দেশে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ শনাক্ত

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন দেশে এমন অন্তত দুজনের শরীরে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ শনাক্ত হয়েছে। সম্প্রতি ভারতে বিরল ছত্রাকজনিত এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশে এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে দুজন আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা গেল।
Black Fungus.jpg
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন দেশে এমন অন্তত দুজনের শরীরে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ শনাক্ত হয়েছে। সম্প্রতি ভারতে বিরল ছত্রাকজনিত এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশে এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে দুজন আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা গেল।

চলতি মাসে রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতাল থেকে তাদের শরীরে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্ত করা হয়।

বারডেম হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, গত ৮ মে ৪৫ বছর বয়সী এক রোগীর শরীরে মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর গত ২৩ মে ৬০ বছর বয়সী আরেক জনের শরীরেও ছাত্রাকজনিত রোগটি শনাক্ত হয়।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, যাদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল তাদের মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

এ বিষয়ে বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. লাভলি বাড়ৈ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের ল্যাবে দুজনের শরীরে মিউকরমাইকোসিস শনাক্ত হয়েছে। আমরা তাদের চিকিৎসা দিচ্ছি এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি।’

বারডেম হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে কোভিড-১৯ রোগীর শরীরে এবারই প্রথম ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্ত হওয়ার কথা জানান তিনি।

‘আমরা সতর্কভাবে তাদের পর্যবেক্ষণ করছি’ উল্লেখ করে ডা. লাভলি বাড়ৈ বলেন, ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে অবস্থা গুরুতর হতে পারে। তাই, তাদের সতর্কভাবে চিকিৎসা দিতে হয়।’

তিনি আরও জানান, করোনা আক্রান্ত রোগীকে মাত্রা না বুঝে স্টেরয়েড দিলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে, যার ফলে রোগীর ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মতে, মিউকরমাইসিটিস ছত্রাক থেকে মিউকরমাইকোসিস হয়ে থাকে। এটি বাতাসের চেয়ে মাটিতে এবং শীত ও বসন্তকালের চেয়ে গ্রীষ্ম ও শরৎকালে বেশি দেখা যায়। বেশিরভাগ মানুষই প্রতিদিন এই আণুবীক্ষণিক ছত্রাকের স্পোরের সংস্পর্শে আসে। সুতরাং এই মিউকরমাইসিটিসের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা প্রায় অসম্ভব।

তবে, বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এই ছত্রাক ক্ষতিকর নয়। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তাদের শরীরে মিউকরমাইসিটিসের স্পোর প্রবেশ করলে ফুসফুস ও সাইনাস আক্রান্ত হতে পারে। যা পরে শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে।

সিডিসি’র মতে, এই বিরল ছত্রাকে আক্রান্তদের মৃত্যুহার ৫০ শতাংশ। তবে, ৯২৯টি ঘটনা নিয়ে করা ২০০৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে মৃত্যুহার ৫৪ শতাংশ।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সব বয়সী মানুষের এই ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি না থাকায় এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার তেমন কিছু নেই।

তারা আরও জানান, কোভিড-১৯ ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী, যারা স্টেরয়েড নিচ্ছেন, ক্যান্সার আক্রান্ত অথবা যারা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করেছেন, তারা সবচেয়ে বেশি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।

বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তাই নয়, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের কারণেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

ডা. লাভলি বাড়ৈ বলেন, ‘যখন একজন বয়স্ক ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন যথেচ্ছভাবে স্টেরয়েডের ব্যবহারের কারণেও তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এর ফলে তিনি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হতে পারেন।’

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ভারতের স্বাস্থ্যখাতে নতুন হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা গত রোববার জানান, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় তারা খুব শিগগিরই একটি নীতিমালা তৈরি করবেন।

স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. নাজমুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি কমিটি কিছু সুপারিশ তৈরি করছে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যসেবা উপদেষ্টা কমিটিও এই রোগ প্রতিরোধে কিছু বিধিবিধান তৈরি করছে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণের চিকিৎসায় এগুলো খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।’

ডা. নাজমুল আরও জানান, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের কোনো অস্বাভাবিক সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি।

তবে, ভারতে এখন পর্যন্ত ৭ হাজার ২০০ জনের শরীরে মিউকরমাইকোসিস শনাক্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে ২১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে ভারতের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, যেসব কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় অতিরিক্ত স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বাড়ছে।

ভারতের তামিলনাড়ু, গুজরাট, ওডিশা, রাজস্থান ও তেলেঙ্গানা- এই পাঁচ রাজ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা রোগীরা সবচেয়ে বেশি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার রোগীরা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হলে তাদের অবস্থা গুরুতর হতে পারে। তাই, তাদের সতর্কভাবে চিকিৎসা দেওয়া উচিত।’

সিডিসি’র গাইডলাইন বলছে, অ্যান্টি ফাঙ্গাল মেডিসিন ব্যবহার করে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস চিকিৎসা করা হয়। এসব ওষুধের বেশিরভাগই শিরা পথে দেওয়া হয়। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস চিকিৎসায় সবচেয়ে প্রচলিত ওষুধের মধ্যে আছে অ্যাম্ফোটেরিসিন বি। এই ওষুধটি সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

সেরে উঠতে রোগীকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই ওষুধ দিতে হতে পারে। তবে, কত তাড়াতাড়ি রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা আরম্ভ করা হয়েছে তার ওপরও এটা নির্ভর করে।

সম্প্রতিকালে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, প্রায় ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচার করে রোগীর ছত্রাক আক্রান্ত কোষ ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এতে কিছু রোগী তাদের ওপরের চোয়াল ও চোখ হারিয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন:

ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, গাইডলাইন দেওয়া হবে: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

কালো ছত্রাক প্রতিরোধে ভিটামিন ‘সি’ সবচেয়ে কার্যকর: ড. বিজন

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস: ভারতের উদাসীনতায় বিপদ বাড়বে বাংলাদেশের

এবার ভারতে নতুন মহামারি ‘কালো ছত্রাক’

কোভিড রোগীদের আরেক আতঙ্ক ‘কালো ছত্রাক’

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago