারদিক ঝাপসা দেখতে লাগল, ভাবল এই চক্রান্ত ব্যর্থ হবে কবে?'
মাত্র ২২ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে সোমেন চন্দের হাতে জন্ম নিয়েছিল ২৪টি গল্প, একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস, ৩টি কবিতা। এটি কতোখানি সংক্ষিপ্ত তা জানা যাবে যখন তার সাহিত্যের শুরুটা হয়েছিল ১৭ বছরে এসে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে জন্ম নিলো তার একমাত্র অসম্পূর্ণ উপন্যাস 'বন্যা'। এর মধ্যে মেডিকেলে কলেজে ভর্তি হওয়া, আবার খারাপ স্বাস্থ্যের কারণে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে না পেরে "প্রগতি লেখক সংঘে" যোগদান এবং মার্ক্সবাদী রাজনীতি ও সাহিত্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়া। শ্রমিক আন্দোলন। এক উপন্যাসের মতো গল্প যেন জীবন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়েরও সাহিত্যের সূচনা হয়েছিলো সতেরোতে। পল্লী সাহিত্য নিয়ে শরতের মতো জানাশোনা ছিলো সোমেনের। মজার বিষয় হলো সোমেনের প্রথম দিকের গল্প যেমন 'রাত্রিশেষ’, ‘স্বপ্ন’, ‘গান’, ‘পথবর্তী’, এসব গল্পে শরৎচন্দ্রের ধাঁচ আছে এবং সেটা সোমেন চন্দ নিজেও জানতেন, অবশেষে তখন তার উপলব্ধি হলো এভাবে না। নতুন করে গর্তে হবে। বলা যায় ওই অল্প বয়সেই তার ভেতর অবসাদের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দরকার। ৯ নভেম্বর ১৯৩৮-এ নির্মলকুমার ঘোষকে লেখা চিঠিতে সোমেন চন্দ লিখেছিলেন, ‘বছর খানেক সেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির কোন পথ খুঁজে পেতাম না, এখন কতকটা পেয়েছি, বলে মনে হচ্ছে।’ ওই যে লেখার ভাবনা ওই ছিলো কমিউনিজমের ধারা। তিনি চিঠিতে ঠিকভাবে উল্লেখ করেননি কেন তারও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কারণ নির্মলকুমার কমিউনিস্টদের বিরোধী ছিলেন, অনেকক্ষেত্রে দুচোখের বিষ বলা যায়। সোমেনের এই যে মিশে যাওয়া তাও তো কমিউনিস্টপন্থী নেতাকর্মীদের সংস্পর্শে এসে।
অনেকে বলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য আর সোমেন চন্দের মাঝে মিলে মিশে একাকার রৈখিক প্রতিচ্ছবি। আসলেই কি তাই? অনেকেই তুলনা করতে ভালোবাসেন। সুকান্ত আর সোমেন চন্দকে এক লাইনে এসে মাপ নিতে চান বরাবর। অনেকটাই হয়তো তাই। বয়সের কথা বললে আসলেই তাই। সুকান্ত, সোমেন চন্দ একুশে- বাইশে, অপঘাতে মৃত্যু সোমেনের বলা যায় আততায়ীর হাতে, সুকান্তের মৃত্যু যেমন যক্ষ্মায়। শহর আলাদা, একজনের কলকাতায়, আরেকজনের ঢাকায়। কে জানতো জীবন আরো অনেকখানি মিলিয়ে দেবে তাদের! একজন কবি, একজন কথাসাহিত্যিক; দুজনেই কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে তুমুলভাবে সংশ্লিষ্ট ও নিবেদিত প্রাণ কর্মী, দুজনেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। সুকান্তকে যদি বলা হয় কবিতার বিপ্লবী তবে পূর্ববঙ্গে কথাসাহিত্যের বিপ্লব তো সোমেন চন্দের হাত ধরেই। এসব কিছু কেবল একটি জায়গা এ দিয়ে সোমেন চন্দকে চেনা যায় না।
মানুষের অধিকার, গণমানুষের কথা কি করে মিলেমিশে একাকার হলো সোমেন চন্দের লেখায় তা বর্ণনা পাওয়া যায় এক চিঠিতে। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে বন্ধু অমৃতকুমার দত্ত’কে তিনি লিখেছেন "গত কয়েকদিন রেল-শ্রমিকদের নিয়ে বেশ ঝামেলায় ছিলাম। লেখার জন্য একটুও সময় পাই না। তবু লিখতে হবে, মেহনতী মানুষের জন্য, সর্বহারা মানুষের জন্য আমাদের লিখতে হবে।" তাইতো বিপ্লব, সাহিত্য, সাহিত্যিক বিপ্লবী এইসব গণ্ডির মধ্যেই কেবল আবদ্ধ থাকেননি সোমেন চন্দ। হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের সাহিত্যিক, জীবনকে অবলোকন করা এক অনন্য পথিক।
সোমেন চন্দের শেষটাও যেন তার গল্পের মতো কঠিন ধাঁচে। সরদার ফজলুল করিম তার স্মৃতিকথায় বর্ণনা করেছিলেন এমন "১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ঢাকার বুদ্ধিজ়ীবি, লেখক প্রভৃতি শহরে এক ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলন আহবান করেন। স্থানীয় জেলা পার্টির অনুরোধে কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি ও জ্যোতি বসু সেখানে বক্তা হিসেবে যান। সম্মেলন উপলক্ষে শহরে খুবই উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক মহল প্রায় তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম যারা সম্মেলনের পক্ষে, দ্বিতীয় যারা সরাসরি বিপক্ষে, তৃতীয় যারা মোটামোটিভাবে তুষ্ণীভাব অবলম্বন করে নিরপেক্ষতার আবরণ নিয়েছিলেন। শেষোক্তদের মধ্যে প্রধানত কংগ্রেস মতবাদের অনুসারীরা ও দ্বিতীয় দলে ছিলেন জাতীয় বিপ্লবী, বিশেষত শ্রীসংঘ ও বিভির লোকেরা। যাই হক, সম্মেলনের দিন সকালে উদ্যোক্তাদের অন্যতম তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ আততায়ীর হাতে নিহত হন।"
তবে সোমেন চন্দের এই ছুরিকাঘাতের পেছনে আরেক জটিল রেখা আছে। সে রেখাটি পুরোপুরি এক পথের মধ্যেই দুই উপধারা।
সোমেন চন্দ যখন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সংযুক্ত, তখন অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন লীলা নাগ ও অনিল নাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ছিলেন লীলা নাগ। দুজনেই ছিলেন ইংরেজি বিভাগের সহপাঠী। একে ওপরকে বিয়েও করেছিলেন তারা। এই লীলা নাগকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল ১৯৩১ সালে। লীলা নাগই প্রথম ভারতীয় নারী যাকে বিনাবিচারে আটকে রাখা হয়েছিল একটানা ৭ বছর। জেল থেকে বের হয়ে রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলেন লীলা নাগ। তখন তার সম্পাদনায় বের হতো পত্রিকা "জয়শ্রী"। এই জয়শ্রী পত্রিকার কারণে সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন তিনি। লীলা নাগের সঙ্গে সোমেন চন্দের পরিচয় ছিল বেশ, কিন্তু একসঙ্গে কাজ করতে পারেননি কারণ কমিউনিস্ট পার্টিতে দুজন দুই ধারায় ছিলেন। লীলা নাগ ছিলেন সুভাষচন্দ্রের অনুসারী। যখন লীলা নাগেরা গড়ে তুলেছিলেন নারী শিক্ষা মন্দিরের, তখন সোমেন চন্দরা গড়লেন প্রগতি পাঠাগার। প্রগতি পাঠাগার ছিল কমিউনিস্টদের সংস্কৃতিচর্চার গোপন কেন্দ্রবিন্দু। সুভাষপন্থীদের ফরওয়ার্ড ব্লকে নেতৃস্থানীয় পদে ছিলেন লীলা নাগ। আর এই ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মীরাই ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছিল সোমেন চন্দকে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যেমন লিখেছিলেন, "অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ঢাকা শহরে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের বুদ্ধিজীবীরা; পাশাপাশি বুদ্ধদেব বসুরাও ছিলেন। দুই ধারা এক হয়নি। এক হওয়া সম্ভব ছিল না। লীলা নাগের ধারা আর সোমেন চন্দের ধারাও এক হয়নি, বরং এক পক্ষ আরেক পক্ষকে উৎখাত করতে চেয়েছে।"
আজ বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, গল্পকার সোমেন চন্দের জন্মদিন। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি বাংলা সাহিত্যে গষসাহিত্যের স্রষ্টার প্রতি।
তথ্যসূত্র -
সোমেন চন্দ/ হায়াৎ মামুদ
ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের লেখক শহীদ সোমেন চন্দ/ সম্পাদনা সাধন চট্টোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থরঞ্জন চৌধুরী
বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা/ হায়দার আকবর খান রনো
Comments